যুগ যুগ ধরে ফুল মানুষকে মুগ্ধ করে এসেছে। ফুলের রঙ, সৌন্দর্য, গন্ধ মানুষকে করেছে আকৃষ্ট। ফুল শব্দটি শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে গোলাপ, বেলি, রজনীগন্ধা ইত্যাদি নানা সুন্দর সুগন্ধযুক্ত ফুল। এসব ফুলের ঘ্রাণ পাগল করে আমাদের। নানা আচার অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয় ফুল। প্রিয়জনকেও ফুল উপহার দেওয়ার প্রচলন আমাদের মাঝে অনেক পুরোনো। তবে পৃথিবীতে এমন কিছু ফুল রয়েছে, যার গন্ধ অতি জঘন্য। এসব ফুলের সৌন্দর্য দেখে কাছে গেলে নিজ থেকেই আপনি হাত দিয়ে নাক চেপে ধরতে বাধ্য হবেন। কারণ এসব ফুলের গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসতে পারে আপনার। চলুন আজকে জেনে নিই বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গন্ধযুক্ত এমনই ৯টি ফুলের সম্পর্কে।
৯. এরিস্টোলোসিয়া জাইগানটিয়া
যদি কোনো বাগানের মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় আপনি তীব্র ইঁদুরের বিষ্ঠা কিংবা পঁচা মলের গন্ধ পান, তবে সে বাগানে হয়তো এই ফুলটি রয়েছে। এরিস্টোলোসিয়া জাইগানটিয়া (Aristolochia Gigantia) নামের এই ফুলটি ‘ব্রাজিলিয়ান ডাচম্যান’স‘ পাইপ নামেও পরিচিত। এর তীব্র বাজে দুর্গন্ধের জন্য ফুলটি বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গন্ধময় ফুলের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।
ব্রাজিলের স্থানীয় এই ফুলগাছটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ৮ থেকে ১০ ফুট লম্বা হয়ে থাকে। ফুলের বাজে গন্ধের কারণে মাছি, প্রজাপতি ও নানা পোকা এর দিকে আকৃষ্ট হয়। এসব পোকার মাধ্যমে পরাগায়ন হয় এই ফুলের। ফুলটির চকচকে পাপড়ি দেখে যে কেউ ফুলটির ঘ্রাণ নিতে চাইবে। কিন্তু ভুল করে একবার এর ঘ্রাণ নিলেই আর কোনোদিন কেউ আসবে না এর পাশে!
৮. ওয়েস্টার্ন স্কাঙ্ক ক্যাবেজ
ওয়েস্টার্ন স্কাঙ্ক ক্যাবেজের বৈজ্ঞানিক নাম লাইসিচিটন অ্যামেরিকানাস (Lysichiton americanus)। আমেরিকার স্থানীয় এই উদ্ভিদটি সাধারণত স্যাঁতসেঁতে, ভেজা জলাভূমি ও কাঠযুক্ত স্থানে জন্মায়।
‘জলাভূমির লন্ঠন’ নামেও পরিচিত এই ফুল গাছটির রয়েছে বড় সবুজ পাতা। ফুলের রঙ হয় সাধারণত হলুদ। এই ফুল ফুটলে এর থেকে তীব্র একধরনের দুর্গন্ধ বের হয়। ফুলের আশেপাশের এলাকাও এই বাজে গন্ধে ভরে যায়। এমনকি শুকিয়ে যাওয়া ফুল থেকেও এই বাজে গন্ধ নির্গত হয়। এই ফুলের গন্ধ আমেরিকার কাঠবেড়ালি জাতীয় প্রাণী ‘স্কাঙ্ক’য়ের শরীর থেকে নির্গত দুর্গন্ধময় পদার্থের মতো বলে একে ‘স্কাঙ্ক ক্যাবেজ’ নাম দেওয়া হয়েছে।
৭. হাইডনোরা আফ্রিকানা
