ঘুম বিষয়টি নিয়ে আমরা সবসময়ই কমবেশি আলোচনা বা চিন্তা-ভাবনা করি। বিশেষত বর্তমান গৃহবন্দি দিনগুলোতে যেহেতু অনেকেরই চিরাচরিত রুটিনের পাশাপাশি ঘুমের চক্রের পরিবর্তন ঘটেছে, এবং সে কারণে কেউ প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আবার কেউ কম ঘুমাচ্ছেন, তাই ঘুমের প্রসঙ্গটাও দৈনন্দিন আলোচনায় তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই যেন এসে পড়ছে।
কিন্তু খেয়াল করে দেখবেন, ঘুম বিষয়ক আলোচনাটা সবসময় আমাদের নিজেদের নিয়ে, অর্থাৎ মানুষের ঘুম সংক্রান্ত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। অথচ ঘুমের ওপর তো মানুষের একচেটিয়া আধিপত্য নেই। জীবজগতের প্রায় সকল জীবজন্তুই ঘুমিয়ে থাকে। কই, তাদের ঘুম নিয়ে কি আমরা কখনো ভাবি? কখনো কি জানতে চেয়েছি আমাদের পোষ্য জীবগুলোর ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে কি না? সেটি যদি ব্যক্তিগত স্বার্থে জেনেও থাকি, চিড়িয়াখানার জন্তুগুলো কতটুকু ঘুমায়, কিংবা আমাজন জঙ্গলের জীবজন্তুদের ঘুম কেমন হয়, এগুলো আমাদের জিজ্ঞাস্য নয়।
হয়তো সংখ্যাগরিষ্ঠের ক্ষেত্রেই উপর্যুক্ত বিবৃতি সত্য, তবে এমন কেউ কেউও নিশ্চয়ই আছেন, যারা জীবনে অন্তত একবার না একবার মানুষ ভিন্ন অন্যান্য জীবজন্তুর ঘুম নিয়ে ভেবেছেন। কিংবা এই মুহূর্তেও অনেকের মনেই প্রথমবারের মতো আগ্রহ জন্মে থাকতে পারে। তাদের সেই আগ্রহই পূরণের চেষ্টা করব আজ।
প্রথমেই জানা দরকার, একটি প্রাণী কেন ঘুমায়? হ্যাঁ, ক্লান্তি দূর করে চাঙ্গা হয়ে ওঠার ব্যাপারটি তো রয়েছেই। এর পাশাপাশি স্মৃতিশক্তিকে রিফ্রেশ করতে, কিংবা পূর্বে অর্জিত অভিজ্ঞতা থেকে নতুন জ্ঞান আহরণ করতে তাকে সাহায্য করে থাকে ঘুম। অর্থাৎ বুঝতেই পারছেন, ঘুমের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে প্রাণীর মস্তিষ্কের। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, আরইএম (র্যাপিড আই মুভমেন্ট) ঘুমের।
আরইএম ঘুম বলতে বোঝায় স্তন্যপায়ী প্রাণী এবং পাখিদের ঘুমের একটি অনন্য পর্যায়কে, যখন বন্ধ অবস্থায়ও চোখের গতিবিধি এলোপাথাড়ি বা দ্রুততর হয়ে ওঠে, শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায়, সাময়িকভাবে শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়, এবং মস্তিষ্ক এত বেশি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে যে, সেটি মাঝেমধ্যে প্রাণীর জাগ্রত অবস্থাকেও ছাপিয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, প্রাণী স্বপ্নও দেখে ঘুমের এই বিশেষ দশাতেই।
আরইএম ঘুমের প্রয়োজনীতা প্রাণীর মস্তিষ্কের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত একটি প্রাণীর মস্তিষ্কের আকৃতি যত বড় হয়, তার আরইএম ঘুমের চাহিদাও হয় তত বেশি। তাছাড়া প্রাণীর ঘুমের ভঙ্গি ও কৌশল নির্ভর করে ওই প্রাণীর পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রজাতির উপরও।
