ভারতীয় সমাজের কৃষিব্যবস্থা দুনিয়ার অন্যান্য দেশগুলো থেকে আলাদা, এখানে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে কৃষিজমির আকার ক্ষুদ্র হতে থাকে। এখানে কৃষকসমাজের ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা তাই কঠিন। সেই ইতিহাসকে চোখ রাঙিয়ে ভারতের রাজধানী দিল্লির সীমান্তে চলছে ভারতীয় কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলন। দিল্লিতে ঢোকার রাস্তাগুলোর পাশে দখল নিয়েছে পাঞ্জাবি কৃষকেরা। নিজেরাই মেডিক্যাল ক্যাম্প, লঙ্গরখানা স্থাপন করেছেন। নিজেদের ট্রাক্টর থেকে শুরু করে সব সহায় সম্বল নিয়ে হাজির হয়েছেন। দাবী একটাই মোদি সরকার আইনসভায় ভারতীয় কৃষিতে সংস্কারের উদ্দেশ্যে তিনটি বিল পাশ করেছে, বিতর্কিত এই বিল নিয়ে রাজ্য সরকার, বিরোধীদল এবং সর্বোপরি যাদেরকে লক্ষ্য করে এই বিল সেই কৃষক নাখোশ। তাদের দাবী বাতিল করতে হবে এই বিল।
ভারতীয় কৃষিতে সংস্কার, আধুনিকায়ন এবং কৃষিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে ভারতের অনেক সরকারই চেষ্টা করেছে। তবে ভারতের কৃষি ব্যবস্থা এত জটিল এবং এতগুলো অংশীদার জড়িত কেউই একে সংস্কারের কাজটি করতে পারেনি। এছাড়া ভারতের কৃষিতে বড় অংশীদার হলো রাজ্য সরকার। প্রতিটি রাজ্য সরকার সেই রাজ্যে উৎপাদিত পণ্যের বাজার যাকে ‘মান্ডি’ বলা হয় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করে। মান্ডিগুলোকে রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে থাকে ‘APMC (Agricultural Produce Marketing Committee)’ এর মাধ্যমে, কারণ এই ব্যবসা বাণিজ্যে জড়িত আছে কর এবং এই কর সংগ্রহ করে রাজ্য সরকার। তাই রাজ্য সরকার নিয়ন্ত্রণ করে বিশাল আকারের বাজারগুলোতে কোন পণ্যের দাম কত হবে, সেই দামের উপর ভিত্তি করে সংগ্রাহকরা কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য কিনে আনে। অথবা বড় কৃষকরা টনে টনে পণ্য নিজেরাই সেই বাজারে নিয়ে আসে। এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে পণ্য সরবরাহের কাজটিও হয়ে থাকে এই বাজারগুলোর মাধ্যমেই।
এই কৃষি ব্যবস্থার সংস্কারের জন্য তিনটি বিল লোকসভায় ২০২০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাস হয়ে যায়। রাজ্যসভায় প্রবল বিরোধিতার মুখেও ২০ এবং ২২ সেপ্টেম্বরের মাঝে তা পাস হয়। এই তিনটি বিল নিয়েই ভারতের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় আন্দোলন আর বিক্ষোভ। বিশেষ করে ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানসহ বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট করে আন্দোলন জমাট বাধতে থাকে।
ভারত সরকার কী বলছে?
ভারতীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে এই তিনটি আইন পাস এবং কার্যকর হলে কৃষক, উৎপাদকদের রাজ্য নিয়ন্ত্রিত ‘মান্ডি’গুলোতে বিক্রির যে বাধ্যবাধকতা তার থাকছে না। তারা চাইলে সরাসরি বড় কোম্পানিগুলোর সাথে চুক্তি করতে পারবে, ফলে কৃষকরা বাজারে থাকা মধ্যসত্ত্বভোগীদের কাছ থেকে রেহাই পাবে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, এই বিলের ফলে কৃষক মুক্তি পাবে বলেই দাবী করে আসছেন। এই আইনের পক্ষে সাফাইয়ে আরো যুক্তি হলো আগে আন্তঃরাজ্য পণ্য বাণিজ্য করা কৃষকের জন্য কঠিন ছিল, যার দুয়ার এখন খুলে যাবে বলে ধারণা।
কোনো কৃষক চাইলে বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সাথে ‘লিগ্যাল এগ্রিমেন্ট’ এ যাবার মাধ্যমে সরাসরি তার কাছে বিক্রি করতে পারবে। ভারত সরকারের ধারণা এই আইনগুলোর বস্তবায়ন করা সম্ভব হলে কৃষিতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে। ভারতীয় কৃষিতে এখনো পর্যন্ত ব্যক্তিগত বিনিয়োগের মাধ্যমেই চলমান। বর্তমান কৃষি ব্যবস্থায় কৃষক নিজেই তার অর্থ সংস্থান করে, সার বীজের যোগানের ব্যবস্থা করছে এবং ফসল উৎপাদন করে বিক্রি করছে মান্ডিগুলোতে। মান্ডিগুলো প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে পণ্য খরিদে ‘মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (MSP)’ এর ব্যবস্থাও করে দেয়।
তবে এই বছরের সেপ্টেম্বরে পাস হওয়া তিনটি কৃষিবিলে সরকার সুযোগ করে দিচ্ছে প্রাইভেট কোম্পানিগুলোকে এই বাজারে ঢোকার, বিশেষ করে এতে বড় রিটেইল চেইন এবং সুপারশপগুলো সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে পণ্য কিনতে পারবে, তাদের আর মধ্যসত্ত্বভোগীদের উপর নির্ভর করতে হবে না। আপাতদৃষ্টিতে তাই কেন্দ্রীয় সরকার আশ্বাস দিচ্ছে কৃষকদের হাতে সুযোগ বাড়বে। তার নির্ধারিত বাজারেই বিক্রি না করে বরং সে কর্পোরেট কোম্পানির সাথে স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদে চুক্তিতে যেতে পারবে, চাইলে আন্তঃরাজ্য বাণিজ্য করতে পারবে এই চুক্তির মাধ্যমে।
কৃষকের ক্ষতি কোথায়?
আপাতভাবে চমৎকার শুনতে এই বিলগুলোর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়বে মান্ডিগুলোতে। বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন, এই বিল কার্যকর হলে মান্ডিগুলোর আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না, সময়ের সাথে এই জায়গাটি পুরোটাই দখল করে নিবে অল্প কয়েকটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান। আর ভারতের খণ্ড খণ্ড কৃষিজমির চিত্রে দেখা যায় এখনো ৮৬ শতাংশ জমির মালিক দুই হেক্টরের কম জমি চাষ করেন। সুতরাং এককভাবে একজন কৃষককের কাছে পণ্যের পরিমাণ খুবই কম, এই পণ্য নিয়ে সে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সাথে দরদামে কীভাবে যাবে এই নিয়ে কৃষকদের দুশ্চিন্তা আছে।
হয়তো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানে দাম নির্ধারণে একক কর্তৃপক্ষ হয়ে উঠবে। এবং এখানে যেহেতু সরাসরি বাজারের ব্যবস্থা থাকবে না কৃষককে ঠকানো সোজা হবে। ফলে এই অবস্থায় কৃষক যদি দীর্ঘমেয়াদে কোনো কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের সাথে লম্বা চুক্তিতে যায়ও, সেখানেও তার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
যদি কোনোভাবে আইনি ঝামেলা পর্যন্ত গড়ায়, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর যে আইনজীবী এবং ক্ষমতার কূটচাল আছে কৃষকদের কাছে তা নেই। এখানে কৃষক এবং প্রতিষ্ঠানের মাঝে বিরোধ নিষ্পত্তি হলে তা নিরসনের জন্য তিনটি দ্বন্দ্ব নিরসনকারী কর্তৃপক্ষ রাখা হয়েছে, প্রথমত ‘কনসিলিয়েশন বোর্ড’, দ্বিতীয়ত ‘সাবডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেট’ এবং তৃতীয়ত ‘এপিলিয়েট অথোরিটি’। অর্থাৎ যদি কোনোক্ষেত্রে কৃষকের সাথে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান চুক্তি করে তা লঙ্ঘন করে তা নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হবে। যেখানে ভারতের সিংহভাগ কৃষক এক মৌসুমের পণ্য বিক্রির অর্থ দিয়ে পরের মৌসুমে তার খরচ নির্ধারণ করে। এই সমস্ত আইনি লড়াইয়ে কৃষককে তার পাওনা আদায়ে বরং নিঃস্ব হওয়ার সম্ভাবনাও আছে। বিশেষ করে ভারতের পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার কৃষক যারা বংশানুক্রমে চাষাবাদ করে আসছেন তারা এই আইনকে দেখছে বিশাল হুমকি হিসেবে।
দীর্ঘমেয়াদে দাম নির্ধারণের ক্ষমতা যে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাবে তার আরেকটি লক্ষণ হলো তিনটি আইনের একটি অর্থাৎ ‘এসেনশিয়াল কমোডিটি অ্যাক্ট’ এর সংশোধনী। অর্থাৎ এই আইনটি আগেও ছিল, যেখানে সরকার কোনো পণ্যের কালোবাজারি এবং কৃত্রিম সংকট রুখতে পণ্যের তালিকা করে তার দাম নির্ধারণ করে দিত। এই পণ্যের তালিকায় নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যেগুলোর দাম সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকতো।
২০২০ সালে এই আইনের সংশোধনীতে এই সরকার শুধুমাত্র জরুরি পরিস্থিতি ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে এই পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে না। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতেই শুধুমাত্র সরকার হস্তক্ষেপ করবে। এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মানদণ্ড ধরা হয়েছে পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ এবং অপচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি।
ধরা যাক, অপচনশীল দ্রব্য ডালের দাম আজকে ১০০ টাকা কেজি, এটি যদি ৫০ শতাংশ বেড়ে ১৫০ টাকার উপরে যায় তবেই সরকার সেখানে হস্তক্ষেপ করবে। অর্থাৎ এখন কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছে ১০০ থেকে ১৫০ এর মাঝে দাম নির্ধারণের স্বাধীনতা থেকে যাবে। এতে ক্রেতার স্বার্থ তো বিনষ্ট হবে, বাজারের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে। আর অন্যদিকে কৃষকদের বঞ্চিত করবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো, যেখানে ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণের কোনো ব্যবস্থা নেই।
কৃষকদের দাবী কী?
