সকল প্রাণীর মাঝে প্রেম-ভালবাসা বিরাজমান। মানুষ যেমন মানুষকে ভালবাসে তেমনি প্রাণীরাও প্রাণীদের ভালবাসে। আবার কিছু কিছু ভালবাসা হয় মানুষ ও প্রাণীর মাঝে। এতে মানুষ ভালবেসেছে প্রাণীকে। আবার কোনো কোনো সময় প্রাণী ভালবেসেছে মানুষকে। এই ভালবাসায় মানুষের মতো স্মৃতিশক্তি হয়তো প্রাণীদের নেই। তাই তারা স্মরণে রাখতে পারে না কারও উপকার কিংবা ভালবাসার কথা। তবে কিছু কিছু প্রাণী, মানুষের ভালবাসার প্রতিদান দিয়েছে। আজকের লেখায় এমনই কিছু ভালবাসার কথা জানবো যেখানে মানুষ ও প্রাণী তাদের ভালবাসার মূল্য দিতে জীবনও বাজী রেখেছে।
জেলে ও পেঙ্গুইনের ভালবাসা
প্রেম-ভালবাসা জাতি-কূলের ধার ধারে না। তবে ভালবাসা হয় দুটি স্বজাতীয় বিপরীত লিঙ্গের প্রতি, মা-বাবার ভালবাসা সন্তানের প্রতি, সন্তানের ভালবাসা প্রকাশ পাবে পিতামাতার প্রতি এটাই স্বাভাবিক। তবে ব্রাজিলের রিওডি জেনিরোতে ভালবাসার এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। এখানে ভালবেসে ৫,০০০ মাইল সাগর পথ পাড়ি দিয়ে একটি উড়তে অক্ষম পেঙ্গুইন তার জীবন রক্ষাকারী মানব বন্ধুর কাছে ছুটে আসে। মানব বন্ধু বললে হয়তো ভুলই হবে। কারণ বন্ধু পেঙ্গুইনটিকে নিজের সন্তানের মতোই মনে করেন ও ভালবাসেন। তাই পেঙ্গুইনের মানব পিতা বললে বোধহয় ভুল হবে না।
ভালবাসার সূচনা হয় ২০১১ সালে। একদিন ৭১ বছর বয়সী জোয়াও পেরেইরা ডি সৌজা, রিওডি জেনিরোর একটা দ্বীপে দেখেন একটি পেঙ্গুইন পালকে তেল দ্বারা লেপ্টে গিয়ে ডুবোডুবো অবস্থায় মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে।
পেশায় অবসরপ্রাপ্ত রাজমিস্ত্রী ও খণ্ডকালীন জেলে, সৌজা পেঙ্গুইনটিকে উদ্ধার করে তার পালকে লাগা আঠালো তেল পরিষ্কার ও সেবা-শুশ্রুষা করে সুস্থ করে তোলেন। সুস্থ হলে পেঙ্গুইনটিকে মুক্ত করে দেয়ার সময় নাম রাখেন ডিনডিম। ডিনডিম চলে যায় গভীর সাগরে।
কিন্তু কয়েক মাস পর সৌজা বিস্মিত হয়ে যান। তিনি দেখেন ডিনডিম তার কাছেই ফিরে এসেছে! শুধু তা-ই নয়, পেঙ্গুইনটি সৌজার সাথে হাঁটাচলা করলেও ভিন্ন কেউ কাছে যেতে পারে না। অন্য কেউ ডিনডিমকে স্পর্শ করতে গেলে ঠোকর দিত সেটি। সৌজা বলেন, “আমি পেঙ্গুইনটিকে নিজের সন্তানের মতো ভালবাসি। আমি মনে করি পেঙ্গুইনটিও আমাকে ভালবাসে।”
ডিনডিম টানা ৮ মাস থাকে সৌজার কাছে। শুধুমাত্র প্রজননের সময় আসলে কয়েক মাসের জন্য অার্জেন্টিনা ও চিলির গভীর সমুদ্রের দিকে চলে যায়। প্রথমবার ফিরে আসার পর আবার চলে গেলে লোকজন ভাবত বোধহয় আর ফিরে আসবে না। কিন্তু পেঙ্গুইনটি ৪ বছর ধরে ফিরে এসেছে। এই ভালবাসার কাহিনী ২০১৬ সালে বিশ্বের বড় বড় মিডিয়ায় সাড়া ফেলেছিল।
