মরুভূমির বৈচিত্র্যময় প্রাণীদের সন্ধানে

মরুভূমির রুক্ষ পরিবেশে বৈচিত্র্যময় গাছের দেখা যেমন মেলে, তেমনি বৈচিত্র্যময় পশুপাখিরও দেখা পাওয়া যায়। মরুর কঠিন পরিবেশে বেঁচে থাকার জন্য এসব প্রাণী প্রয়োজন মতো নিজেদের অভিযোজিত করে নিয়েছে। এ কারণে দিনের বেলা মরুর প্রচন্ড গরমে বা রাতের তীব্র শীতে কিংবা যে সময়টায় পানি বা খাদ্যের অভাব থাকে, তখন এসব পশুপাখিরা ঠিকই সেই পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। মরুর এমনই কয়েকটি পশুপাখির গল্প শোনাবো আজ। 

উট

মরুভূমির প্রাণীদের কথা বলতে গেলে যে প্রাণীটির কথা প্রথম বলতে হয় সেটি হচ্ছে উট। গরম কাপড় তৈরিতে উটের পশম, জীবন ধারণের জন্য উটের দুধ, মাংস এবং পরিবহনের কাজে মরুভূমির বাসিন্দাদের কাছে উট এক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাণী। মরুর কঠিন পরিবেশেও উট নিজেকে পুরোপুরি মানিয়ে নিতে পারে। চর্বিযুক্ত কুঁজ উটের প্রধান স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য।

মরুভূমির জাহাজ উট; Image Source: animals.howstuffworks.com

মরুভূমিতে এক কুঁজ বিশিষ্ট এবং দুই কুঁজ বিশিষ্ট উট দেখতে পাওয়া যায়। এক কুঁজ বিশিষ্ট উট সাহারা মরুভূমিতে দেখা যায়। এদের কুঁজে ৩৬ কেজি পর্যন্ত চর্বি সংরক্ষিত থাকে। এ ধরনের উটকে ড্রমিডারি উট বলা হয়। মধ্য ও পূর্ব এশিয়ার মরুভূমিগুলোতে দুই কুঁজ বিশিষ্ট উট দেখতে পাওয়া যায়। এদেরকে বেকট্রিয়ান উট বলা হয়। মরুভূমিতে খাবার যখন কম থাকে উটেরা তাদের কুঁজের সঞ্চিত চর্বিকে পানি ও শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এভাবে খাদ্য ছাড়া উট দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারে। শরীর থেকে পানি বাষ্পীভূত হয়ে বের হয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার জন্য তাদের দেহ বিশেষভাবে অভিযোজিত।

দুই কুঁজ বিশিষ্ট বেকট্রিয়ান উট; Image Source: wikimedia commons

মরুভূমির ৪৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমেও তাদের শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয় না। তারা তাদের প্রশস্ত নাক দিয়ে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণে বাইরের বাতাস গ্রহণ করে এবং ভেতরের গরম তাপমাত্রা বের করে দেয়ার মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এভাবে তারা শরীর থেকে পানি বের হয়ে যাওয়া রোধ করতে সক্ষম হয়। এই অভিযোজন ক্ষমতার জন্য উট এক সপ্তাহ পানি না পান করেও চলতে পারে। তারা মাত্র ১৫ মিনিটের কম সময়ে ৪৬ লিটার পর্যন্ত পানি পান করতে পারে। তাদের শরীরের ঘন লোম গরমের দিনে শরীরকে ঠান্ডা রাখতে এবং রাতের তীব্র শীতে শরীরকে গরম রাখতে সাহায্য করে। তাদের লম্বা, শক্তিশালী পায়ের কারণে মরুভূমির বালিতেও তারা সহজে হেঁটে যেতে পারে।  