সময়ের সাথে সাথে সব প্রাণীরই ঘুমের ভঙ্গি ও কৌশলের বিবর্তন ঘটে। যেসব প্রাণী ঘুমের মধ্যে আক্রমণের শিকার হবার আশঙ্কা থাকে, তারা সাধারণত তাদের ঘুমের প্রবণতা পরের প্রজন্মকে কম হস্তান্তর করে। এর ফলে ওইসব প্রাণীর প্রতিটি নতুন প্রজন্মের ঘুমের ধরন হয় আলাদা আলাদা, নিজেদেরকে শিকারীর আক্রমণ থেকে রক্ষার কৌশলের উপর ভিত্তি করে।
যেমন ধরুন পানিতে বাসকারী ভোঁদড়রা ঘুমের সময় একে অন্যের হাত ধরে রাখে, কিংবা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে, যাতে তারা পানিতে ভেসে থাকতে পারে। বড় ভোঁদড়রা ছোট ভোঁদড়কে রক্ষার জন্য এ কাজটি বেশি করে। আবার কিছু কিছু মানুষ যেমন বিছানায় সন্তান বা সঙ্গীর সাথে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে ঘুমায়, একই কাজ করে থাকে গরু বা ভেড়ার মতো যূথবদ্ধ প্রাণীরাও, যেন ঘুমন্ত অবস্থায় অতর্কিত হামলার কবলে পড়লে তারা একাট্টা হয়ে সেটির মোকাবিলা করতে পারে।
মাংসাশী ও তৃণভোজীর ঘুমের তফাৎ কতটা?
যেমনটি আগেই বলেছি, ভিন্ন ভিন্ন প্রাণীর ঘুমের ভঙ্গি ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভীতি: হোক সেটি আক্রমণের শিকার হবার, কিংবা যেকোনো অজানা বিপদের। আবার যদি প্রাণী নিজেই আক্রমণকারী হয়, সেক্ষেত্রেও তার ঘুমে কিছু নিজস্বতার ছাপ থাকে।
সাধারণত তৃণভোজীদের তুলনায় মাংসাশী প্রাণীরা বেশি ঘুমায়। যেমন সিংহ সারাদিন এবং সারারাতই ছোট ছোট স্পেলে ঘুমিয়ে থাকে। এর কারণ তারা শক্তি সঞ্চয় করে রাখতে চায়, যেন যখনই শিকার বা খাবার পাওয়া যায়, তারা সেটিকে নিজের করে নেয়ার পেছনে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করতে পারে।
আবার একটি প্রাণী কতটুকু খায়, তার উপরও তার ঘুমের সময় নির্ভর করে। যেসব প্রাণীর খাবারে ক্যালরির পরিমাণ কম থাকে, তারা ঘুমায়ও তুলনামূলক কম। তবে এর কারণ এই না যে বেশি ক্যালরির খাবার খেলে ঘুম বেশি হয়। বরং যেসব প্রাণীর খাবারে ক্যালরি কম থাকে, তাদেরকে বেশি সময় ব্যয় করতে হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার খুঁজে বের করতে, যা তাদেরকে প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেবে। তাই জিরাফ বা হাতির মতো বৃহদাকার তৃণভোজী প্রাণীরা দিনে মাত্র ৩০ মিনিট থেকে কয়েক ঘণ্টা ঘুমায়।
কোন প্রাণীরা সবচেয়ে বেশি ঘুমায়?
অনেকেই ভেবে থাকতে পারেন, শ্লথগতির প্রাণীরা সবচেয়ে বেশি ঘুমায়। এটি সর্বৈব ভুল ধারণা। গতি কম বলেই যে একটি প্রাণী অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে কম ঘুমাবে, তা কখনোই নয়। একটি কচ্ছপ হয়তো দিনে ১৪ ঘণ্টার মতো ঘুমায়, তবে একটি গড়পড়তার কুকুরও কিন্তু দিনে সমপরিমাণ ঘুমায়।
চলুন দেখে নিই কোন প্রাণীরা দিনে সবচেয়ে বেশি ঘুমায়:
বড় লোমশ আরমাডিলো: ২০.৪ ঘণ্টা
ছোট ইঁদুর: ২০.১ ঘণ্টা
বাদামি বাদুড়: ১৯.৯ ঘণ্টা
উত্তর আমেরিকান অপোসাম: ১৮ ঘণ্টা
পাইথন: ১৮ ঘণ্টা
নিশাচর বানর: ১৭ ঘণ্টা
ছোট প্রাণী মানে কম ঘুম, আর বড় প্রাণী মানে বেশি ঘুম?