কথা হচ্ছে, আইনানুযায়ী পেঙ্গুইনকে ঘরে পোষার বিষয়টি তো ছিল অবৈধ। তাহলে ডিনডিমের কী হবে? তবে কি তাকে সৌজার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল সেখানকার প্রাণী ও পরিবেশবিদরা? আসলে এ ভালবাসা যে ছিল পিতাপুত্রের মতোই। তাই এদের বন্ধন ভাঙ্গার চেষ্টা করেনি কেউই।
কাক ও তার মানব পরিবার
উপকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার মানসিকতা মানুষের মাঝে থাকাটা অস্বাভাবিক নয়। মানুষ হয়তো নানাভাবে উপকারের প্রতিদান দিয়ে থাকে। আর পশুপাখিরা নানাভাবে দিতে না পারলেও এমন কিছু কাজ করে যেখানে মানুষের প্রতিদান ও ভালবাসাকেও হার মানায়। ভালবেসে তারাও জয় করে নেয় মানুষের মন। এমনই একটি ভালবাসার খোঁজ মেলে রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা কলেজ মোড়ে রাজমিস্ত্রি আশরাফ আলীর ঘরে।
কাক ও একটি মানব পরিবারের ভালবাসার ঘটনাটি ২০১০ সালে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল, যেখানে কাকটি অন্যান্য গৃহপালিত পাখির চেয়েও বেশি আদুরে আচরণ করে মানব পরিবারটির সাথে। শুধু তা-ই নয়, কাকটি কথাও বলতে পারতো! আশরাফ আলীর পরিবার কাকটিকে নিজেদের বাকি দুই মেয়ে আশা ও উষার মতোই মনে করতেন। করাটাই স্বাভাবিক। কারণ কাকটি যে তার অন্য দুই মেয়ের মতোই “আম্মু আম্মু” বলে ডেকে ওঠে! এছাড়াও বেশ কিছু শব্দ উচ্চারণ করতে পারে সেটি। তারা কাকটির নাম রাখেন কামিনী।
ভালবাসার সূত্রপাত হয় মিডিয়া ও জনমানুষের মাঝে সাড়া ফেলার ৬ বছর পূর্বে। একদিন আশরাফ আলীর স্ত্রী ঝড়ে আহতাবস্থায় পড়ে থাকা কামিনীকে আশ্রয় দেন ঘরের চালে। তার ধারণা ছিল মা কাক এসে বাচ্চাটিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু দু’দিন পরও নিয়ে যায়নি। পরে তিনি কামিনীকে সেবা-শুশ্রুষা করে ছেড়ে দিলেও তা আর উড়ে চলে যায়নি, থেকে যায় মানব পরিবারে, যেখানে ভালবাসায় সিক্ত করে সকলের মন। কাকের কথা বলা অসম্ভব কিছু নয়। তবে কথা বলে ও পোষ মেনে একটি সংসারের গল্প ও আনন্দ-বিনোদনের সঙ্গী হয়ে ওঠার কাহিনী বোধহয় এই একটিই রচিত হয়েছে।
রূপহীন কুকুর ও মনিবের ভালবাসা
প্রভুভক্তিতে শীর্ষস্থানে যে প্রাণীটির কথা জানা যায় তা হচ্ছে কুকুর। হয়তো অভিমান কি জানা নেই এই প্রাণীর। তাই তো মৃত মনিবের জন্য পথ চেয়ে নয় বছর নয় মাস পনেরো দিন অপেক্ষা করেছিল হাচিকো নামের একটি কুকুর।
কুকুরকে অনেকেই ভালবাসেন। আবার কেউ কেউ আছেন ঘৃণাও করতে পারেন। কিন্তু ভাবুন তো, যদি কোনো কুকুর আপনার সন্তানের জীবন বাঁচাতে নিজের নাকটাই হারায় তবে তাকে কিভাবে ঘৃণা করবেন?
