গল্পের পেছনের গল্প
ঘটনাটি ২০০৮ সালের জুন মাসের; স্থান সেন্ট্রাল কায়রো। কর্মক্ষেত্র থেকে বাসায় ফিরছিলেন ডকুমেন্টারি ফিল্ম নির্মাতা নুহা রুশদি। হঠাৎ পেছন থেকে এক ট্রাক ড্রাইভার চলন্ত ট্রাক থেকে নুহার বুক স্পর্শ করে, তাকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে। এক পর্যায়ে নুহার জামার কিছু অংশ ছিঁড়ে গেলে তিনি মাটিতে পড়ে গিয়ে রক্ষা পান।
পাবলিক প্লেসে নারীদের শরীর স্পর্শ করা, যৌন নিপীড়নের চেষ্টা করা মিসরে নতুন কিছু নয়। যৌন হয়রানির দিক থেকে মিসর বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি। এক জরিপ অনুযায়ী, ৯৩% মিসরীয় নারীই ঘরের বাইরে যৌন হয়রানির শিকার হন। কিন্তু সম্মানহানীর ভয়ে অধিকাংশ নারীই তা প্রকাশ করেন না।
তবে নুহার কথা ভিন্ন। শিক্ষিত এবং সচ্ছল পরিবারে বড় হওয়া নুহা উঠে দাঁড়ান পড়ে যাবার পরও। দৌড়ে গিয়ে ট্রাক ড্রাইভারকে থামানোর চেষ্টা করেন, এক পর্যায়ে ট্রাকের সামনের গ্লাসের উপর উঠে পড়েন এবং গ্লাসে আঘাত করতে শুরু করেন। নিপীড়নকারী শেরিফ জুমা ট্রাক থামিয়ে ধরা দিতে বাধ্য হয়। নুহা তাকে নিয়ে পুলিশের কাছে যান যৌন নিপীড়নের মামলা করার জন্য। কিন্তু কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার মামলা নিতে রাজি হয় না। তার বক্তব্য ছিল, যৌন নিপীড়নের মামলায় একে তো স্ক্যান্ডাল হবে, তার উপর আইন অনুযায়ী এর শাস্তিও খুবই হালকা!
অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত যখন নুহা মামলা দায়ের করেন, তখনই তিনি তিক্ত সত্যটি জানতে পারেন। মিসরের ইতিহাসে তিনিই প্রথম নারী, যিনি কারো বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির মামলা করেছেন! মিসরের ঘুণে ধরা রক্ষণশীল সমাজ তার এই মামলা করাকে সহজভাবে নিতে পারেনি। অভিযোগ উঠতে থাকে তার পোশাক-আশাক নিয়ে, তার উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেকে দাবি করতে থাকে, সে হচ্ছে কোনো বিদেশি এজেন্ট, যে মিসরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য এই মামলা দায়ের করেছে!
‘কায়রো 678’ নির্মাণের ইতিহাস
নুহা রুশদির এই মামলাটি প্রবলভাবে নাড়া দেয় তার পরিচিত চলচ্চিত্রকার মোহাম্মদ দিয়াবকে। মোহাম্মদ দিয়াব মিসরের অনেকগুলো ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার। ২০০৭ সালে তার চিত্রনাট্যে নির্মিত ‘আল-জাজিরা’ তথা ‘দ্য আইল্যান্ড’ চলচ্চিত্রটি মিসরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি। তার আগের সবগুলো সিনেমা বাণিজ্যিক ফর্মূলায় নির্মিত হলেও এবার তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এই বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে তিনি নিজেই একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করবেন, সেটি ব্যবসায়িকভাবে লাভের মুখ দেখুক আর না-ই দেখুক।
২০১০ সালে নির্মিত মিসরের সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা এই চলচ্চিত্রটির নাম Cairo 678। ২০১১ সালের মোবারক বিরোধী আরব বসন্তের আন্দোলনের মাত্র কয়েক মাস আগে মুক্তি পাওয়ায় এটি আরও বেশি প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে। কারণ মুভিতে এর কাহিনীর মধ্য দিয়ে সমাজের পাশাপাশি মিসরের তৎকালীন প্রশাসন এবং আইনি ব্যবস্থারও সমালোচনা করা হয়। আরব বসন্তের মতোই এটিও অনেকটা সমাজের প্রাচীনপন্থাকে আঁকড়ে থাকার প্রবণতার সাথে সংস্কারপন্থার দ্বন্দ্বেরই চিত্রায়ন।
চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পথে মোহাম্মদ দিয়াবকেও কম বাধা-বিপত্তি সহ্য করতে হয়নি। এক মিসরীয় আইনজীবি তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন এই অভিযোগে যে, এই চলচ্চিত্রটি নাকি বহির্বিশ্বের কাছে মিশরের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। এক মানবাধিকার কর্মী চলচ্চিত্রটি নিষিদ্ধ করার আবেদন জানিয়ে আদালতে রিট করেন এই বলে যে, এই চলচ্চিত্রে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারী জাগরণের নামে নারীদেরকে সহিংসতায় উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তবে মোহাম্মদ দিয়াব দুটো মামলাতেই জয়ী হয়ে শেষ পর্যন্ত চলচ্চিত্রটি সফলভাবে মুক্তি দিতে সক্ষম হন।
কাহিনী সংক্ষেপ
Cairo 678 চলচ্চিত্রটি মূলত অনুপ্রেরণার গল্প- যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প, সংগ্রামের গল্প। মুভিতে তিন রকম আর্থ-সামাজিক পরিবেশ থেকে উঠে আসা তিন নারীর কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে, যারা প্রত্যেকেই যৌন হয়রানির শিকার। কাহিনীর অসাধারণ বুননে এই তিনজনের এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পুরো সমাজব্যবস্থার অত্যন্ত বাস্তবসম্মত চিত্র ফুটে উঠেছে। সিনেমাটি মিসরের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হলেও এই কাহিনী তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশের দর্শকের কাছেই অত্যন্ত পরিচিত মনে হবে।
সিনেমায় নুহার চরিত্রটির নাম নেলি, যে এক মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত, সংগ্রামী নারী। সে একটি কলিং সেন্টারে চাকরির পাশাপাশি অবসরে স্ট্যান্ড-আপ কমেডিয়ান হিসেবে কাজ করে। অন্য দুটি মূল নারী চরিত্রের একজন শিবা, যে সমাজের উচ্চবিত্ত অংশের প্রতিনিধি, সে অত্যন্ত আধুনিক পরিবারে বড় হওয়া সাবলম্বী নারী।
স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে গিয়ে ভীড়ের মধ্যে শিবা তার স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেলে একদল উম্মত্ত পুরুষ তার উপর হামলে পড়ে এবং তাদের লালসার শিকার হয়ে এক পর্যায়ে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। প্রাথমিকভাবে ভেঙে পড়লেও দ্রুতই সামলে নেয় শিবা। নিপীড়নের শিকার নারীদের জন্য নিয়মিত টিভিতে এবং সপ্তাহে একদিন বাস্তবে অফিস খুলে কাউন্সেলিং শুরু করে সে, যেখানে সে নারীদেরকে নিশ্চুপ না থেকে প্রতিবাদ করতে, ঘুরে দাঁড়াতে উৎসাহ দেয়। তার ভাষায়,
“ইচ্ছে থাকলে কিছুই লাগে না, মাথার স্কার্ফে থাকা সেফটি পিন দিয়ে আঘাত করেই নিপীড়কদের শায়েস্তা করা যায়।”
তার কাউন্সেলিংয়ে প্রভাবিত হয় এই চলচ্চিত্রের আরেক নারী চরিত্র ফাইজা, যাকে কেন্দ্র করেই মূলত চলচ্চিত্রটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। ফাইজা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের নারী, দুই সন্তানের মা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে সরকারি চাকরি করেও বাচ্চাদের পড়াশোনার খরচ জোগাড় করতে পারে না তারা, যার ফলে তাদের বাচ্চাদেরকে প্রতিদিন স্কুলের মাঠে হাত উপরে তুলে দাঁড়িয়ে থেকে শাস্তি ভোগ করতে হয়।
টাকা বাঁচানোর জন্য ফাইজাকে ট্যাক্সির পরিবর্তে লোকাল বাসে পুরুষদের ভীড়ের মধ্যে গাদাগাদি করে অফিসে যেতে হয়। সে পর্দানশীল মহিলা; শালীন পোশাক এবং হিজাব পরেই চলাফেরা করে। কিন্তু তারপরও পুরুষের লালসা থেকে তার নিস্তার মেলে না। তার যাত্রাপথের ৬৭৮ নম্বর বাসে প্রতিদিনই ভীড়ের মধ্যে কেউ না কেউ তার শরীর স্পর্শ করে, তার উপর কুখ্যাত ‘লেমন টেস্ট’ প্রয়োগ করার চেষ্টা করে।
