মিডনাইট ইন প্যারিস হলো বৃষ্টিস্নাত শিল্পের শহরের কাছে আমার প্রেমপত্র।
– উডি অ্যালেন, ২০১১
মিডনাইট ইন প্যারিস নস্টালজিয়ায় বিভোর একজন লেখকের গল্প। সিনেমার প্রধান চরিত্র গিল পেন্ডার একজন সফল হলিউড চিত্রনাট্যকার। হলিউডে অর্থ এবং খ্যাতি এই দুটো জিনিসের দেখা পেলেও মনের সন্তুষ্টি তার নেই। তার ভাষ্যমতে, নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারছে না সে। তাই হলিউড চিত্রনাট্যের মতো লঘু জিনিসকে ত্যাগ করে সাহিত্যে পদার্পণ করতে চায় প্রথম উপন্যাস লেখার মাধ্যমে।
বিয়ের আগমুহুর্তে বাগদত্তা ইনেজ এবং তার বাবা-মাকে নিয়ে প্যারিসে ছুটি কাটাতে আসে গিল। এখান থেকেই শুরু হয় বিপত্তি। সিনেমাটির প্রথম সংলাপেই প্যারিস নিয়ে তার শিশুসুলভ উচ্ছ্বাস,
This is unbelievable!
Look at this!
There’s no city like this in the world.
There never was!
গিলের কাছে প্যারিস হচ্ছে স্বপ্নের শহর, বৃষ্টিতে যে শহর সুন্দরতম। কিন্তু তার ভবিষ্যৎ স্ত্রী সেই কল্পনার বেলুনে আলপিনের মতো। প্যারিস তার কাছে কোলাহলপূর্ণ, পুরাতন আর ট্রাফিক জ্যামের শহর। ইনেজের বাবা একজন ব্যবসায়ী এবং মায়ের ধ্যান-ধারণাও রক্ষণশীল। তারাও মনে করে গিলের উচিত হলিউডে থেকে যাওয়া। কিন্তু গিল মনে করে, বর্তমান সময়ের আমেরিকায় তার থাকার কথা না, তার আসলে থাকা উচিত ১৯২০ এর প্যারিসে। এ সময়ের প্যারিস অনেক কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বসেরা সঙ্গীতজ্ঞ, সাহিত্যিক, চিত্রকর আর ঔপন্যাসিকদের আনাগোনায় তখন মুখরিত ছিল পুরো প্যারিস। তার মতো যাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা আছে, তাদের কাছে ওই সময়টা একধরনের স্বপ্নের মতো।
একজন কল্পনাপ্রবণ আবেগী লেখকের সাথে জড়বাদী কাছের মানুষগুলোর এই যে দূরত্ব এবং নস্টালজিয়া, এ দুটো বিষয়কেই বলা যায় এই সিনেমাটির মূল ভিত্তি। যেকোনো আত্মভোলা মানুষের জন্যই এ ব্যাপারটি সত্যি। মানুষের মধ্যে কেন কাজ করে নস্টালজিয়া, তার একধরনের ব্যাখ্যা দেওয়া আছে এই সিনেমায়। বর্তমানের হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য অনেকেই বর্তমানকে অস্বীকার করে অতীত নিয়ে ফ্যান্টাসির মধ্যে থাকে এবং মনে করে অতীতের সবকিছুই বর্তমান থেকে উৎকৃষ্ট। আর এই ফ্যান্টাসি বর্তমান সময় আর মানুষের সাথে তাদের দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়।
গিলের সাথে ইনেজের দূরত্ব আরো প্রবল হয় যখন কিনা ইনেজের বন্ধু পল এবং ক্যারোলের আবির্ভার ঘটে পর্দায়। ইনেজ মনে করে, অনেক কিছু সম্পর্কে পলের অগাধ জ্ঞান, কিন্তু সে গিলের মতো আত্মভোলা নয়। অবশ্য গিল তাকে একজন নীতিবাগীশ স্যুডো-বুদ্ধিজীবী ছাড়া আর কিছুই মনে করে না। পলের সাথে গিলের দ্বন্দের এই পুরো ব্যাপারটার পিছনে হয়তো কাজ করেছে সহজাত ঈর্ষা, যার কারণ পলের প্রতি ইনেজের একধরনের দুর্বলতা। প্রেম-ভালোবাসার এই জটিল বিষয়গুলো উডি অ্যালেনের চোখ এড়ায় না কখনো এবং মিডনাইট ইন প্যারিসেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
একরাতে মাতাল অবস্থায় ইনেজের সাথে অভিমান করে প্যারিসের রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে গিল এবং অতি স্বাভাবিকভাবেই পথ হারিয়ে ফেলে। হোটেল খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে একপর্যায়ে সে একটি চার্চের সিড়িতে বসে পড়ে। রাত গভীর হওয়ার সাথে সাথে সামনের রাস্তা ফাঁকা হয়ে আসে ক্রমশ।
তখনই বেজে ওঠে ঘন্টা, ঢং… ঢং… ঢং…। ঘড়ির কাঁটায় রাত তখন ঠিক ১২টা।
একদম চকচকে নতুন একটি পিজো গাড়ি এসে থামলো তার সামনে। গাড়ির ভিতরের সবাই প্রচুর হৈ-হুল্লোড় আর পার্টি করছে এবং তাকেও ডাকছে তাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য। মোহাচ্ছন্ন গিল সেই আহবানে সাড়া দিয়ে চড়ে বসে গাড়িতে। কোথায় যাচ্ছে তারা?
