আমাদের জানা পৃথিবীর সবচেয়ে গভীর জায়গাটি হলো মারিয়ানা ট্রেঞ্চ। মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ থেকে দক্ষিণ-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরতম ট্রেঞ্চের নাম ‘মারিয়ানা’। এর সর্বোচ্চ গভীরতা এগারো হাজার মিটার অর্থাৎ মাউন্ট এভারেস্টের উচ্চতার চেয়েও এর গভীরতা দুই হাজার মিটার বেশি! বিখ্যাত গিরিখাত গ্রান্ড ক্যানিয়নের দৈর্ঘ্যে আর গভীরতায় এ ট্রেঞ্জটি পাঁচ গুণ বৃহৎ।
সূর্যের আলোর ক্ষমতা নেই মারিয়ানার তলা পর্যন্ত পৌঁছাবার, কেননা আমরা জানি, সূর্যের আলো সমুদ্রের গভীরে মোটামুটি হাজার মিটার পর্যন্ত পৌছাতে পারে। আবার এর গভীরতায় পানির চাপ সমুদ্রপৃষ্ঠের স্বাভাবিক চাপেরও প্রায় হাজার গুণ। মানুষ নির্মিত যেকোনো কিছুই তাই সে চাপে বিধ্বস্ত হয়ে যাবার কথা। অন্যদিকে এর তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। এতসব অদ্ভুতুড়ে বৈশিষ্ট্য নিয়ে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সভ্য পৃথিবীর কাছে এক রকম অধরাই ছিলো বহু বছর যাবত।
১৯৪৮ সাল নাগাদ ব্রিটিশ নেভির একটি সার্ভে জাহাজ ‘এইচ.এম.এস চ্যালেঞ্জার ২’ মারিয়ানা ট্রেঞ্চ আবিষ্কার করে। বহু বছর ধরে অধরা থাকার পর আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জানতে শুরু করি মারিয়ানা ট্রেঞ্চ সম্পর্কে। বিজ্ঞানীরা এক ধরণের বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করছেন এ সমুদ্রতল গবেষণার কাজে। এ যন্ত্রগুলোকে বলা হয় রিমোটলি অপারেটেড ভেহিক্যাল বা আরওভি অর্থাৎ এ যন্ত্রকে গবেষণাগারে বসেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এ যন্ত্রের সাথেই যুক্ত থাকে লাইট আর ক্যামেরা, যা সমুদ্রতলের সেই বিশাল চাপ মোকাবেলা করতে সক্ষম। প্রযুক্তির এই কল্যাণ আর বিজ্ঞানীদের অপরিসীম পরিশ্রমে আবিষ্কার হওয়া সেই অদ্ভুতুড়ে পরিবেশে বাস করা ততোধিক অদ্ভুত প্রাণীদের দেখে আমাদের স্তব্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। মারিয়ানা ট্রেঞ্চের অদ্ভুত সেসব প্রাণীদের নিয়েই আজকের আলাপ।
সার্কাস্টিক ফ্রিঞ্জহেড (Sarcastic Fringehead)
আজকের আলোচনার প্রথম প্রাণীটি হলো সার্কাস্টিক ফ্রিঞ্জহেড। আকারে খুব বেশি বড় হয় না এরা, বড়জোর দশ কি বারো ইঞ্চি। কিন্তু আকারে ক্ষুদ্র হলে কী হবে, এদের দস্যিপনার দরুন এদের নামটি অমন, সার্কাস্টিক (sarcastic)! এদের আক্রমণের ধরন যেমন অভিনব, তেমনি ভয়ঙ্কর। আকারে ক্ষুদ্র বলে অনাহূত কারো উপস্থিতি টের পেলেই অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার বিশালাকার হা করে আক্রমণ করে বসে ফ্রিঞ্জহেড।
আবার দুটো ফ্রিঞ্জহেডের মধ্যে গণ্ডগোল বাধলে তারা মুখ বিশাল হা করে একে অপরের মুখে বসিয়ে দেয়, যেন মনে হয় তারা চুম্বনে ব্যস্ত আছে! কিন্তু আসল ঘটনা একেবারেই ভিন্ন! ফ্রিঞ্জহেড সমাজে একটা ব্যাপার অঘোষিতভাবে ঠিক হয়ে আছে যে, যার মুখ বড় সে তত বেশি ক্ষমতাবান! ওরা তাই মুখ দুটো একত্র করে মেপে নেয়, কার মুখ বড় আর কারটা ছোট।
ফ্রিল্ড শার্ক (Frilled Shark)
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে যেসব নগণ্য সংখ্যক প্রাণী এখনও টিকে আছে, ফ্রিল্ড শার্ক তাদের মধ্যে অন্যতম। সৃষ্টি থেকে আজ অবধি তার পরিবর্তন খুবই সামান্য, তাই অনেকে একে জীবন্ত ফসিলও বলে থাকেন। উনিশ শতকে আবিষ্কৃত হওয়া এ মাছগুলো বিখ্যাত হয়ে আছে এদের দাঁতের কারণে। মুখভর্তি এদের দাঁত একেবারের চোয়ালের শেষ খাঁজ পর্যন্ত বিছানো। পঁচিশ পাটিতে কম হলেও ৩০০টি দাঁত সাজানো এদের! এরা লম্বায় মোটামুটি ছয় ফুট পর্যন্ত হতে পারে। শিকারকে ধরাশায়ী করতে পারলে মুখে ভেতরই পিষে মেরে গিলে ফেলে, খানিকটা সাপের মতো।
ব্যারেল আই ফিস (Barreleye Fish)