মনিবের কন্যার জীবন বাঁচাতে দুরন্তবেগে ছুটে চলা মোটর সাইকেলের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কাবাঙ্গ নামক ফিলিপাইনের একটি কুকুর। সে সময় কুকুরটি মনিবের এক কন্যা ও শিশুর চাচাতো বোনের জীবন বাঁচাতে সফল নায়ক হয়েছিল। কিন্তু দুর্ঘটনায় নিজের নাক ও মুখের কিছু অংশ হারিয়েছিল কাবাঙ্গ। মারাত্মকভাবে আহত কুকুরটিকে মালিক রুডি বুঙ্গার ভেটেরিনারিয়ান বা প্রাণী চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান।
রুডি বুঙ্গার কুকুরটির কষ্ট দেখে ইউথ্যানেশিয়া বা আরামদায়ক মৃত্যুর ব্যবস্থা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাণী চিকিৎসকরা তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করে সফল হলেও নাকের স্থানটি অক্ষত রাখতে পারেনি। নাক না থাকায় দেখতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু নিজের জীবন বিপন্ন করে আমার সন্তানের জীবন যে বাঁচাতে পারে তাকেই তো ভালবাসতে হয়। কথাটি বলতেন কুকুরের মনিব রুডি বুঙ্গার। এটাই হয়তো সত্যিকার ভালবাসা। যে ভালবাসায় রূপ নয়, বরং মনের বড়ত্বকে স্থান দিয়েছে মানুষ।
হরিণ শাবকের প্রতি মানবশিশুর ভালবাসা
এখন যে ভালবাসার ঘটনাটি বলবো সেটা হয়তো একমুখী ভালবাসার তালিকায় পড়বে। প্রাণীরা যেমন মানুষের জন্য জীবন বাজী রাখে মানুষও কিন্তু তেমন করে থাকে। মানব মস্তিষ্ক ও প্রাণী মস্তিষ্কের বিবেচনায় মানুষ প্রাণীকে বাঁচাবে এটাই স্বাভাবিক। তাই মানুষের ভূমিকা আমাদের অবাক না-ও করতে পারে। কিন্তু সবেমাত্র কৈশোরে পা রাখা এক মানবশিশুর, প্রাণীর প্রতি ভালবাসা রাতারাতি দেশি-বিদেশি মিডিয়ার আলোচনায় উঠে আসতেই পারে।
ঘটনাটি ২০১৪ সালের। নোয়াখালী জেলার এক দুরন্ত ও সাহসী বালক বেলালের কথা বলছি। যে বালক নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে, তীব্র স্রোতে ডুবতে বসা একটি হরিণ শাবককে উদ্ধার করে পুনরায় বনে ছেড়ে দেয়। লক্ষ্য করুন, বালকটি যখন হরিণকে হাতে ধরে উপরে তুলে বনের দিকে সাঁতার কাটতে থাকে তখন, দৃশ্যটা জনপ্রিয় ভারতীয় সিনেমা বাহুবলি’র একটি দৃশ্যের সাথে মিলে যায়।
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হাসিবুল ওয়াহাব বিস্ময়কর এই ঘটনাকে ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। একটি মৃত্যুপথযাত্রী হরিণ শাবক, যেটাকে উদ্ধার করে ছেড়ে না দিয়ে হয়তো অনেকেই ভুরিভোজ করতে পারতো। কিন্তু বিস্ময়কর বালক তা করেনি। এমন কাজের জন্য ফটোগ্রাফার ও তার বন্ধু তখন বেলালকে ধন্যবাদ জানাতে ভোলেনি। বেলাল কোনো প্রাণী উদ্ধারকারী দলের সদস্য নয় কিংবা কোনো কিছু প্রাপ্তির আশায়ও কাজটি করেনি। হয়তো শিশুমনে হরিণ শাবকের জন্য জন্মেছিল এক টুকরো ভালবাসা। আসলে যারা নীরবে ভালবেসে যায় তারা কী প্রতিদান চায়?
কুমির ও মানুষের প্রকৃত ভালবাসা
কুমির ও মানুষের ভালবাসা হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর। কারণ কুমির কতটা ভয়ঙ্কর ও বিপজ্জনক হতে পারে তা কারো অজানা নয়। কিন্তু জীবন বাঁচানোর প্রতিদানস্বরুপ কুমিরও মানুষের প্রকৃত বন্ধু হয়েছিল এমন ঘটনাও জানা যায়।
প্রায় ২১ বছর আগে কোস্টারিকার পরশমিনা নদীর তীরে ৫ মিটার লম্বা একটি কুমিরকে মাথায় গুলিবিদ্ধাবস্থায় উদ্ধার করেন চিতো নামের এক ব্যক্তি। উদ্ধারকৃত কুমিরটির নাম রাখেন পোচো। তিনি পোচোকে প্রাণী চিকিৎসকের সহায়তা সুস্থ করে তোলেন। যথেষ্ট সুস্থ-সবল হলে চিতো উদ্ধারকৃত কুমিরটিকে নদীতে ছেড়ে দেন। কিন্তু পোচো আর নদীতে ফিরে যায় না! সে চিতোর বাড়ির দিকে চলে আসে। পরে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে কুমিরটিকে রেখে দেন চিতো। এভাবেই চলতে থাকে একটি ভয়ঙ্কর প্রাণী ও মানুষের বন্ধুত্ব।
এই বন্ধুত্ব দিন দিন এতটাই বিশ্বস্ততায় পরিণত হয় যে চিতো ও পোচো একই সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কাটতো ও খেলাধূলা করতো। ধীরে ধীরে পোচো নাম ধরে ডাক দিলে সাড়া দেয়া শিখেছিল। পোচো ও চিতোর বন্ধুত্ব দেখার জন্য হাজার হাজার পর্যটক, বিজ্ঞানী, প্রাণী আচরণবিদ্যায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সমাগম ঘটত। দীর্ঘদিনের এই সফল ভালবাসা ২০১১ সালের ১২ অক্টোবর কুমিরটির স্বাভাবিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়। কুমিরটি বয়স হয়েছিল ৫০ বছর। এভাবেই হয়তো প্রাণীরা মানব বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যায়।
ফিচার ইমেজ – wotzup.ng