সৌন্দর্যের প্রতীক, ভালবাসার প্রতীক ফুল। বিশ্বে কত ধরনের কত বৈচিত্র্য বর্ণের ফুল ফোটে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সারা বছর জুড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নানা প্রজাতির ফুল ফুটে থাকে। প্রতিটি ফুলেরই নিজস্ব আকার, রঙ এবং গন্ধ থাকে। অধিকাংশ ফুলেরই গড় উচ্চতা তিন-চার ইঞ্চির খুব একটা বেশি নয়। তবে পৃথিবীতে এমন কয়েক প্রজাতির ফুল আছে যার আকার, ওজন এবং গন্ধ সবার চেয়ে আলাদা।
উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা এই প্রজাতির ফুলকে বিশ্বের সবচেয়ে আদিমতম ফুল হিসেবে অভিহিত করেছেন। প্রাচীনকালে এই ফুল বনবাদাড়ে, পাহাড়ের পাদদেশে নিজের খেয়ালে ফুটে থাকতো। আজ সময়ের পরিবর্তনে বন জঙ্গলের কমে যাওয়ার ফলে এসব ফুলের ঠিকানা হয়েছে বিভিন্ন বোটানিক্যাল গার্ডেন। এসব প্রজাতির অনেক ফুলই আজ বিলুপ্তির পথে। তেমনই এক ফুলের প্রজাতি আরুম টাইটান। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম ফুল।
জাপানের টোকিও শহরের জিনদাই বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন বোটানিক্যাল গার্ডেনের শোভা বাড়াচ্ছে আরুম টাইটান নামের এই অদ্ভুত ফুলটি। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় প্রজাতির ফুল। এই ফুলটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সবাই একবাক্যে বলেন, তাক লাগিয়ে দেয়ার মতো ফুলই বটে। পাঁচ বছরে একবার এই গাছে ফুল ফোটে। এই ফুল প্রকৃতির এক বিস্ময়। এর বৈজ্ঞানিক নাম Amorphophallus titanum।
আদি নিবাস
পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আরুম টাইটান বিস্ময়কর ফুল হিসেবে সম্মান পেলেও সুমাত্রার রেইন ফরেস্টে এদের কদর শুধুই বন্য ফুল হিসেবে। আর ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম সুমাত্রা দ্বীপে এই ফুলের আদি নিবাস বলে উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের অভিমত। সুমাত্রায় সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০-১২০০ ফুট উচ্চতার পাহাড়ি অঞ্চলে এই ফুল জন্মাতে দেখা যায়। স্থানীয় মানুষের কাছে এই ফুলের নাম বুঙ্গা বাংকাই। ‘বুঙ্গা’ মানে ফুল আর ‘বাংকাই’ মানে শবদেহ। আজ থেকে ১৪০ বছর আগে ১৮৭৮ সালে ইতালির উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ওদোয়ার্দো বেকারি সুমাত্রায় দীর্ঘ বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের পর প্রথম এই ফুলের হদিশ পান এবং তিনিই প্রথম এই ফুলের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও দেন।
কোথায় হয় এই ফুলের চাষ
এই ফুলের চাষ বেশ কষ্টসাধ্য। সাত থেকে দশ বছর লাগে এই গাছ বেড়ে উঠতে। গাছ বেড়ে ওঠার দুই থেকে তিন বছর লাগে ফুল আসতে, আবার কোনো কোনো গাছে সাত থেকে দশ বছরও সময় লেগে যায়। একবার গাছে ফুল আসার পর পরবর্তী ফুলের জন্য সাধারণত পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হয়। তবে কোনো কোনো আরুম টাইটান গাছে পরপর দুই বছর ফুল এসেছে এমনও প্রমাণ পাওয়া গেছে। বাগানে প্রথম আরুম টাইটানের চাষ শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। ১৮৮৯ সালে ব্রিটেনের কিউ রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে আরুম টাইটান গাছের ১০০টি চারা রোপণ করা হয়।
১৯৩৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বোটানিক্যাল গার্ডেনে আমেরিকার বাগানে ফোটা প্রথম টাইটান ফুল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এই ফুলের চাষ খুব একটা সহজ কাজ নয়। একমাত্র দক্ষ ও প্রশিক্ষিত মালিরাই এই ফুল ফোটাতে পারেন। বর্তমানে বিশ্বের অনেক বড় বড় বোট্যানিক্যাল গার্ডেনে এই ফুলের চাষ করা হচ্ছে। তবে নামকরা কয়েকটি বাগানেই এই ফুল ফুটতে দেখা গেছে। জাপানের জিনদাই বোটানিক্যাল গার্ডেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বোটানিক্যাল গার্ডেন, যুক্তরাজ্যের রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেন, সুইজারল্যান্ডের বাসিল ইউনিভার্সিটির উদ্ভিদ উদ্যানে এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের লুই রিসিয়ার্ডিয়েলো নামক এক বাগানে প্রতি বছর কোনো না কোনো সময় আরুম টাইটান ফুল ফোটার খবর শোনা যায়।চোখের দেখা দেখার জন্য এসব উদ্ভিদ উদ্যানে জড়ো হয় হাজার হাজার মানুষ।