আমরা বরং এখানেই থামি। শুধু বলে রাখি, সেই ১৯২০ সালের স্বপ্নের প্যারিস কোনো একভাবে গিলের কাছে ধরা দেয়। তার বর্তমানকে কুয়াশার চাদরের মতো গ্রাস করে নেয় মধ্যরাতের মায়াবী প্যারিস। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, পাবলো পিকাসো এবং তার প্রেমিকা আদ্রিয়ানা, স্কট ফিটযেরাল্ড এবং জেলডা ফিটযেরাল্ড, কোল পোর্টার, সালভাদর ডালি, লুই বুনয়েল, পল গঁগ্যা, মান রে, এডগার ডেগাস, টি. এস. এলিয়টের মতো শিল্পী; যারা গিলের স্বপ্নের প্যারিসের কিংবদন্তী- তাদের মোহময়তায় জড়িয়ে পড়ে গিল।
মিডনাইট ইন প্যারিস কোনো সায়েন্স ফিকশন নয়, ফ্যান্টাসি। উডি অ্যালেনের মতো শুধু এটুকুই বলে দেওয়া যায়,
Something magical happens around midnight
গিল কখনো কি অতীতের মোহ থেকে এত মায়া কাটিয়ে ফিরে আসতে পারবে বাস্তবে? এ উত্তরটি জানার জন্য হলেও দেখতে পারেন এই সিনেমাটি।
অন্যান্য
উডি অ্যালেনের সিনেমার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তার প্রতিটি সিনেমাতেই একজন করে উডি অ্যালেন থাকে এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তা প্রধান চরিত্রে। সময়ের সাথে সাথে পর্দার সামনে যদিও তার উপস্থিতি কমে আসছে, তারপরও এই সিনেমাটিতে তার স্থান পূরণ করেছেন ওয়েন উইলসন। প্রচলিত উডি অ্যালেন থেকে বেরিয়ে গল্পের প্রধান চরিত্রকে নিজের মতো করে উপস্থাপন করেছে সে। সিনেমাটি দেখলে অনেকেরই হয়তো মনে হবে, এই চরিত্রে ওয়েন উইলসন ছাড়া আর কাউকেই ঠিক মানাতো না। দর্শকদের এরকম মনে হওয়াটাই যেকোনো অভিনেতার অভিনয়ের সার্থকতা।
ইনেজ চরিত্রে র্যাচেল ম্যাকঅ্যাডামস এর সাবলীল অভিনয় ছিল অসাধারণ এবং এর সাথে তার ভুবনভোলানো হাসি তো আছেই। এছাড়া আলাদাভাবে নজর কেড়েছে কোরি স্টলের অভিনয়। একটি বিশেষ চরিত্রে আছেন ফ্রান্সের সাবেক ফার্স্ট লেডি কার্লা ব্রুনি। এছাড়া বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন দ্য পিয়ানিস্ট খ্যাত অভিনেতা অ্যাড্রিয়ান ব্রডি, টম হিডেলস্টন, অ্যালিসন পিল, মাইকেল শিন, মারিয়ন কোতিয়্যা, ক্যাথি বেটস সহ আরো অনেকে।
মিডনাইট ইন প্যারিস হচ্ছে উডি অ্যালেনের ৪১ তম সিনেমা এবং তার সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমাগুলোর একটি। কিন্তু সিনেমাটিকে যতগুলো বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় তার মধ্যে ‘ব্যবসাসফল’ শব্দটি উপরের দিকে থাকার কোনো কারণ নেই। উডি অ্যালেনের সব সিনেমা পছন্দ করেছেন এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুস্কর। বিতর্কিত ব্যক্তিগত জীবনের কারণে তার সিনেমা বর্জনের ঘোষণাও দিয়েছেন অনেকে।
এছাড়া সমালোচনা কিংবা জনপ্রিয়তা- কোনো দিক দিয়েই তার সিনেমার গ্রাফ ঠিক স্থিতিশীল নয়। তার বেশ কিছু সিনেমা সমালোচকদের প্রশংসা যেমন পেয়েছে, তেমনি আবার সিনেমার কিছু স্পর্শকাতর বিষয় বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছে। কোনো সিনেমা বক্স অফিসে অনেক সফল, আবার কোনোটি একেবারে ব্যর্থ। কিন্তু অনেক সমালোচকই মনে করেন, মিডনাইট ইন প্যারিস সম্ভবত উডি অ্যালেনের সেরা কাজ। ব্যক্তি উডি অ্যালেনের সাথে কারো বিরোধ থাকলেও, তার এই সৃষ্টির সৌন্দর্য নিয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা না।