পরজীবী এই উদ্ভিদটিকে দক্ষিণ আফ্রিকার অনুর্বর শুকনো মরুভূমিতে দেখতে পাওয়া যায়। এই উদ্ভিদের দেহে কোনো ক্লোরোফিল না থাকায় এটি সাধারণত মাটির নিচে জন্মায়। শুধুমাত্র ফুলটি ফোটার পর মাটির উপরে উঠে আসে।
ফুল ফুটলে ফুলের পাপড়ির স্পঞ্জের মতো উপরিভাগ থেকে তীব্র গোবরের গন্ধ বের হয়। এমন গন্ধের পেছনে অবশ্য একটি কারণ রয়েছে। এই গাছের পরাগায়নের প্রধান মাধ্যম হলো গুবরেপোকা। এই গাছের তীব্র গোবরের গন্ধ গুবরেপোকাকে আকৃষ্ট করে। ফলে গুবরে পোকা ও অন্যান্য বিভিন্ন পোকা এই ফুলে এসে বসে। এভাবে এই ফুলের পরাগায়ন হয়। প্রথমে এটিকে বিজ্ঞানীরা একটি ফাংগাস ভেবে ভুল করেছিলেন। পরে জানা যায় এটি আসলে একটি ফুলযুক্ত উদ্ভিদ।
৬. স্টাপেলিয়া জাইগানটিয়া
সুন্দর তারা আকৃতির এই ফুলটি হয়তো আপনাকে এর কাছে আকৃষ্ট করবে, কিন্তু এই ফুলের কাছাকাছি গেলেই এর দুর্গন্ধে আপনি পালিয়ে আসতে বাধ্য হবেন। ‘ব্যাঙের গাছ’ নামেও পরিচিত এই ফুলটি দক্ষিণ পূর্ব আফ্রিকার একটি স্থানীয় ফুল। এটি মূলত এক ধরনের ক্যাকটাস। এই ফুল ফুটলে তা থেকে পচনধরা মাংসের গন্ধ বের হয়।
ফুল ফুটলে এর পাঁচটি পাপড়ির জন্য একে তারার মতো দেখায়। ফুলের ব্যাস প্রায় ৩৫ সেন্টিমিটার হয়ে থাকে। ফুলের রং সাধারণত হলুদ কিংবা লালচে হয়। ফুল ফুটলে এর রং ও গন্ধ মাছিদের আকৃষ্ট করে। এরাই এই ফুলের পরাগায়ন ঘটায়। দেখতে সুন্দর বলে বাজে গন্ধ সত্ত্বেও অনেকে এটি বাসাবাড়িতে লাগিয়ে থাকেন। তবে এটি সাধারণত খোলামেলা জায়গায় লাগানো হয়, যাতে বাতাসে এর গন্ধ চলে যেতে পারে।
৫. অরাম ডিসকর্ডিস
সুন্দর ভেলভেটের কচু ফুলের মতো দেখতে এই ফুলগুলো সাধারণত সাইপ্রাস, গ্রীস, মধ্যপ্রাচ্য প্রভৃতি স্থানে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এই গাছের পাতার রঙ হয় গাঢ় সবুজ। দেখতে আকর্ষণীয় এই ফুল ফুটলে তা থেকে তীব্র দুর্গন্ধ বের হয়। গোবর ও পঁচা মৃতদেহের গন্ধ একত্রে মেশালে যে গন্ধটি হয়, ঠিক তেমন গন্ধ বের হয় এই ফুল থেকে।
ফুলের গাছটি গ্রীষ্মকালে সাধারণত সুপ্ত অবস্থায় থাকে এবং বসন্তকালে তাতে ফুল ধরে। রৌদ্রোজ্জ্বল ও হালকা ছায়াযুক্ত স্থানে এই গাছ ভালো জন্মে। বিখ্যাত গ্রীক উদ্ভিদবিদ পেডানিয়াস ডায়োসকরিডেসের নাম অনুসারে এই ফুলের নামকরণ করা হয়েছে।
৪. ড্রাকুনকুলুস ভাল্গারিস
‘ড্রাগন অরাম’ ও ‘ভুডু লিলি’ নামে পরিচিত এই ফুলটি এর চেহারা ও গন্ধের জন্য বিখ্যাত। বলকান ও তুরস্কের কিছু অঞ্চলে জন্মায় এই ফুলের গাছ। আকর্ষণীয় গোলাপি রঙের পাপড়িযুক্ত এই ফুলে রয়েছে বেগুনি রঙের একটি মঞ্জুরি।
এই ফুল সাধারণত এর তীব্র মৃত পঁচা লাশের গন্ধের জন্য পরিচিত। পঁচা এই দুর্গন্ধের জন্য প্রচুর মাছি সবসময় এই ফুলের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে, যার মাধ্যমে এই ফুলের পরাগায়ন ঘটে।
