শীতের আমেজের সাথে সাথে হাজার হাজার অতিথি পাখির আগমনে প্রতি বছর মুখরিত হয় বাংলাদেশ। প্রতি বছর শীতকালে সাইবেরিয়া, মঙ্গোলিয়া, তিব্বতীয় মালভূমি ও হিমালয় থেকে প্রায় ৩০০ প্রজাতির পাখি আসে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়াকে এরা বেছে নেয়। সেইসাথে এ দেশের অগভীর নদীনালা, খাল, হাওর থেকে তাদের খাদ্যের চাহিদা মেটায়। প্রতি বছর অক্টোবর থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত এ দেশের বনজঙ্গল আর জলাভূমিগুলো বাসভূমিতে পরিণত হয় এসব অতিথি পাখিদের। অতিথি পাখিরা যেমন উপযুক্ত আবহাওয়া আর খাদ্যের সন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে স্থানান্তরিত হয়ে এদেশে আসে ঠিক তেমনই পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলছে অন্যান্য পশুপাখিদের স্থানান্তরিত হবার ঘটনাও। ছোট পোকা থেকে শুরু করে বিশাল নীল তিমি সকলেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তরিত হচ্ছে খাদ্য, বাসস্থান, বংশবৃদ্ধিসহ নানা কারণে।
পাখিরা প্রধানত বসবাসের উপযুক্ত আবহাওয়া আর খাদ্যের প্রাচুর্য আছে এমন জায়গার খোঁজেই স্থানান্তরিত হয়। শীতকালীন প্রতিকূলতা শুরু হলে তারা তুলনামূলক উষ্ণ অঞ্চলের দিকে চলে যায়। আর্কটিক টার্ন প্রজাতির পাখিরা প্রায় সারাবছরেই পৃথিবীর এক মেরু থেকে আরেক মেরুর দিকে উড়ে বেড়ায় উষ্ণ অঞ্চলের খোঁজে। উত্তরে আর্কটিক অঞ্চলে যখন প্রবল শীত তখন দক্ষিণে এন্টার্কটিকের উদ্দেশ্যে ধাবিত হয় যেখানে গ্রীষ্ম কেবল শুরু। ধারণা করা হয় এক বছরে প্রায় ২৫,০০০ মাইল পথ জুড়ে তারা স্থানান্তরিত হয়।
পাখিরা যে পথ অনুসরণ করে উড়ে চলে তাকে বলা হয় ফ্লাইওয়ে। এরা কীভাবে এই ফ্লাইওয়ে অনুসরণ করে সারা বছর দিক নির্ধারণ করে তা বিজ্ঞানীদের কাছে এখনও সুস্পষ্ট না। ধারণা করা হয় এদের অভ্যন্তরীণ জিপিএস (Global Positioning System) রয়েছে যা প্রতিবার গতিপথে একই প্যাটার্ন মেনে চলতে সহায়তা করে। এক্ষেত্রে সূর্য ও তারা অনুসরণ করে থাকে। পাখিরা ওড়ার পথে ভূমিতে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যও (landmarks) চিনতে পারে বলে অনেকে ধারণা করেন। পাখিদের অসাধারণ দিক নির্ধারণ ক্ষমতার ক্ষেত্রে কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কাজ করে থাকে। চোখ এবং মস্তিষ্কের এক বিশেষ অংশের মিথস্ক্রিয়ার সাহায্যে উত্তর দিক নির্ধারণ করতে পারে। অন্তঃকর্ণে থাকা সামান্য পরিমাণ লৌহের মাধ্যমে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করতে পারে। ঘ্রাণশক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গা চিনতে পারে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে পাখিরা তাদের ঠোঁটে থাকা স্নায়ু ব্যবহার করে পৃথিবীর সাথে পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের তৈরি হওয়া কোণ নির্ণয় করে যেকোনো স্থানে নিজেদের অবস্থান ঠিক করতে পারে।
