যখন কোনো কারণে (সাধারণত প্রাকৃতিক) প্রকৃতিতে বড় আকারে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তির ঘটনা ঘটে, তখন তাকে গণবিলুপ্তি বলে। গবেষণা বলছে, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত প্রজাতির প্রাণীর বিচরণ হয়েছে তার ৯৯ ভাগই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই বিলুপ্তির প্রায় পুরোটাই হয়েছে বিভিন্ন গণবিলুপ্তির সময়ে। ইতিহাসে এর আগে ৫টি গণবিলুপ্তির ঘটনা ঘটেছে- ওর্ডোভিসিয়ান, ডেভোনিয়ান, পারমিয়ান, ট্রায়াসিক এবং ক্রিটেসিয়াস। আনুমানিক ৪৪০ মিলিয়ন বছর পূর্বে প্রথম গণবিলুপ্তিটি হয়েছিল, শেষটি হয় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। ট্রায়াসিক বাদে অপর চারটি গণবিলুপ্তিতেই পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল সেসময় বিরাজমান প্রাণীদের ৭০ ভাগের অধিক। এই গণবিলুপ্তিগুলো ঘটেছে মূলত বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণেই; যেমন উল্কাপাত, আগ্নেয়গিরি, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া কিংবা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার ওঠানামা। তবে বিজ্ঞানীরা যে ৬ষ্ঠ গণবিলুপ্তির আশংকা করছেন, যা বর্তমানে ঘটে চলেছে বলে ধরে নেয়া হয়, এর জন্য এককভাবে মানবজাতিই দায়ী!
সমস্যার মূলে
এক কথায় যদি বলা হয়, সমস্যার মূলে রয়েছে মানবজাতির অবদান, তাহলে একটুও অত্যুক্তি হবে না। পৃথিবীতে মানুষের জনসংখ্যা বর্তমানে ৭৫০ কোটি ছাড়িয়ে দ্রুতগতিতে উর্ধ্বমুখীই রয়েছে। ৮/৯০০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে হয়তো খুব বেশি দিন নেই। আর এই বিপুল সংখ্যক মানুষের দ্বারা প্রথম যে সমস্যাটির উদ্ভব হয়, সেটি হলো বাসস্থান সমস্যা। মানুষ প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থান ধ্বংস করছে নিজেদের বাসস্থানের জন্য, অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের জন্য ধ্বংস করছে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট প্রাণীদের অভয়ারণ্যগুলো। অতিরিক্ত পশু-পাখি শিকার, কিংবা মাত্রাতিরিক্ত মাছ শিকার, শিল্পায়ন, রাসায়নিক দূষণ, এক অঞ্চলের প্রাণীকে অন্য অঞ্চলে নিয়ে যাওয়া, কী করতে বাদ রেখেছে মানুষ? মানুষের এহেন কর্মকাণ্ড পৃথিবী থেকে একের পর এক নিশ্চিহ্ন করছে বৈচিত্র্যময় সব প্রাণীকে।
মানুষের আগ্রাসনে প্রাণীজগৎ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার এক ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরেছে ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড’। সংস্থাটির ২০১৪ সালের এক গবেষণায় উঠে আসে দুঃখজনক এক তথ্য- কেবল গত ৪০ বছরেই পৃথিবীর বন্য প্রাণী কমে গেছে ৫০ ভাগ। গবেষণাটি থেকে আরো জানা যায়, ১৯৭০ সালের পর থেকে প্রকৃতিতে বিভিন্ন প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর সংখ্যা গড়ে ৬০ ভাগ কমে গেছে। শুধু আমেরিকার উপর একটি জরিপে দেখা যাচ্ছে, কেবল গত ২০ বছরেই আমেরিকা থেকে গায়েব হয়ে গিয়েছে ৯০ শতাংশ রাজা প্রজাপতি এবং ৮৭ শতাংশ ভ্রমর। প্রশান্ত মহাসাগরে আমাদের সকলের প্রিয় টুনা মাছের উপস্থিতি কমে গেছে ৯৫ ভাগ। এসব নিছক বা পৃথক পরিসংখ্যান নয়। এসবই সংযুক্ত এবং একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে যাত্রার ইঙ্গিত দেয়। আর সেটি হলো ৬ষ্ঠ গণবিলুপ্তি।
বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রজাতির সংখ্যা
