কল্পনা করুন তো, আপনি হঠাৎ করে নিজেকে আবিষ্কার করলেন একটি গেমের চরিত্র হিসেবে; আপনাকে গহীন জঙ্গলে কঠিন সব কাজ শেষ করে বিজয়ী হতে হবে, কেবল তবেই আপনি ফিরে যেতে পারবেন সত্যিকারের জগতে। এরকমই একটি ধারণা নিয়ে বোর্ড গেম জুমাঞ্জির জগতে হারিয়ে যাওয়া দুই যুগ আগের এক কার্টুন সিরিজে, যার আধুনিক রূপায়ণ ২০১৭ সালে রূপালি পর্দায় এলো ‘Jumanji: Welcome to the Jungle’ নামে। চলুন না ঘুরে আসি জুমাঞ্জির জঙ্গল থেকে!
সময়টা ১৯৯৬; আমেরিকার নিউ হ্যাম্পশায়ারে। অ্যালেক্স ভ্রিক নামের এক কিশোর একদিন ঘটনাক্রমে তার বাবার খুঁজে পাওয়া জুমাঞ্জি নামের এক বোর্ড গেম খুঁজে পেলো। বোর্ড গেম বলতে বোঝায় যে গেমগুলো একাধিক মানুষ মিলে খেলতে পারে বসে বসে, যেমন লুডো, মনোপলি ইত্যাদি। তো অ্যালেক্স চিন্তা করল তার আর বোর্ড গেম খেলবার বয়স নেই, তাই সে আর গেমটা খেললো না। তার বদলে সে টিভি পর্দায় কার্ট্রিজ বা ক্যাসেট লাগিয়ে গেম খেলতে লাগলো। সেদিন রাত্রেই সে আবিষ্কার করলো তার জুমাঞ্জি বোর্ড গেমটা পরিণত হয়েছে কার্ট্রিজে। যেই না সে খেলা শুরু করলো টিভির সাথে লাগিয়ে, সাথে সাথে সে তার রুম থেকে হারিয়ে ঢুকে পড়ে জুমাঞ্জির জগতে, যেখান থেকে সে বেরুতে পারবে না গেম শেষ না করে।
বিশ বছর বাদে, সে এলাকার স্কুলের চার ছাত্র-ছাত্রী শাস্তিস্বরূপ একটি পুরনো স্টোর রুম পরিষ্কারের দায়িত্ব পায়। সেই কাজ করতে গিয়ে তারা আবিষ্কার করে পুরনো কার্ট্রিজ গেম জুমাঞ্জি, যেটা অ্যালেক্স খেলতে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। তারা পুরনো একটি টিভিতে সেটা লাগাতেই তাদেরকে টিভির ভেতর টেনে নিয়ে যায় গেমটি, সবাই হাজির হয় জুমাঞ্জির জঙ্গলে।
একজনের নাম হয় ডক্টর স্মল্ডার ব্রেভস্টোন নামের একজন পেশিবহুল ভ্রমণকারী ও প্রত্নতাত্ত্বিক, আরেকজন ফ্র্যাংকলিন মাউস ফিনবার নামের একজন প্রাণিবিদ, অন্য একজন রুবি রাউন্ডহাউজ নামের মার্শাল আর্ট স্পেশালিস্ট মেয়ে, আর শেষের জন প্রফেসর শেলডন ওবেরন নামের একজন মানচিত্রবিদ। চারজনের কাজ হবে আগের গেমারকে উদ্ধার করা এবং জুমাঞ্জির প্রাণ একটি পান্না পাথর উদ্ধার করে জায়গামত ফিরিয়ে দিয়ে জুমাঞ্জিকে অভিশাপমুক্ত করা। তবে সমস্যা হলো প্রত্যেকের মাত্র তিনটি করে প্রাণ আছে। এই তিনটি প্রাণ শেষ হয়ে গেলে তাদের আর কোনোদিন ফিরে যাওয়া হবে না সত্যিকারের পৃথিবীতে। নাইজেল নামের একজন গেম গাইডের সহায়তায় তারা জানতে পারে তাদের কী কী করতে হবে। তারা কি পারবে ফিরে যেতে তাদের কাজগুলো ঠিক মতো শেষ করে? মুক্তি পাবে কি জুমাঞ্জির গহীন আর বিপজ্জনক জঙ্গল থেকে?