মনার্ক প্রজাতির প্রজাপতি তিন প্রজন্ম ধরে প্রায় ৫ মাসে মেক্সিকো থেকে কানাডাতে যায়। চতুর্থ প্রজন্ম আবার মেক্সিকোতে ফিরে আসে। এভাবে ৪ প্রজন্মব্যাপী একটি স্থানান্তর চক্র সম্পন্ন করে। এরপর আবার শুরু করে। কোনো ধরনের দিক নির্দেশনা ছাড়াই নিজেদের সহজাত বৈশিষ্ট্য থেকে সূর্য ও পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র অনুসরণ করে তারা পথ নির্ণয় করে। মস্তিষ্কে একধরনের প্রোটিন তৈরি করে তারা সূর্যের অবস্থান নির্ণয় করতে পারে। একধরনের ইলেকট্রনিক ট্যাগ ব্যবহার করে এই বহু প্রজন্ম স্থানান্তর বিষয়ে গবেষণা করা হয়।
প্রতিবছর প্রায় ১০ লক্ষ ওয়াইল্ডেবিস্ট এবং ২ লক্ষ জেব্রা তানজানিয়া এবং কেনিয়ার মধ্য দিয়ে প্রায় ৩০০ মাইল পথের চক্র অনুসরণ করে যার মধ্যে কিছু বিপদজনক অঞ্চলও তাদের অতিক্রম করতে হয়। মৌসুমি বৃষ্টি অনুসরণ করে তারা সবুজ তৃণক্ষেত্রের সন্ধানে যায়। বিজ্ঞানীদের ধারণা মাটির ঘ্রাণ এর সাহায্যে তারা দিক নির্ধারণ করে।
নারী স্পার্ম তিমিরা (sperm whale) তাদের তরুণদের নিয়ে খাদ্যের সন্ধানে উষ্ণতর পানিতে ঘুরে বেড়ায়। অন্যদিকে পুরুষ তিমিরা আর্কটিকের শীতল পানিতে থাকে। প্রতি বছর তাদের আটলান্টিক সাগরে মিলিত হতে হয়।
লাল কাঁকড়ারা সমুদ্রে ডিম পাড়ে যা লার্ভা থেকে ছোট ছোট কাঁকড়ায় পরিণত হয়ে তীরে আসে। সেখান থেকে তারা খাদ্যের সন্ধানে স্থানান্তরিত হয়। পরবর্তীতে ডিম পাড়ার জন্য তারা আবার সমুদ্রে ফিরে আসে।
দিক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পশুপাখিদের যেহেতু দিক নির্ণায়ক কম্পাস, মানচিত্র, রাস্তাচিহ্ন অথবা জিপিএস নেই সেক্ষেত্রে তাদের কিছু ভিন্ন বৈচিত্র্যময় পন্থা অবলম্বন করতে হয়। কোনো কোনো প্রাণী জিনগতভাবে তাদের পূর্ব প্রজন্ম থেকে এসব স্থানান্তরের দিক নির্ণায়ক ক্ষমতা পেয়ে থাকে। কোনো কোনো প্রাণী ভূমিতে বিভিন্ন নদীনালা, পাহাড় ইত্যাদি মনে রেখে পথ খুঁজে বের করতে পারে। স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দিক নির্ণয়ের বিষয়টি কোনো কোনো প্রজাতিতে সহজাতভাবেই থাকে।
চন্দ্র-সূর্য, নক্ষত্রের অবস্থান দেখেও দিক নির্ণয় করে থাকে। ধ্রুবতারাসহ উজ্জ্বল তারাগুলো কোনো কোনো পশুপাখি চিনতে পারে। ম্যালার্ড প্রজাতির হাঁস এভাবে উত্তর দিক খুঁজে বের করে। ঘ্রাণ ব্যবহার করে দিক নির্ধারণ করে কেউ কেউ। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র প্রাণীদের দিক নির্ধারণে বিশেষ ভূমিকা রাখে। জলচর প্রাণীরা স্রোতের দিক অনুসরণ করে বিভিন্ন জায়গায় যায়। প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমেও দিক নির্ণয়ে সহায়তা করে। তিমিরা এভাবে শব্দ তৈরি করে নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে অন্যদের জানায়।