ফেনেক ফক্স

শিয়াল প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে ছোট প্রজাতি এই ফেনেক ফক্স। মূলত সাহারা মরুভূমিতে এদের দেখা যায়। এরা দৈর্ঘ্যে ২৫-৪০ সে.মি এবং ওজন ১ কেজির কাছাকাছি। এদের গায়ের রঙ মরুভূমির বালির রঙের মতো। তবে তাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অঙ্গটি হচ্ছে লম্বা কান। এদের কান প্রায় ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা। এই লম্বা কানের সাহায্যে তারা দেহের অতিরিক্ত তাপমাত্রা বের করে দিতে পারে।

ফেনেক ফক্স; Image Source: animals.mom.me

আবার রাতের তীব্র শীতের সময় এরা শরীরের তাপমাত্রা ধরে রাখতে পারে। ফলে মরুর প্রচন্ড গরমে এবং রাতের তীব্র শীতেও এরা নিজেদের শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই লম্বা কানের জন্য এদের সাংঘাতিক শ্রবণক্ষমতা। এমনকি কয়েক মিটার দূরের ছারপোকা, পিঁপড়ের আওয়াজও এরা শুনতে পায়। এরা রাতে শিকারে বের হয়। 

ডেথ স্টকার স্করপিয়ন

এরকম বিষাক্ত প্রাণী পৃথিবীতে কমই আছে। এদের আক্রমণে পূর্ণ বয়স্ক মানুষের মৃত্যু না হলেও এর বিষে শরীরের হৃদযন্ত্রের গোলমাল থেকে শ্বাসকষ্টের সমস্যা শুরু হওয়া আশ্চর্য কিছূু নয়। এমনকি এজন্য প্যারালাইসিসও হতে পারে। তবে বর্তমানে এর বিষ থেকে ক্যানসার, ডায়াবেটিসের মতো রোগের ওষুধও তৈরি হচ্ছে। মরুভূমির বিরূপ পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার সব ধরনের বৈশিষ্ট্য এদের আছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিপাক ক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা।

মরুভূমির বিষাক্ত প্রাণী ডেথ স্টকার স্করপিয়ন; Image Source: themysteriousworld.com

মরুভূমিতে যখন খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, তখন এরা তাদের বিপাক ক্রিয়ার কার্যক্রম ধীর করে ফেলে। ফলে বিরূপ পরিবেশে অল্প কিছু পোকামাকড় খেয়েও তারা দিব্যি বছরের পর বছর বেঁচে থাকতে পারে। আর সেই খাদ্য থেকেই তারা নিজেদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় পানি গ্রহণ করে থাকে। তাই ডেথ স্টকার স্করপিয়ন পানির ওপর খুব একটা নির্ভরশীল নয়। মরুভূমির গরমের সময়টাতে তারা পাথর বা কোনো ফাটলের নিচে নিজেদের লুকিয়ে রাখে এবং রাতে শিকারের জন্য বের হয়। তারা সাধারণত মাকড়শা, পিঁপড়া বা ছোট ছোট কীটপতঙ্গ শিকার করে খায়।

হর্নড ভাইপার

উত্তর ও পূর্ব আফ্রিকার মরুভূমির এক বিষাক্ত প্রাণী হর্নড ভাইপার। দীর্ঘাকার এই সাপের চোখের উপর দুটি শিংয়ের মতো থাকায় একে সহজে চেনা যায়। এদের শরীর বেশ ভারী এবং দৈর্ঘ্যে প্রায় ২ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। এদের গায়ের রঙ বালির রঙের মতো এবং শরীরের কোথাও কোথাও ছোপ ছোপ কালো দাগ রয়েছে। ফলে মরুর বালিতে সহজেই নিজের ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে।

মরুভূমির এক বিষাক্ত সাপ হর্নড ভাইপার; Image Source: themysteriousworld.com

দিনের প্রচন্ড গরমে হর্ন ভাইপার বালির অনেক গভীরে নিজেকে লুকিয়ে রাখে, যাতে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এভাবে মরুভূমির প্রচন্ড গরমে নিজেদেরকে রক্ষা করে চলে হর্নড ভাইপার। এরা সাধারণত রাতে শিকার করে। রোডেন্ট এবং লিজার্ড জাতীয় প্রাণী তাদের খাদ্য। হর্নড ভাইপারে বিষের মধ্যে ১৩ ধরনের বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে। তাই এদের কামড়ে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দিতে পারে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।