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ভারতীয় কৃষকদের এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের প্রথম দাবী এই তিনটি ‘কৃষি সংস্কার আইন’ বাতিল করা। বাজার ব্যবস্থায় এমএসপি (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস) সুবিধাকে আইনত ভিত্তি দেওয়া। এই এমএসপিকে কৃষিকাজের গড় খরচের সমন্বয় করা যাতে কৃষক বঞ্চিত না হয়।
এই প্রধান দাবীর বাইরেও আছে কৃষক ইউনিয়নের নেতা কর্মীদের উপরে যে মামলা দেওয়া হয়েছে সেগুলো তুলে নেওয়া, কৃষিকাজে ডিজেল ব্যবহারের ক্ষেত্রে তার ৫০ শতাংশ দাম কমিয়ে আনার দাবী আছে। এছাড়াও বায়ুদূষণ রোধে আইন করে কেন্দ্রীয় সরকার ফসলের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, সেটিও তুলে নেওয়ার দাবী করেছে কৃষকেরা। কৃষক এবং সরকারের প্রতিনিধিদের মাঝে কয়েক দফা বৈঠক হলেও এখনো সুরাহা হয়নি। পাঞ্জাবের কৃষকরা দাবী করছেন, দাবী আদায় না করে তারা ঘরে ফিরে যাবেন না।
সরকার আর কৃষক ইউনিয়ন মুখোমুখি
দীর্ঘদিন ধরে দিল্লির সীমান্তে অবস্থান নেওয়া ভারতীয় কৃষক আন্দোলন ইতোমধ্যে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বিশ্বজুড়ে পাঞ্জাবি বংশোদ্ভূত যত মানুষ আছেন সবাই আন্দোলন করছেন। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারতের কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। নভেম্বরের ত্রিশ তারিখ কৃষকদের উপর পুলিশি আক্রমণের মুখে ট্রুডোর এই বক্তব্য নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে।
এছাড়াও বিশ্ব মিডিয়ার সার্বক্ষণিক উপস্থিতি মোদি সরকারকে চাপের মুখে ফেলেছে, গত ১২ ডিসেম্বর কৃষক ইউনিয়নের নেতারা হরিয়ানার সড়কে টোল প্লাজা অধিকারে নিয়ে রাস্তাকে টোলমুক্ত করে দিয়েছেন। এই কাজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে, সারা ভারতজুড়ে ‘বনধ’ ডাকার ঘোষণাতেও ভারতের বিভিন্ন এলাকার মানুষ সাড়া দিয়েছে অনেকটা স্বতস্ফূর্তভাবে।
তবে কোর্টও মনে করে বৈঠকের মাধ্যমে সুরাহা না হলে তাদের আন্দোলনের অধিকার আছে। তাই ভারতের ‘রুটির ঝুড়ি’ পাঞ্জাবের সংঘটিত এই কৃষকদের নিয়ে মারাত্মক বিপদে আছে মোদি সরকার। কেন্দ্রীয় রাজধানী দিল্লির সীমান্তে রাস্তার পাশে প্রচণ্ড শীতে প্রতিদিন মানুষ অসুস্থ হচ্ছে, মারা যাচ্ছে। ভারতীয় দৈনিক ন্যাশনাল হেরাল্ডের সূত্র বলছে, আন্দোলন চলাকালীন ১৫ জন আন্দোলনকারী প্রাণ হারিয়েছেন, যার মাঝে আছেন দুজন নারী আন্দোলনকারী, সেই সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। হয়তো সময়ই বলে দিবে কৃষকদের চাপে ভারতের মোদি সরকার পিছু হটবে কিনা।