ফুলের বৈশিষ্ট্য
আরুম টাইটান আরেসেই পুষ্পগোত্রের অন্তর্ভুক্ত। বিশাল আকৃতির এই ফুল লম্বায় ৮ ফুট আর চওড়ায় ১০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। ওজনের দিক থেকেও ফুলটি কম আকর্ষণীয় নয়। পঞ্চাশ থেকে নব্বই কেজি হতে পারে একেকটি আরুম টাইটান ফুলের ওজন।
৪৫ বছর পর্যন্ত এই গাছ বেঁচে থাকতে পারে। এই ৪৫ বছরের জীবনকালে মাত্র তিন-চারবারই এর ফুল আসে। জাপানের কিয়োডো সংবাদ সংস্থার খবর থেকে জানা যায়, এই ফুলের আয়ু খুব ক্ষণস্থায়ী। ফুল পরিপূর্ণ হয়ে প্রস্ফুটিত হওয়ার এক-দুদিনের মধ্যেই সেই ফুল ঝরে যায়। বছরের পর বছর অপেক্ষার পর কোনো আরুম টাইটান গাছে যখন ফুল ফোটে তা সত্যিই দর্শনীয় এক ব্যাপার।
ফুলটি পুরোপুরি বিকশিত হতে কয়েক মাস লেগে যায়। দিনে ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত বাড়তে থাকে এই ফুল। পুরুষ টাইটান ফুলগুলো হালকা ক্রিম রঙের হয়ে থাকে আর স্ত্রী ফুলগুলো গোলাপি, কমলা বা বেগুনি রঙ ধারণ করে। টাইটন ফুল পূর্ণ বিকশিত হলে এই ফুল থেকে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হয়, যার ফলে ফুল থেকে বেশ গন্ধ ছড়ায়। এই গন্ধে মাছি, ছোট ছোট কীটপতঙ্গ আকৃষ্ট হয়, যা গাছটির পরাগায়ণের জন্য আদর্শ। সাধারণত বীজ থেকে গাছ জন্মে। এই ফুলের পাতা একক, পাতা প্রায় ২০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। এর পাতা বেড়ে উঠতে ১২-১৮ মাস পর্যন্ত সময় লাগে।
ফুলের গন্ধও বিস্ময় জাগানিয়া
এই ফুল যখন ফোটে তখন তার গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে যায় চারপাশের প্রকৃতি। সেই গন্ধে মাছি, মৌমাছির দল ভিড় করে আসে। কিন্তু আমাদের নাকে সেই গন্ধ গেলে মনে হবে কোথাও বুঝি পচা মাংস রাখা আছে। এমনই বিদঘুটে এই ফুলের গন্ধ। তাই কেউ কেউ একে কর্পস ফ্লাওয়ার বা শবফুলও বলে থাকেন। তবে এই ফুলের সব প্রজাতিই যে এ ধরনের গন্ধ ছড়ায় তা কিন্তু নয়। কোনো প্রজাতি অনেকটা কলার মতো গন্ধ ছড়ায়, আবার কোনোটাতে কচি গাজরের গন্ধও পাওয়া যায়।
বিশ্বের বিভিন্ন বাগানে ফোটা আরুম টাইটান
গত বছর জাপানের জিনদাই বোটানিক্যাল গার্ডেন যে দৈত্যাকার আরুম ফুলটি ফুটেছে, সেটার জন্য বাগান কর্তৃপক্ষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে পাঁচ বছর। তাই সেই ফুল স্বচক্ষে দেখবার জন্য বাগানে ভিড় করেছিলেন হাজার-হাজার জাপানবাসী। জিনদাই বাগানে ফোটা ফুলটির উচ্চতা ছিল সাড়ে ছয় ফুট। ওজন কম করে হলেও ৫০ কেজির কাছাকাছি। তবে এর চেয়েও বড় ফুল ফুটেছে ২০১০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের লুই রিসিয়ার্ডিয়েলোর এক বাগানে। সেখানে ফোটা আরুম টাইটানের ফুলের উচ্চতা ১০ ফুটেরও বেশি।
২০১৪ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর সুইজারল্যান্ডের বাসেল ইউনিভার্সিটির বোটানিক্যাল গার্ডেনে যে টাইটান ফুলটি ফুটেছিল তার উচ্চতা প্রায় সাড়ে ৭ ফুট। তবে বাসেলের এই উদ্ভিদ উদ্যানে ২০১১ সালের এপ্রিলে প্রথমবারের মতো এই ফুলটি ফুটেছিল। তারও আগে ১৯৩৬ সালে সর্বপ্রথম ফুলটি সুইজারল্যান্ডে দেখা যায়।
এই ফুল আজ বিপন্ন প্রজাতির তালিকায়
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বনায়ন ধ্বংসের কারণে এই ফুলের প্রজাতিটি হুমকির মুখে পড়েছে। আর তাই একে বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর এই ফুলের প্রজাতিকে রক্ষা করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারী এবং বেসরকারী বাগানগুলোয় এই ফুলের চাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।
ফিচার ইমেজ- edenproject.com