যেসব প্রাণী অপেক্ষাকৃত ছোট, এবং অনেক সময়ই বৃহত্তর প্রাণীদের শিকার হিসেবে বিবেচিত হয়, যেমন হরিণ বা ভেড়া, তারা প্রতিরাতে তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে থাকে। তাই বলা হয়ে থাকে, ক্ষুদ্রতর প্রাণীরা কম ঘুমায়। তবে সবসময়ই যে এ বিষয়টি ধ্রুব সত্য, তা কিন্তু নয়।
যেমন ধরুন সিন্ধুঘোটকের কথা। এটি কিন্তু আকারে বেশ বড় একটি প্রাণী, তারপরও এর খুব বেশি ঘুমের প্রয়োজন হয় না। মাঝেমধ্যে এটি না ঘুমিয়ে একটানা ৮৪ ঘণ্টাও জেগে থাকতে পারে। এটি ফেরিঞ্জিলে (শ্বাসনালী ও খাদ্যনালীর মিলনস্থল) বাতাস ভরে রাখে, যেন ঘুমের মধ্যেও এটি পানিতে ভেসে থাকতে পারে। আবার এটি বরফ পৃষ্ঠেও দাঁত কামড়ে ঝুলে থাকতে পারে। কখনো এটি দাঁড়িয়ে, আবার কখনো শুয়ে ঘুমায়। অতি কম তাপমাত্রায়ও এরা দিব্যি ঘুমাতে পারে।
আরো একটি বড় প্রাণী হলো হাতি, যেটি খুব বেশিক্ষণ ঘুমায় না। এই দৈত্যাকার প্রাণীটি দিনে সর্বোচ্চ দুই থেকে চার ঘণ্টা ঘুমায়, আর বাদবাকি সব খাবার (তৃণলতা) চিবোতে থাকে। সাধারণত এটি দাঁড়িয়েই ঘুমায়, তবে মাঝেমধ্যে বড় উইয়ের ঢিবি বা গাছের গায়ে হেলান দিয়েও ঘুমিয়ে থাকে। পাশ ফিরে বা কাঁত হয়ে হাতি খুব কমই ঘুমায়, বড়জোর আধাঘণ্টা বা তার কম, যাতে এর নিজের শরীরের চাপেই আভ্যন্তরীণ কোনো অঙ্গহানি না ঘটে।
কোনো কোনো প্রাণী আবার ঘুমায় না বললেই চলে। যেমন ধরুন ব্যাঙের কিছু প্রজাতি। এরা মাসের পর মাস না ঘুমিয়ে কাটাতে পারে। শুধু কখনো কখনো চোখ বুজে একটু বিশ্রাম নিয়ে নেয়। এই উভচর প্রাণীদের শরীরের গঠনতন্ত্রে এমন এক ধরনের গ্লুকোজ বিদ্যমান, যা এদের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোকে অধিক শীতে জমে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। ফলে যখন সাময়িকভাবে এদের হৃৎকম্পন বন্ধ হয়ে যায় এবং এরা শ্বাস নিতে পারে না, তখনো টিকে থাকতে পারে। এ কারণেই আমরা দেখতে পাই শীতের বিদায়ের পর বসন্তের আগমন ঘটলেই ব্যাঙেরা “বেঁচে উঠছে”।
প্রাণীরা দাঁড়িয়ে ঘুমায় কেন?