শিবার কাউন্সেলিংয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে একদিন ফাইজা ঘুরে দাঁড়ায়। পেন্সিল নাইফ দিয়ে সে আঘাত করে তার শরীরের সাথে শরীর ঘষতে থাকা এক পুরষের অণ্ডকোষে। তারপর আরও একদিন। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে মিসর জুড়ে। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। এক পর্যায়ে সিনেমার মূল তিন নারী চরিত্র একত্রিত হয়। পুলিশি তদন্তের ভয়ে তারা কি চুপ করে যাবে, নাকি তাদের এই বিকল্প যুদ্ধ চালিয়ে যাবে- তা নিয়ে বাক-বিতণ্ডা চলতে থাকে। শুরু হয় সিনেমার ক্লাইম্যাক্স। চরিত্রগুলোর ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনী।
চলচ্চিত্রটির বৈশিষ্ট্য
ফাইজার যাত্রাপথের ৬৭৮ নম্বর বাসটি, যার অভ্যন্তরে এবং আশেপাশে চলচ্চিত্রটির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়, তার নাম অনুসারেই চলচ্চিত্রটির নামকরণ করা হয়েছে Cairo 678। অবশ্য এই নামের আরেকটি ব্যাখ্যাও আছে। সেটি হলো- ৬, ৭ ও ৮ অংকগুলো যেরকম ক্রমবর্ধমান; সেটি যৌন নিপীড়নের ফলে সমাজে এবং মুভির কাহিনীতে যে বিশৃঙ্খলা এবং সামাজিক অবক্ষয় বৃদ্ধি পেতে থাকে, তারই একটি রূপক।
Cairo 678 চলচ্চিত্রটির মূল সাফল্য এর চরিত্র বিনির্মাণে। এখানে একই রকম ঘটনায় ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়। নেলি পুরো দেশের জনমতের বিরুদ্ধে গিয়ে আদালতে তার সংগ্রাম চালিয়ে যায়। তার বাগদত্তা তার সমর্থনে এগিয়ে আসে, যদিও পারিবারিক সম্পর্কের টানাপোড়েনে সে বারবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। শিবা কাউন্সেলিং সেন্টার খুলে অন্যদেরকে অনুপ্রাণিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। কিন্তু তার স্বামী সমাজের চোখে নিজের সম্মানের কথা বিবেচনা করে তাকে ডিভোর্স দিতে চায়। অন্যদিকে ফাইজা নিজের অবস্থার কথা স্বামীর কাছে মুখ ফুটে বলার সাহসটুকুও অর্জন করে উঠতে পারে না। নিজের কষ্ট সে নিজেই বয়ে বেড়ায়।
সিনেমাটির চিত্রনাট্য কিছুটা অস্কারজয়ী মেক্সিকান চলচ্চিত্রকার আলেহান্দ্রো গঞ্জালেস ইনারিতুর প্রথম চলচ্চিত্র ‘অ্যামোরেস পেরোস’ দ্বারা প্রভাবিত। ‘অ্যামোরেস পেরোস’-এর মতোই এই চলচ্চিত্রেও আপাত দৃষ্টিতে সম্পর্কহীন ঘটনাগুলোর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম সম্পর্কের জাল তৈরি করা হয়েছে, যেখানে সবগুলো প্রধান চরিত্র একটি স্থানে এবং কালে এসে এক বিন্দুতে মিলিত হয়।
সিনেমার দুর্বলতা একটি জায়গায়, সেটি হচ্ছে এখানে পুরুষদের এই যৌন নিপীড়নের একটি হালকা ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। দারিদ্র্যের কারণে উপযুক্ত বয়সে বিয়ে করতে না পারাটাকে এবং পারিবারিক অশান্তিকে এখানে সম্ভাব্য দুটো কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বিবাহিতরাও নিয়মিতভাবেই যৌন নিপীড়ন করে থাকে।
তবে এই সামান্য দুর্বলতা সত্ত্বেও মুভিটি মিসরের সমাজ ব্যবস্থাকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়। সিনেমাটি একই সাথে দর্শক এবং সমালোচকদের প্রশংসা অর্জন করে। Dubai International Film Festival-এ এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য ফাইজা চরিত্রে অভিনেত্রী বুশরা এবং পুলিশ ইন্সপেক্টর চরিত্রে অভিনেতা মাজেদ আল-কেদওয়ানি সেরা অভিনেতা-অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়াও মুভিটি Asia Pacific Screen Awards-এ ‘জুরি গ্র্যান্ড পুরস্কার’ এবং Chicago International Film Festival-এ ‘বেস্ট ফিচার ফিল্ম’ পুরস্কার সহ আরও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে।
রটেন টম্যাটোজ সাইটের নির্দেশক অনুযায়ী চলচ্চিত্রটি ৮০% ফ্রেশ। দর্শকদের ভোটে মুভিটির বর্তমান IMDB রেটিং 7.5। বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান ঔপন্যাসিক পাউলো কোয়েলহোর মতে, এই অসাধারণ চলচ্চিত্রটি দেশ-জাত নির্বিশেষে প্রত্যেক পুরুষের জন্য দেখা বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত।
ফিচার ইমেজ: IMDB