পশুপাখিদের মধ্যে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে কিছু কারণ রয়েছে বা বিশেষ কিছু সময়ে তারা বুঝতে পারে যে স্থানান্তরের সময় হয়েছে। দিন ও রাতের সময়ের হ্রাস-বৃদ্ধি তার মধ্যে একটি। দিন বড় হওয়া মানে সূর্য বেশি সময় ধরে থাকে, এসকল স্থানে তাপমাত্রা বেশি হয়। আর দিন ছোট হওয়া মানে তাপমাত্রা কমে যাবে। এভাবে তাপমাত্রার পরিবর্তন থেকে আবহাওয়া শুষ্ক এবং রুক্ষ হয়ে যায় যা প্রাণীদের স্থানান্তরের জন্য ইঙ্গিত দেয়। খাদ্য ও পানির অভাব থেকে প্রাণীরা এগুলোর সন্ধানে ভ্রমণ করে। শরীরে চর্বির পরিমাণ কমে গেলে কোনো কোনো প্রাণী নতুন খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। স্থানান্তরের ক্ষেত্রে দেহের সারকাডিয়ান ছন্দও (Circardian rhythm) বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর মাধমে তারা বুঝতে পারে কখন স্থানান্তর হতে হবে।
প্রতি বছর ডিসেম্বরের শুরুতে হাজার হাজার জেব্রা উত্তরের নামিবিয়া থেকে প্রায় ২৪০ কি. মি. পথ অতিক্রম করে দক্ষিণে বোতসোয়ানাতে Nxai Pan National Park এ যায় তৃণভূমির সন্ধানে। দুই মাস পর আবার একই পথে নামিবিয়াতে ফেরত আসে।
হাতিরা সাধারণত অল্প দূরত্বে ভ্রমণ করে থাকে। কিন্তু এক হাতির দল সবাইকে অবাক করে মায়ানমারের বর্ডারের কাছে চীনের Xishuangbanna National Nature Reserve থেকে প্রায় ৫০০ কি. মি. পথ অতিক্রম করে কুনমিংয়ে পৌঁছেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন গ্রাম আর শহরে তাদের দেখা মিলেছে। এখন হাতিগুলো আবার ফেরত যাচ্ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
পশুপাখির স্থানান্তরের পথে বিভিন্ন বাধার সৃষ্টি করছে মানুষ। তাদের স্থানান্তরের পথে রাস্তা, আবাদি জমি নির্মাণ বা খাদ্যের যোগান ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে তা কমিয়ে দাওয়া বা বিলুপ্ত করার মাধ্যমে। প্রাণীদের স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিপত্তি হচ্ছে খাদ্যের অভাব। খাদ্যের অভাবের কারণে ভ্রমণে থাকা প্রাণীদের মৃত্যুর হার ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশে অতিথি পাখি শিকার এবং পাখিদের বাসস্থানে মানুষের বাড়িঘর ও আবাদি জমি নির্মাণ প্রচলিত আছে।
পশুপাখি সংরক্ষণের জন্য তাদের বাসস্থানের আশেপাশে বেড়া নির্মাণ করতে হবে, তাদের স্থানান্তরের পথে প্রয়োজনীয় ব্রিজ ও টানেল তৈরি করতে হবে, বিশেষ বিশেষ সমুদ্রসৈকত সংরক্ষণ করতে হবে।
পশুপাখি জগতের স্থানান্তরের ঘটনাগুলো পৃথিবীতে প্রাণের বৈচিত্র্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। তাই মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণীর সুষ্ঠু সহাবস্থানের জন্য মানুষকে অনেক যত্নবান হতে হবে।