যেমনটি বলেছি আগেই, জিরাফ দিনে মাত্র ৩০ মিনিট ঘুমিয়েও বেঁচে থাকতে পারে। এদিকে ঘোড়া ঘুমায় মাত্র দুই ঘণ্টা। এই প্রাণীরা ১৫ মিনিট বিরতিতে ঘুমায়, এবং কাজটি তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই করতে পারে। দাঁড়িয়ে ঘুমানো ছাড়া তাদের উপায়ও অবশ্য নেই।
বিশাল শরীর ও লম্বা ঘাড় নিয়ে তাদের জন্য বসা বা শোয়া যেমন কঠিন, একবার বসলে বা শুয়ে পড়লে ওঠাও সমান কঠিন। যেহেতু যেকোনো সময় তারা শত্রুর আক্রমণের শিকার হতে পারে, তাই বিবর্তনের ফলেই তারা দাঁড়িয়ে ঘুমানো এবং দিনভর ছোট ছোট ‘পাওয়ার ন্যাপ’ নেয়াকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে।
কিন্তু এভাবে দাঁড়িয়ে ঘুমানোর একটি বড় সমস্যা হলো, এভাবে ঘুমালে আরইএম দশা অর্জন করা যায় না। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে এরাও বসতে বা শুতে বাধ্য হয়।
পাখির কিছু প্রজাতিও দাঁড়িয়ে ঘুমায়, তবে তাদের দাঁড়িয়ে ঘুমানোর কারণ ভিন্ন। তারা দাঁড়িয়ে ঘুমায় স্রেফ এ কারণে যে, শুয়ে ঘুমানোর মতো স্বস্তিদায়ক বিছানা তারা খুঁজে পায় না। ডানা পায়ের রগের সাথে বেঁধে, পাটিকে গাছের শাখা বা ডাল দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরে তারা ঘুমায়।
শীতনিদ্রা বা গ্রীষ্মনিদ্রা কীভাবে কাজ করে?
কিছু কিছু প্রাণী শীত বা গ্রীষ্মের পুরোটা সময় ঘুমিয়ে কাটায়। এর মূল কারণ শক্তি সঞ্চয় করা। শীতকালীন ঘুমকে বলে হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রা। গ্রীষ্মকালীন ঘুমকে বলে এস্টিভেশন বা গ্রীষ্মনিদ্রা। আবার কিছু প্রজাতির প্রাণী তো প্রায় প্রতিদিনই এমন দশায় চলে যায়, যেমন আমেরিকান ব্যাজার কিংবা মোটা লেজের অপোসাম।
দিনের আকৃতি, খাদ্যের জোগান, তাপমাত্রা; এই তিনটি বিষয় মূলত প্রাণীদেরকে সঙ্কেত দেয় যে তাদের এখন শীতনিদ্রা বা গ্রীষ্মনিদ্রায় যাবার সময় হয়েছে কি না। যখন তারা ঘুমের এই বিশেষায়িত দশায় চলে যায়, তখন তাদের রক্তসঞ্চালনের মাত্রা, মস্তিষ্কের ক্রিয়াশীলতা এবং হৃৎকম্পন ধীরগতির হয়ে যায়।
মনে রাখতে হবে, সাধারণ ঘুমের থেকে এই বিশেষায়িত ঘুম কিন্তু একেবারেই আলাদা। যখন প্রাণীরা এই বিশেষ দশায় যায়, তখন তারা লম্বা সময় ধরে খাবার না খেয়ে কিংবা শরীরের বর্জ্য অপসারণ না করেও কাটিয়ে দিতে পারে।
কিছু কিছু ভাল্লুক সন্তান জন্মদানের জন্য শীতনিদ্রা থেকে উঠে আসে, আবার সন্তান জন্ম দিয়েই ফের শীতনিদ্রায় চলে যায়। সদ্যজাত সন্তান নিজে নিজেই বড় হতে থাকে, জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে মাতৃস্নেহ ছাড়াই। তবে প্রাণীদের এই কৌশলও বেঁচে থাকার জন্য অতি জরুরি। যখন খাদ্যের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়, তখন সজাগ থাকলে খাদ্যাভাবেই মারা পড়তে হবে। তারচেয়ে ঘুমিয়ে থাকাই কি শ্রেয় নয়?
স্তন্যপায়ীদের ঘুম কেমন?