প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন, পৃথিবীতে আদতে কত প্রজাতির প্রাণী আছে, তা বিজ্ঞানীরা নির্দিষ্ট করতে পারেননি। সংখ্যাটা ৯ মিলিয়ন থেকে ১ ট্রিলিয়নের মধ্যে অনুমান করা হয়। কিন্তু, এই আনুমানিক সংখ্যারও একটা অতি সামান্য অংশই এখনো পর্যন্ত চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে। এখনো পর্যন্ত প্রায় ৬০ হাজারের মতো মেরুদণ্ডী প্রাণীর প্রজাতি চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর মাঝে গত ৪০ বছরেই বিলুপ্ত হয়েছে ৩৩৮টি প্রজাতি। সংখ্যাটা ৬১৭তে দাঁড়ায়, যখন সম্ভাব্য বিলুপ্তি হিসাব করা হয়। অতি সম্প্রতি কিছু উল্লেখযোগ্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটেছে, যেগুলোর বিলুপ্তি ঠেকাতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। ব্রাজিলিয়ান নীল টিয়া, স্পিক্স ম্যাকাও আর উত্তরাঞ্চলীয় সাদা রাইনোর প্রজাতির সর্বশেষ সদস্যটি পৃথিবী ত্যাগ করেছে ২০১৮ সালের শেষদিকে।
একইভাবে বিলুপ্ত হচ্ছে অমেরুদণ্ডী প্রাণীগুলোও। পৃথিবীর ৯৯ ভাগ প্রাণীই হচ্ছে অমেরুদণ্ডী। এর মাঝে যে ১২ লক্ষ প্রজাতি বিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করতে পেরেছেন, তার ৪০ ভাগই ইতোমধ্যে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই বিলুপ্ত প্রাণীগুলোর মধ্যে ১৫০০ প্রজাতির কেবল স্থলজ শামুকই রয়েছে, যা প্রমাণ করে ভূমিতে মানুষ কতটা আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এক্ষেত্রে জলভাগের ঝক্কি পোহাতে হয়েছে অনেক কম। গত ২/৩০০ বছরে চিহ্নিত জলজ প্রাণীর মাঝে বিলুপ্ত হয়েছে কেবল ১৫টি প্রজাতি। তবে সম্ভাব্য বিলুপ্তির ধারণা করা হয় আরো অনেক বেশি। অন্যদিকে, এতদিন জলজ প্রাণীরা কিছুটা নিরাপদ থাকলেও এখন আর তা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যাপক মাত্রায় প্লাস্টিক দূষণ আর রাসায়নিকের কারণে এই শতকেই পৃথিবীর জলভাগ থেকে বিদায় নিতে পারে ৭ শতাধিক জলজ প্রজাতির প্রাণী!
বিলুপ্তির পথে আছে যারা
এ তো গেল বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া প্রাণীদের কথা। আমাদের অধিক চিন্তিত হওয়া উচিত বরং সেসব প্রাণী নিয়ে, যারা এখনো বিলুপ্ত না হলেও আছে বিলুপ্তির পথেই। ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’ বা আইইউসিএন বলছে, প্রায় ২৬,৫০০ প্রজাতির প্রাণী শীঘ্রই বিলুপ্ত হওয়ার পর্যায়ে রয়েছে। এই প্রাণীগুলোর মাঝে আছে উভচর প্রাণীদের ৪০ ভাগ, প্রাকৃতিকভাবে প্রবালপ্রাচীর তৈরি করা প্রবালের ৩৩ ভাগ প্রজাতি, ২৫ ভাগ স্তন্যপায়ী আর ১৪ ভাগ পাখির প্রজাতি। ভেবে দেখেছেন কি, খুব শীঘ্রই যদি এতগুলো প্রাণীর প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তাহলে বৈশ্বিক জীববৈচিত্র্য কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে?
সারা বিশ্বে বর্তমানে মাত্র ৭ হাজার চিতাবাঘ রয়েছে এবং এ সংখ্যাটাও ক্রমাগত কমছেই। ১৯৯৩ সালের পর আফ্রিকান সিংহ কমে গেছে প্রায় ৬০ ভাগ। একসময় রাশিয়া আর চীনের দক্ষিণপূর্বাঞ্চল দাপিয়ে বেড়ানো অত্যন্ত সুন্দর আমুর চিতাবাঘ বর্তমানে ১০০টি বেঁচে আছে মাত্র! অতিরিক্ত শিকারের কারণে এরা খুব দ্রুতই নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে তো বিলুপ্তির গতি আরো ভয়াবহ। প্রতি বছরই পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে মোট কীটপতঙ্গের ২.৫ শতাংশ। পৃথিবীর মোট চিহ্নিত কীটপতঙ্গের এক-তৃতীয়াংশই আছে বিলুপ্তির পথে! মানুষ কি তবে পৃথিবীতে একাই বেঁচে থাকবে?
একে গণবিলুপ্তি বলা চলে?