কান চলচ্চিত্র উৎসবের বাঘা বাঘা সমালোচক থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক সবার মন জয় করেছে এই সিনেমা। প্রয়াত মার্কিন চলচ্চিত্র সমালোচক রজার এবার্ট মিডনাইট ইন প্যারিস সম্পর্কে বলেছিলেন,
এই সিনেমাটিকে অপছন্দের কিছু নেই। হয় এটা তোমার জন্য অথবা এটা তোমার জন্য না। আমি সেসব সিনেমা দেখতে দেখতে ক্লান্ত যেগুলো ‘সবার জন্য’। আসলে ওই সিনেমাগুলো কারো জন্যই না। মিডনাইট ইন প্যারিস আমার জন্য এবং এটাই আমার জন্য যথেষ্ঠ।
অসাধারণ সিনেমাটোগ্রাফি, সংলাপ, ক্লাসিক মিউজিক আর অ্যালেনের ট্রেডমার্ক হিউমারের জাদু সবই আছে এখানে। এছাড়া এই সিনেমার ইরানিয়ান-ফ্রেঞ্চ সিনেমাটোগ্রাফার দারিয়াস খোন্দজির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন অনেকেই। এই সিনেমার ফটোগ্রাফিতে আছে একধরনের উষ্ণ লালচে আবহ, যেটি উডি অ্যালেনের ব্যক্তিগত পছন্দ এবং এটিই তার প্রথম সিনেমা যেটি কিছু ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেছে। খুব কম সিনেমাতেই প্যারিসের সৌন্দর্যকে এত সুন্দরভাবে পর্দায় উপস্থাপন করা হয়েছে।
অবশ্য লোকেশনের সৌন্দর্য দিয়ে দর্শকদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখার কাজটি উডি অ্যালেন এর আগেও করেছেন। ১৯৭৯ সালে তার আরো একটি বিখ্যাত সিনেমা ‘ম্যানহাটন’ এর কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রতিবারই বোধহয় একেকটি ইউরোপিয়ান শহরের প্রেমে পড়েন তিনি। ম্যানহাটনের মতোই মিডনাইট ইন প্যারিস সিনেমাটি শুরু হয় সাড়ে তিন মিনিট ধরে প্যারিসের বিখ্যাত কিছু জায়গা প্রদর্শনের মাধ্যমে যাতে সিনেমা শুরুর আগেই দর্শকরা প্যারিসের স্বাদ পায়। বলা যায়, এই সিনেমায় প্যারিসও একটি চরিত্র। যাদের মধ্যে প্যারিস নিয়ে কোনো ফ্যান্টাসি নেই তারাও হয়তো বাধ্য হবেন প্যারিসের প্রেমে পড়তে।
৮৪ তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড কিংবা অস্কার এর জন্য সেরা পরিচালক এবং চিত্রনাট্য সহ মোট চারটি ক্যাটাগরিতে মনোনীত হয়েছিল এই মিডনাইট ইন প্যারিস। এর মধ্যে চিত্রনাট্যের জন্য অস্কার জিতে নেন উডি অ্যালেন। এছাড়া আরও অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন এই সিনেমার চিত্রনাট্যের জন্য। চিত্রনাট্য লেখার জন্য উডি অ্যালেন সাহায্য নিয়েছিলেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ের A Moveale Feast নামক একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থের, যেখানে এই লেখক ১৯২০ সালের দিকের প্যারিসে তার লেখালেখির কঠিন দিনগুলোর কথা তুলে ধরেছেন।
যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, মিডনাইট ইন প্যারিসের বিশেষত্ব কী? তাহলে বলতে হয়, এই সিনেমা কখনোই আপনার মন থেকে মুছে যাবে না, চোখে লেগে থাকবে প্যারিসের সৌন্দর্য।
৯৪ মিনিটে এই সিনেমা শেষ হয়ে গেলেও তার রেশটুকু থেকে যাবে। হঠাৎ কোনো একদিন মনে হবে রাতের প্যারিসের কথা, এই সিনেমার চরিত্রগুলোর কথা। গিলের মতো যদি হারিয়ে যাওয়া যেত ওই যাদুর শহরে!
সিনেমা: মিডনাইট ইন প্যারিস (Midnight In Paris)
পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার: উডি অ্যালেন
জঁনরা: কমেডি, ফ্যান্টাসি, রোমান্স
ফিচার ইমেজ : MovieWeb