সাধারণত অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণীর ঘুম মানুষের মতোই। তাদের ঘুমের মধ্যে তিনটি পৃথক পর্যায় বিদ্যমান: হালকা ঘুম, গভীর ঘুম, এবং আরইএম ঘুম। তবে ঘুমের পরিমাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য দেখা যায়। আরমাডিলো কিংবা অপোসাম দিনের ১৮ ঘণ্টার মতো ঘুমিয়ে কাটায়, যেখানে ঘোড়া কিংবা জিরাফ ঘুমায় ছয় ভাগের এক ভাগ সময়। মানুষ অবশ্য এই দুই শ্রেণীর মাঝামাঝি পর্যায়ে পড়ে; একজন গড়পড়তা মানুষ রাতে সাত থেকে নয় ঘণ্টা ঘুমায়।
বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণী দিনে কয়েকবার ঘুমায়। এ ধরনের ঘুমকে বলে পলিফেজিক ঘুম। প্রজাতিভেদে প্রাণী দিনে বা রাতে ঘুমায়, যদিও দিবাচর প্রাণীরা রাতের বেলাতে আর নিশাচর প্রাণীরা দিনের বেলা ঘুমাতে পছন্দ করে।
প্রাইমেটরা দিনে একবার ঘুমায়। বানর আক্রমণকারীর থেকে রক্ষা পেতে ঋজুভাবে বসে ঘুমায়, যদিও গরিলা বা শিম্পাঞ্জি শুয়ে ঘুমানোকেই বেছে নেয়। তারা সবাই গাছে একটা বাসস্থানের মতো করে নেয়, ঠিক মানুষের বিছানার মতো। তাদের এই বিছানাগুলো তাদেরকে গাছের উঁচুতে থাকতে সাহায্য করে, যেন আক্রমণকারী বা বিরক্তিকর পোকামাকড়ের উপদ্রব এড়ানো যায়। এর ফলে তাদের আরইএম ঘুমটা মোটামুটি নিরুপদ্রবভাবে সম্পন্ন হয়, এবং অবধারণগত উন্নতি ঘটে, যা অন্যান্য অনেক প্রজাতির প্রাণীর থেকে তাদেরকে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রাখে।
জলবাসী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ঘুমের স্বরূপ অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। যেমন বলা যায় ডলফিন বা সিলের কথা। তারা জলে বাস করে, কিন্তু শ্বাসগ্রহণের জন্য জলের উপরিভাগে চলে আসে। তাই ঘুমন্ত অবস্থায় এদের শ্বাসরোধের আশঙ্কা থাকে। এ থেকে বাঁচতে তারা সবসময় মস্তিষ্কের একাংশ সজাগ রেখে ঘুমায়। অর্থাৎ মস্তিষ্কের একভাগ ঘুমের মধ্যেও ক্রিয়াশীল থাকে, ফলে প্রাণীটি এক চোখ দিয়ে দেখতে পায়, শ্বাসগ্রহণ করতে পারে, এমনকি চলাফেরাও চালিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের ঘুমকে বলে ইউনিহেমিসফেরিক ঘুম।
কিছু ক্ষেত্রে ডলফিন ঘুমন্ত অবস্থায় জলের উপর ভেসে থাকতে পারে। এ প্রবণতাকে বলা হয় ‘লগিং’। বিজ্ঞানীদের মতে, কিছু ডলফিন এমনকি চক্রাকারে সাঁতার কাটার সময়ও ঘুমিয়ে থাকে। আরেকটি গবেষণায় উঠে এসেছে, ডলফিন নাকি ইউনিহেমিসফেরিক ঘুমের এমন মাত্রা অর্জন করেছে যে, এখন ঘুমন্ত অবস্থায়ও তারা জটিল সব কাজ সম্পাদনে সক্ষম।
সদ্যজাত অরকা তিমি এবং তাদের মা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত না ঘুমিয়ে কাটাতে পারে। আবার স্পার্ম তিমি একদম ঋজুভাবে ঘুমায়, এবং তারা একটি মস্তিষ্ক সজাগ রেখেও ঘুমায় না। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে এই তিমিরাই সবচেয়ে কম ঘুমায়।
পাখিরা কীভাবে ঘুমায়?