৩. বুলবোফাইলাম ফেলাইনোপসিস
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গন্ধময় অর্কিড হলো বুলবোফাইলাম ফেলাইনোপসিস। নিউগিনি দ্বীপের স্থানীয় ফুল এটি। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই অর্কিডটিতে বছরে শুধুমাত্র একবার ফুল ফোটে।
ফুল ফোটার পর ফুল থেকে পঁচা মাংসের গন্ধ বের হয়। ফুল সাধারণত লোমশ হয়ে থাকে। গাছে থোকায় থোকায় গোলাপি লাল রঙের এই ফুল ধরে। তীব্র দুর্গন্ধ ছাড়াও এই ফুল গাছটি এর লম্বা পাতার জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। ৪ ফুটেরও বেশি লম্বা হয় এই অর্কিডের পাতা।
২. র্যাফেলশিয়া আরনল্ডি
র্যাফেলশিয়া আরনল্ডি হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ফুল। দেখতে বড় ও আকর্ষণীয় হলেও এই ফুলের রয়েছে তীব্র দুর্গন্ধ। এই পরজীবী উদ্ভিদটি শুধুমাত্র বোর্নিয় ও সুমাত্রার রেইনফরেস্টে পাওয়া যায়। এই গাছের কোনো পাতা কিংবা শেকড় নেই। পঁচা গলিত মাংসের মতো তীব্র গন্ধের জন্য এই ফুল বিশেষভাবে পরিচিত। সাধারণত এই ফুলের ব্যাস হয় প্রায় ১ মিটার এবং ভরে হয় প্রায় ১১ কেজি! র্যাফেলশিয়ার পঁচা গন্ধে আকৃষ্ট মাছির মাধ্যমে এই ফুলের পরাগায়ন হয়ে থাকে।
বিরল প্রজাতির এই উদ্ভিদটি খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। এই ফুলটির মোট ৫টি পাপড়ি থাকে। ফুলটি হয় লাল রঙের এবং এর উপর সাদা রঙের ছোপ ছোপ দাগ দেখতে পাওয়া যায়। অন্যান্য গাছের মতো এই গাছের দেহে কোনো ক্লোরোফিল না থাকায় এটি নিজের খাদ্য নিজে তৈরি করতে পারে না। তাই অন্য গাছের থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে বেঁচে থাকে এই উদ্ভিদ।
১. টাইটান অরাম
বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গন্ধময় ফুল হলো টাইটান অরাম। এই ফুলটি ‘লাশ ফুল’ (Corpse flower) নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এই ফুলটি একক কোনো ফুল নয়। এটি আসলে একটি পুষ্পবিন্যাস, যাতে থাকে শত শত, এমনকি হাজার হাজার ছোট ছোট ফুল। চওড়ায় এই ফুল সাধারণত ১০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। ফুলের রঙ হয় কালচে লাল মাংসের মতো।
মধ্য সুমাত্রা ও ইন্দোনেশিয়ার কিছু স্থানে জন্মানো এই ফুল থেকে মৃত পচনশীল মানবদেহের তীব্র গন্ধ বের হয়। ফুলের কাছে আসলে আপনার মনে হবে আপনি কোনো পঁচা গলা লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এজন্যই এটি ‘লাশ ফুল’ নামে পরিচিত। প্রায় ১২ ঘন্টা পর্যন্ত এই ফুলের তীব্র পঁচা গন্ধ আশেপাশের এলাকার ছড়িয়ে থাকে। তবে ভালো খবর হলো, এই ফুলটি চার থেকে পাঁচ বছর পর মাত্র একবার ফোটে এবং ফোটার পর ২৪-৪৮ ঘন্টা পর্যন্ত তাজা থাকে!
ফিচার ইমেজ – twitter.com