ডরকাস গ্যাজেল

হরিণ প্রজাতির এই প্রাণীটি সাহারা মরুভূমিতে দেখতে পাওয়া যায়। প্রাণীটি আকারে ছোট এবং এটি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীদের তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এরা সাধারণত দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে পছন্দ করে। এই প্রাণী মরুভূমির জলবায়ুর সাথে নিজেকে পুরোপুরি অভিযোজিত করে নিয়েছে। মরুভূমির তাপমাত্রার তারতম্যের সাথে নিজেকে সহজে মানিয়ে নিতে পারে।

মরুভূমির সবচেয়ে নিরীহ প্রাণী ডরকাস গ্যাজেল; Image Source: eyalbartov.com

এমনকী এরা পানি ছাড়া দীর্ঘদিন বেঁচে থাকতে পারে। দিনের প্রচন্ড গরমে দেহের পানিক্ষয় রোধ করার জন্য তারা দিনের বেলা কোন ছায়াযুক্ত জায়গায় বিশ্রাম নিতে থাকে এবং সারা রাত খাদ্যের অন্বেষণে বের হয়। এরা তৃণভোজী। সাধারণত মরুভূমির গাছপালা খেয়েই এরা জীবনধারণ করে। 

অস্ট্রিচ

অস্ট্রিচ পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম পাখি। একটি অস্ট্রিচ ২.৫ মিটার উঁচু এবং ৭০-১৪৫ কিলোগ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। এদের সাধারণত পশ্চিম এবং মধ্য আফ্রিকার মরুভূমিতে পাওয়া যায়। মরুভূমির বিরূপ পরিবেশেও তারা সহজে মানিয়ে নিতে পারে। মরুভূমির প্রচন্ড তাপমাত্রা এবং পানির অভাব সত্ত্বেও এদের কোনোরকম সমস্যা হয় না। পানি ছাড়াই তারা অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারে। শরীরের পানির অভাব পূরণের জন্য তারা যেসব উদ্ভিদকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে তা থেকেই পানি শোষণ করে নেয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্তম এবং ওজনের পাখি অস্ট্রিচ; Image Source: wikimedia commons

অস্ট্রিচ তার লম্বা গলার সাহায্যে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করতে পারে। অনেক দূর থেকেও সে শত্রুকে চিনতে পারে। অস্ট্রিচ নিরীহ প্রকৃতির পাখি। তাদের দৃষ্টিশক্তি বেশ প্রখর। নিরীহ হলেও শত্রুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষার জন্য তারা পায়ের সাহায্যে আক্রমণ করে। মরুর বালিতে কোনো রকম অসুবিধা ছাড়াই তারা সহজে দৌড়াতে পারে। পাখি হলে কী হবে! তারা কিন্তু উড়তে পারে না। তারা সাধারণত গাছের পাতা, গাছের শিকড় এবং বীজ খেয়ে জীবনধারণ করে।

থর্নি ড্রাগন

মরুর ছদ্মবেশী রাক্ষস থর্নি ড্রাগন; Image Source: redditblog.com

ছোট প্রাণীটি ঠিক যেন এক ছদ্মবেশী রাক্ষস। এরা স্পঞ্জের মতো নিজেদের গা দিয়ে জল শুষে নিতে পারে। এরা ২০ সে.মি. পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পুরো শরীরে সূঁচালো কাঁটার মতো অংশ রয়েছে। এর সাহায্যে নিজেদের নানা বিপদ থেকে রক্ষা করে। এরা ১৫-২০ বছর বেঁচে থাকতে পারে। পুরুষ থর্নি ড্রাগনের চেয়ে নারী থর্নি ড্রাগন আকারে বড় হয়ে থাকে। প্রয়োজন মতো তারা তাদের দেহের রঙ পরিবর্তন করতে পারে।

ফিচার ইমেজ- animals.sandiegozoo.org

Related Articles

Exit mobile version