আমরা জানি, বছরের নির্দিষ্ট সময়ে কিছু পাখি দেশান্তরী হয়। এই সময়টায় তারা নিরলসভাবে একটানা উড়ে যেতে পারে। দেশান্তরের সময়টা কতটুকু দীর্ঘায়িত হবে তা প্রজাতিভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয় বটে, তবে কিছু পাখিকে একটানা কয়েক মাসও উড়তে হয়। যেমন আল্পাইন সুইফটের দেশান্তরের পর্যায় ২০০ দিন পর্যন্ত হয়। জলচর স্তন্যপায়ীদের মতো কিছু কিছু দেশান্তরী পাখিও এক মস্তিষ্ক সজাগ রেখে ঘুমাতে পারে। ফলে লম্বা সময় তারা বিরতিহীনভাবে উড়ে চলতে পারে।
গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের ফ্রিগেট পাখিদের উপর চালানো একটি গবেষণা থেকে উঠে এসেছে, তারা নাকি দিনের পুরোটা সময় সজাগ ও সতর্ক থাকে। রাতের বেলা যখন তারা উড়তে শুরু করে, ঠিক তখনই তারা একবারে কয়েক মিনিট করে হালকা পর্যায়ের ঘুম ঘুমিয়ে নেয়, যাকে বলে স্লো ওয়েভ ঘুম। এ সময়ে তাদের মৃদু আরইএম ঘুমও হয়, এবং তাদের মাথা তখন নিচু হয়ে যায়। অবশ্য এমনটি হাতেগোনা কয়েকবারই কেবল হয়, যাতে তাদের ওড়ার পদ্ধতিতে কোনো বাধা না আসে।
কিছু পাখি, যেমন সোয়েইনসন থ্রাশ, মার যাওয়া ঘুম পুষিয়ে নিতে মাঝেমধ্যে ‘পাওয়ার ন্যাপ’ নেয়। আবার কিছু পাখি আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করে ঘুমায়। যেমন হাঁস একসারিতে ঘুমায়। মজার ব্যাপার হলো, সারির মধ্যবর্তী হাঁসগুলো দুই চোখ বন্ধ করে ঘুমালেও, সারির দুই প্রান্তের হাঁসগুলো এক চোখ খোলা রেখে ঘুমায়। এ থেকে বোঝা যায়, দুই প্রান্তের হাঁসগুলোও ইউনিহেমিসফেরিক ঘুম ঘুমায়, যাতে করে তারা সবসময় পাহারা দিতে পারে, এবং সম্ভাব্য আক্রমণকারীর হাত থেকে নিজের দলকে রক্ষা করতে পারে।
সরীসৃপরা কীভাবে ঘুমায়?
সরীসৃপদের ঘুমের প্রকৃতিতে অনেক বৈচিত্র্য রয়েছে। টিকটিকি যে ঘুমের চক্রের মধ্য দিয়ে যায়, তা মাত্র ৮০ সেকেন্ড দীর্ঘায়িত হয়, যেখানে মানুষের ক্ষেত্রে তা ৭০ থেকে ১০০ মিনিট। এক রাতে টিকটিকির এমন ঘুমের চক্র থাকে প্রায় ৩৫০টি, যেখানে মানুষের থাকে মাত্র চার থেকে পাঁচটি।
সরীসৃপদের সেরেব্রাম বা গুরুমস্তিষ্ক থাকে না। আর বিজ্ঞানীরা ইতঃপূর্বে ভাবত, আরইএম ঘুম বুঝি কেবল উচ্চ বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণীর ক্ষেত্রেই ঘটে। তবে একটি সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, অস্ট্রেলিয়ান বেয়ার্ডেড ড্রাগনের নাকি আরইএম ঘুম হয়।
আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের চোখ বন্ধ থাকে, যাতে করে চোখের পাতা আমাদের চোখকে সুরক্ষিত ও আর্দ্র রাখতে পারে। এদিকে সাপের মতো প্রাণীদের থাকে স্বচ্ছ ত্বক, যা চোখের পাতার কাজ করে। কিন্তু যেহেতু সেগুলো আলোকভেদ্য, তাই সহজে বোঝা যায় না একটি সাপ ঘুম নাকি সজাগ। কেবলমাত্র একটি সাপ পুরোপুরি সোজা হয়ে থাকলেই অন্য কেউ বুঝতে পারে যে সাপটি আসলেই ঘুমিয়ে আছে।
মাছের ঘুম কেমন হয়?