আগের গণবিলুপ্তিগুলোর ইতিহাস পড়লে আমরা জানতে পারি, মাত্র কয়েকশো’ বছরের ব্যবধানে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো জীবিত ৭০/৮০ ভাগ প্রজাতির প্রাণী। সেক্ষেত্রে, বর্তমানে পৃথিবী থেকে যে হারে বিভিন্ন প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে, তাতে একে গণবিলুপ্তির কাল না বলে কোনো উপায় নেই। বিজ্ঞানীদের ধারণা, আগামী কয়েকশো’ বছরের মাঝেই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে অস্তিত্ববান ৭৫ শতাংশ প্রাণী! ৪০০ কোটির অধিক সময় ধরে পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব বিরাজমান আছে। এর মাঝে কেবল সর্বশেষ ৪৫ কোটি বছরেই ঘটেছে বড় বড় ৫টি গণবিলুপ্তির ঘটনা। প্রাকৃতিক কারণে ঘটে যাওয়া সেসব গণবিলুপ্তির ইতিহাস মানুষ এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করে, উচ্চতর গবেষণা করে আর হারিয়ে যাওয়া সেসব প্রাণীবৈচিত্র্যের জন্য আফসোস করে। অথচ নিজেদের অজান্তে মানুষ পৃথিবীতে ৬ষ্ঠবারের মতো গণবিলুপ্তি ঘটিয়ে চলেছে, তার দায় এককভাবেই মানবজাতির।
ভয়াবহ ফলাফল
প্রকৃতিতে অসংখ্য প্রাণী জন্ম নেবে এবং সেগুলো প্রকৃতির নিয়মেই পৃথিবী ত্যাগ করে যাবে, এটাই স্বাভাবিক। মানুষের কোনো অবদান না থাকলেও পৃথিবীতে নিয়মিতভাবে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হতো। কিন্তু প্রকৃতির সেই স্বাভাবিক বিলুপ্তির হারের চেয়ে মানুষের দ্বারা প্রভাবিত বিলুপ্তির হার অত্যন্ত বেশি। কেবল ১৫ শতকের পরবর্তী ৫০০ বছরে পৃথিবী থেকে অর্ধেক মেরুদণ্ডী প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ১৯ শতক থেকে গত ২০০ বছরের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রাণীর বিলুপ্তির হার প্রকৃতির স্বাভাবিক হারের চেয়ে ভৌগোলিক অবস্থানভেদে ১০০-১০,০০০ গুণ বেশি! এই হারে বিলুপ্তি চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই পৃথিবীর বাস্তুসংস্থানগুলো উৎপাদক শূন্য হয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। প্রকৃতির অতি নগণ্য একটি প্রজাতির বিলুপ্তিও কারো কাম্য হতে পারে না, কারণ এর বিলুপ্তিতেই খাদ্যশৃঙ্খলের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ফলে ব্যাপক আকারে প্রাণীর বিলুপ্তিতে বিভিন্ন খাদ্যশৃঙ্খল পুরোপুরি ভেঙে পড়বে, যেগুলোর উপর মানুষও প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল।
সামুদ্রিক প্রাণীদের শতকরা ২৫ ভাগ প্রাণীর বসবাসই পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত প্রবালপ্রাচীরগুলোতে। দুঃখজনকভাবে, পৃথিবীর মোট প্রবালপ্রাচীরের ৫০ ভাগ ইতোমধ্যে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অবশিষ্ট ৫০ ভাগও ২০৫০ সালের মধ্যে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা। আর প্রবাল প্রাচীর ধ্বংস হয়ে গেলে সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থানগুলো কীরূপ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তা ব্যাখ্যা করবার প্রয়োজন নেই। কেউ হয়তো এও ভাবতে পারে যে এসব প্রাণী ধ্বংস হলেও সমস্যা নেই, মানুষ শস্যদানা খেয়ে বেঁচে থাকবে! তাহলে, তাদের জন্যও রয়েছে ভীতিকর সংবাদ। কেননা মানুষ যেসব শস্যদানা আর ফলমূল খায়, সেগুলোও প্রাকৃতিক পরাগায়নের জন্য নির্ভর করে কীটপতঙ্গেরই উপর।
আর কীটপতঙ্গও কোনো না কোনো খাদ্যশৃঙ্খলের আওতাভুক্ত, যেগুলো অন্যান্য প্রাণীর বিলুপ্তির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে দ্রুতগতিতে বিলুপ্ত হচ্ছে কীটপতঙ্গ। বস্তুত, এদের বিলুপ্তির হারই সবচেয়ে বেশি! অন্যদিকে ‘ডি-এক্সটিংশন’ নামক ডিএনএ প্রযুক্তির সাহায্যে বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীদের ফিরিয়ে আনার ভাবনাও সুদূর পরাহত। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সে প্রযুক্তি আসতে অন্তত আরো এক দশক লেগে যাবে। উপরন্তু সেটি অধিকাংশ প্রাণীর ক্ষেত্রেই সফল হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে দাঁড়াচ্ছে এই যে, পৃথিবীতে মানুষের কল্যাণে ৬ষ্ঠ গণবিলুপ্ত চলছে এবং এই বিলুপ্তি মানবজাতির বিলুপ্তির কারণও হয়ে দাঁড়াতে পারে শেষতক! সকল তথ্য-উপাত্ত এবং আশু সমস্যার নমুনা চোখের সামনে থাকার পরও কি সর্বগ্রাসী মানবজাতির টনক নড়বে?