ব্যারেল আই নামের এই মাছটি সম্পর্কে আমরা প্রথম জানতে পারি ১৯৪০ সালের দিকে। এদের বাস সমুদ্রের মোটামুটি আড়াই হাজার মিটার গভীরে। এদের মাথাটি ট্রান্সপারেন্ট বা স্বচ্ছ। আর তাতে বসানো আছে ব্যারেল আকৃতির দুটো চোখ যা সাধারণত উপরের দিকে তাক করে থাকে। এদের চোখের অভিনব বৈশিষ্ট্য হলো তা চারদিকে আলো ছড়িয়ে যায়! বিজ্ঞানীদের ধারণা, স্বচ্ছ মাথা এদের চোখকে এই বৈশিষ্ট্য পেতে সাহায্য করেছে।
এখনও পর্যন্ত আমরা খুব বেশি কিছু জানি না এই মাছটি সম্বন্ধে। বিজ্ঞানীরা আজও এর জীবনচক্র এবং বংশবিস্তার পদ্ধতি সম্পর্কে কোনো হদিস পাননি।
ডিপ-সি ড্রাগনফিস (Deep-sea Dragonfish)
ডিপ-সি ড্রাগনফিস গভীর সমুদ্রের ভয়ঙ্কর শিকারী প্রাণীদের অন্যতম। কঙ্কালহীন শরীরে ওদের আকারের তুলনায় দাঁতগুলো অতিমাত্রায় বড় বড়। দেখতে হিংস্র হলেও ওরা লম্বায় হয় মাত্র পনেরো সেন্টিমিটার। বায়োলুমিনেসেন্স পদ্ধতিতে নিজেদের শরীরে আলো তৈরি করতে পারে ওরা। চিবুকের কাছাকাছি ওদের এক বিশেষ অঙ্গ আছে, এর নাম ফটোফোর। এই ফটোফোরের সাহায্যেই ওরা আলো তৈরি করে শিকারকে বোকা বানায় কিংবা বিপরীত লিঙ্গের কাউকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করে।
ডাম্বো অক্টোপাস (Dumbo Octopus)
ডিজনির বিখ্যাত চরিত্র ডাম্বোর কথা মনে আছে? সেই ডাম্বো হাতির বাস্তব রূপ যেন এই ডাম্বো অক্টোপাস। অক্টোপাসের যত প্রজাতি আছে, তার মধ্যে ডাম্বো অক্টোপাস স্বভাবতই সবচেয়ে গভীরে বাস করে। এরাও নিজের শরীরে আলো তৈরি করতে পারে। উপায় কী! সূর্যের আলো না পৌঁছালে আলোর ব্যবস্থা কিছু একটা তো করতেই হয়! শিকারকে পুরোপুরি গিলে খেতেই ভালোবাসে এরা।
হ্যাচেট ফিস (Hatchetfish)
খানিকটা কুঠারের মতো দেখতে বলে ওদের নাম দেওয়া হয়েছে হ্যাচেট ফিস বা কুঠার মাছ। এরা বিভিন্ন আকারের হতে পারে। তবে সাধারণত এক থেকে ছয় ইঞ্চির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এদের একটি বিশেষ গুণ হলো এরা ক্যামোফ্লাজ করতে পারে, অর্থাৎ আশেপাশের পরিবেশ অনুযায়ী ছদ্মবেশ ধারণ করতে পারে। ডাম্বো অক্টোপাস এবং ডিপ-সি ড্রাগনের মতো এরাও বায়োলুমিনেন্সের মাধ্যমে নিজেদের শরীরে আলো জ্বালতে পারে।
অ্যাঙলার ফিস (Anglerfish)
অ্যাঙলার নামের এই মাছকে মানুষ জীবন্ত খুব কমই দেখেছে। কারণ ওদের বাস সমুদ্রের একেবারে তলদেশে। ওদের পুরুষেরা স্ত্রীদের চেয়ে আকারে বেশ খানিকটা ছোট হয়ে থাকে। ওদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অদ্ভুত যে বিষয়টি তা হল ওদের বংশবিস্তার পদ্ধতি। এরা স্ত্রী এবং পুরুষ একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে একটি একক সত্তা গঠন করে এবং তার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি করে। মিলনের সময় পুরুষ অ্যাঙলার মাছটি যখন স্ত্রী অ্যাঙলারের সাথে একীভূত হতে শুরু করে, তখন সে নিজের চোখ, পাখা, দাঁতসহ আরো বেশ কিছু অঙ্গ হারিয়ে স্ত্রীটির শরীরে পরজীবীর মতো বাস করে এবং ওভাবেই বংশবিস্তারের কাজ সম্পন্ন করে। পুরুষ অ্যাঙলার সর্বসাকুল্যে মোটে ৩ সে.মি. পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে স্ত্রী অ্যাঙলার হয় ১৮ সে.মি. পর্যন্ত।
টেলিস্কোপ অক্টোপাস (Telescope Octopus)
আটটি কর্ষিকাবিশিষ্ট টেলিস্কোপ অক্টোপাস অদৃশ্য হয়ে থাকে প্রায়শই। এর নামে টেলিস্কোপ শব্দটি যুক্ত হবার কারণ এর টিউবুলার চোখ। এ অদ্ভুত চোখটি ওদের লম্বা স্টকে বসানো থাকে আর স্টকের প্রতিটি অঙ্গই নিজেদের জায়গা পরিবর্তন করতে পারে। তাই আশেপাশের সবদিকের উপর নজর রাখা এই টিউবুলার চোখটির জন্য খুব সহজ হয়ে যায়। এই চোখের বদৌলতে অনেক শিকারী প্রাণীর হাত থেকে ওরা বাঁচতে পারে। অদৃশ্য বা প্রায় অদৃশ্য হবার ক্ষমতাও ওদের সে কাজটি আরও অনেক সহজ করে দেয়।