একটি মাছ যখন ঘুমায়, তখন তাকে ঠিক তেমন দেখায়, যেমন একটি মানুষকে দেখতে লাগে দিবাস্বপ্ন দেখার সময়। মাছটিকে তখন একদম স্পন্দনহীনভাবে জলাধারের নিচে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তবে কিছুক্ষণ পরপর তারা পাখনা ঝাড়া দেয়, যাতে তারা স্থির ও ভাসমান থাকতে পারে।
মাছের ঘুম তাদের পরিবেশ ও কাজের পরিমাণের উপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। যেমন অ্যাকুরিয়ামে যে মাছ বাস করে, সেটি ওই ঘরের বা ভবনের আলো জ্বলা-নেভার উপর ভিত্তি করে নিজের ঘুমের চক্রকে সাজিয়ে নেয়।
এদিকে হাঙ্গরের সবসময় নিজের ফুসফুসে অবাধ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হয়। তাই ঘুমের মধ্যেও তারা বাধ্য হয় সাঁতার কাটতে। এজন্য তারা ঘুমন্ত অবস্থায়ও চোখ বন্ধ করে না, কিংবা আরইএম ঘুমে প্রবেশ করে না।
জেব্রা মাছের ক্ষেত্রে একটি খুবই আগ্রহোপদ্দীপক ব্যাপার আবিষ্কৃত হয়েছে। এই অদ্ভূর ধরনের মাছটি অনেক সময় ঠিক মানুষের মতোই ইনসমনিয়ায় ভোগে। বিজ্ঞানীরা কিছু মাছকে বাধ্য করেছিল কম ঘুমাতে, এবং তারপর দেখা গেছে ইনসমনিয়া রোগীদের মতোই ওই মাছগুলোরও প্রাত্যহিক ঘুমের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে। আবার প্যারটফিশ নামক একটি মাছের ক্ষেত্রে দেখা গেছে ঘুমের সময় সেটির শরীর থেকে জেলির মতো তরল পদার্থ নিঃসৃত হয়, যা তাকে সুরক্ষিত রাখে।
ঘুমের অভাব কি প্রাণীকুলে প্রভাব ফেলে?
হ্যাঁ, কিছু কিছু প্রাণী সত্যিই মারা যেতে পারে দীর্ঘ সময় ধরে না ঘুমানোর ফলে। বিশেষত ইঁদুরের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণী, এবং কিছু পোকামাকড়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে দীর্ঘদিন না ঘুমানোর ফলে তাদের মৃত্যু ঘটেছে। তবে এটি খুঁজে বের করা একটু মুশফিল যে ঘুমের অভাবে মানুষের যেসব অবধারণগত ক্ষতি হয়ে থাকে, প্রাণীদের ক্ষেত্রেও তা হয় কি না। ঘুম ঠিকমতো না হলে প্রাণীরাও সারাদিন অবসাদ্গ্রস্ত থাকে কি না, সেটিও বলা কঠিন।
কোনো প্রাণী কি আছে যারা ঘুমায় না?
সব প্রাণীকেই, এমনকি পোকামাকড়কেও, অবশ্যই ঘুমাতে হবে। এমনকি নিম্ন বুদ্ধিমত্তার প্রাণী, যাদের মস্তিষ্ক খুব ছোট বা একেবারেই নেই, তাদের জন্যও ঘুম আবশ্যক। অবশ্য তাদের ক্ষেত্রে ঘুমের প্রকৃতি মানুষ বা অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের থেকে ভিন্ন। এই নিম্নগোত্রীয় প্রাণীরা হয়তো কিছু সময়ের জন্য নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, কিংবা উদ্দীপনায় কম সাড়া দেয়।
ফ্রুট ফ্লাইয়ের উপর করা একটি গবেষণা থেকে দেখা গেছে, মানুষের মস্তিষ্কে যেমন ঘুমের সময় বিভিন্ন জৈবরাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, সেগুলো ওই মাছি পোকার মস্তিষ্কেও ঘটে।
তাই বলা যায়, বিবর্তনের ফলেই প্রাণিজগতের সকল প্রাণী এখন এমন একটি অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে, টিকে থাকার জন্য তাদের যেকোনো রূপের ঘুম অবশ্যই প্রয়োজন।