তারকাপূর্ণ এ ছবিটির একটা মুহূর্ত পাওয়া যাবে না যেখানে আপনি ‘বোরিং’ অনুভব করতে পারেন। টানা দু’মিনিট আপনি না হেসে থাকতেও পারবেন না। দম ফাটানো হাসির এই অ্যাকশন কমেডি অ্যাডভেঞ্চার মুভিটিতে অভিনয় করেছেন দ্য রক খ্যাত ডোয়াইন জনসন (ডক্টর স্মল্ডার ব্রেভস্টোন), জ্যাক ব্ল্যাক (প্রফেসর শেলডন ওবেরন), ক্যারেন গিলান (রুবি রাউন্ডহাউজ) এবং কেভিন হার্ট (ফ্র্যাংকলিন মাউস ফিনবার)।
২০ ডিসেম্বর ২০১৭ মুক্তি পাওয়া ১১৯ মিনিটের এ মুভিটি ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাতে আয় করে নিয়েছে ১৩৭.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আর বাইরের দেশে প্রায় ৪৯.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার- অর্থাৎ মোট ১৮৬.৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার! স্টার ওয়ার্স: দ্য লাস্ট জেডাই এর পরেই বক্স অফিসে থাকে তার অবস্থান, প্রথম দিনই জুমাঞ্জি আয় করে নেয় ৭.২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভ্যারাইটির ওয়েন গ্লাইবারম্যান রিভিউ করেছেন মুভিটি নিয়ে, “উত্তেজনাপূর্ণ! রোমাঞ্চকর! একদম শিশুসুলভ নিষ্পাপ! অ্যাকশনগুলো নির্ভুলভাবে যেন একের পর এক জোড়া লাগানো হয়েছে! জুমাঞ্জি: ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল বাদে আর কোথাও এর দেখা মেলে না।”
তবে এ মুভিটি মূলত ১৯৯৫ সালের জুমাঞ্জি মুভির সিকুয়েল, যেখানে অভিনয় করেছেন অকালপ্রয়াত রবিন উইলিয়ামস! আর সেই মুভির সাফল্যে ১৯৯৬ সালে শুরু হয় জুমাঞ্জি টিভি সিরিজ, যেটি বহু বছর পর্যন্ত বাংলাদেশে বিটিভি দেখিয়েছিল এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। টিভি সিরিজে জুডি ও পিটার নামের দুজন খেলোয়াড়ের অভিযানগুলো দেখানো হত। এ দুটো চিত্রায়ণ এবং এই আধুনিক জুমাঞ্জি: ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল সবগুলোরই সূচনা কিন্তু ১৯৮১ সালে। ক্রিস ভ্যান অলসভার্গ নামের একজন লেখক জুমাঞ্জি পিকচার বুক রচনা করেছিলেন। রবিন উইলিয়ামস ও ভ্যান অলসভার্গ দুজনেই বলেছেন যে, ‘জুমাঞ্জি’ শব্দের অর্থ জুলু ভাষায় ‘বহু প্রতিক্রিয়া’। জুমাঞ্জির আগের বইটির নাম ‘দ্য গার্ডেন অফ আব্দুল গাসাজি’ (১৯৭৯) এবং পরের বইটির নাম ‘বেন’স ড্রিম’। ‘দ্য গার্ডেন অফ আব্দুল গাসাজি’ বইটির জন্য লেখক Caldecott Honor পুরস্কার পান ১৯৮০ সালে।
‘জুমাঞ্জি: ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল’ ছবিটির জঙ্গলের দৃশ্য শুটিং করা হয় হাওয়াইতে। এছাড়া হনলুলুতেও হয়েছে শুটিং। ছবিটিতে স্পাইডারম্যান খ্যাত টম হল্যান্ডের অভিনয় করার কথা ছিল, কিন্তু স্পাইডার-ম্যান: হোমকামিং এর শুটিং নিয়ে ব্যস্ত থাকবার কারণে সেটা আর হয়ে ওঠেনি। রবিন উইলিয়ামস আত্মহত্যা করবার পর অনেকেই জুমাঞ্জি মুভির সিকুয়েল বানাবার বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন, কিন্তু নির্মাতারা আশ্বস্ত করেন যে, মুভিটিতে রবিন উইলিয়ামসের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো হবে।
রুবি চরিত্রের পোশাক মূলত টম্ব রেইডার খ্যাত লারা ক্রফটের পোশাক অনুযায়ী বানানো। জুমাঞ্জির বিখ্যাত অ্যালান প্যারিশের মেয়েও হতে পারেন রুবি, অন্তত অনেকেই এমনটা ধারণা করেছিলেন। অ্যালান প্যারিশ জুমাঞ্জিতে আটকা পড়েন ২৬ বছরের জন্য এবং জুমাঞ্জি মুভি ও টিভি সিরিজের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি চরিত্র। রুবি চরিত্রে অভিনয় করা ক্যারেন গিলানের অন্যতম প্রিয় মুভি ১৯৯৫ সালের জুমাঞ্জি। ১৯৯৫ সাল ও ২০১৭ সালের মুভি- দুটোতেই খলনায়ক চরিত্রে ভ্যান পেল্ট নামের একজন আছে। ববি ক্যানাভেল অভিনয় করেন এ চরিত্রে।
মজার ব্যাপার হলো, জুমাঞ্জি ছাড়াও ভ্যান অলসবার্গ আরেকটি বই লিখেছিলেন, মূলত জুমাঞ্জির সিকুয়েল হিসেবে। সেটির নাম যাথুরা (Zathura)। এখানেও আছে বোর্ড গেম, তবে এবার সেটা সায়েন্স ফিকশন বোর্ড গেম। এখানে খেলোয়াড়রা হারিয়ে যাবে কোনো এক সায়েন্স ফিকশন পটভূমিতে এবং জুমাঞ্জির মতোই গেম শেষ না করবার আগে তাদের মুক্তি নেই। এটিরও কিন্তু মুভি বেরিয়েছে! ‘Zathura: A Space Adventure’ নামের মুভিটি ২০০৫ সালে বের হয় এবং এখানে টোয়াইলাইট খ্যাত ক্রিস্টেন স্টুয়ার্ট অভিনয় করেছেন। তবে কাছাকাছি সময়ে হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য গবলেট অফ ফায়ার বের হবার কারণে মুভিটি ব্যবসায়িক সফলতার মুখ দেখতে পারেনি। এজন্য মুভিটিকে ‘ফ্লপ’ বিবেচনা করা হয়। তবে এমনিতে মুভিটির রিভিউ কিন্তু হ্যাঁ-সূচকই ছিল। একে ‘রবিন উইলিয়ামসবিহীন স্পেস জুমাঞ্জি’-ও ডাকা হয়েছিল।
আইএমডিবিতে ২০১৭ সালের জুমাঞ্জি ছবিটির রেটিং ১০ এ ৭.২ আর রটেন টমেটোজের টম্যাটোমিটারে স্কোর ৭৭% হলেও অডিয়েন্স স্কোর কিন্তু ৯০%! তবে আর দেরি কেন? এখুনি উপভোগ করুন ‘জুমাঞ্জি: ওয়েলকাম টু দ্য জাঙ্গল’ আর হারিয়ে যান গহীন অরণ্যে!
ফিচার ইমেজ: Desktop Wallpapers