মনে করুন, আপনি একটি সিনেমা দেখছেন। সিনেমার নায়িকাকে কোনো দোষ না থাকা সত্ত্বেও দোষারোপ করা হচ্ছে, অত্যাচার করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি দেখে আপনিও কষ্ট পাচ্ছেন তার অবস্থা ভেবে। ভাবছেন এবং অনুভব করছেন, যেন নিজেই ঐ পরিস্থিতিতে পড়েছেন, তবে সেই পরিস্থিতিতে ডুবে যাচ্ছেন না, এমন আচরণ হলো সহমর্মিতা। সহমর্মিতা আপনার ভেতর তখনই কাজ করবে যখন আপনি ভালো মানসিক অবস্থায় থাকবেন। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ব্যক্তি নিজে যখন মন্দ অভিজ্ঞতা বা নেতিবাচক অনুভূতির মধ্য দিয়ে যায় তখন তার সহমর্মিতা বা সমবেদনা প্রকাশের ক্ষমতা কমে যায়। মস্তিষ্ক তার কার্যাবলীতে পরিবর্তন আনে!
এই যে অন্যের কষ্টকে নিজে অনুভব করার বিষয়টি, একটু খেয়াল করে ভাবলে বুঝতে পারবেন এটি কোনো এক পূর্ব অভিজ্ঞতার প্রভাবেই ঘটছে। ধরুন, আপনি একটি কাল্পনিক বাগান তৈরি করছেন। সেক্ষেত্রে অবশ্যই বাগানের ফুলগুলোকেও সত্য বলেই ভাববেন। তবে ফুলের পরিবর্তে আপনি যদি আগাছা নিয়েও কল্পনা করতে থাকেন, তাহলে বুঝতে হবে আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতা আগাছা দ্বারা প্রভাবিত। আর এ কারণেই মানুষ সহজেই অন্যের জায়গায় নিজেকে আবিষ্কার করতে পারে এবং অন্যের প্রতি সহমর্মী হতে পারে। বিষয়টিকে মানুষের প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যও বলা চলে। শুধু তা-ই নয়, অন্যকে কষ্ট পেতে দেখলে আমাদের মস্তিষ্কের ঐ অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত এলাকাও সক্রিয় হয়ে ওঠে।
কতটুকু সহমর্মিতা অনুভব করা যায়?
এখন আসা যাক মানুষ কখন কতটুকু সহমর্মিতা অনুভব করে। সহমর্মিতার মাত্রা আমাদের আবেগ-অনুভূতির উপর নির্ভর করে। সোজা কথায়, অন্যের প্রতি কীভাবে সাড়া দেব তা আবেগীয় অনুভূতির ভিন্নতায় মস্তিষ্কের কার্যক্রম পরিবর্তিত হয়, এমনকি অন্য কেউ কষ্টে থাকলে তখনও। এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মনের ভাব মানুষের আচরণকে নানা প্রকারে প্রভাবিত করে। ভেবে দেখুন, যখন ভালো মেজাজে থাকেন তখন স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা হয়, আবার মন ভালো না থাকলে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে খাদ্য গ্রহণ (অতিরিক্ত খাওয়া বা কম খাওয়া, নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন ইত্যাদি) করে থাকে। এতে করে কিন্তু মন ভালো বা খারাপ হয় না, বরং শরীরের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ে, ফলে মনে আরও খারাপ অনুভূতির সৃষ্টি হয়। সর্বোপরি, যখন খুব মন খারাপ লাগবে, মনমরা লাগবে, তখন এর প্রভাব আশেপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৭ সালের একটি গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে, এই প্রভাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে।
এবার একটু ইতিবাচক মানসিক অবস্থার দিকে নজর দেওয়া যাক। যখন কেউ ভালো মানসিক অবস্থায় থাকে তখন আবেগগুলোও অনেক বেশি শক্তিশালী থাকে। ফলে খুশিমনে থাকাকালীন কোনো ব্যথা পেলেও সেটির কষ্টদায়ক অনুভূতি কম অনুভূত হয়। আবার মনমরা থাকলে ব্যথাগুলো যেন বেশি অনুভব করা যায়। এই বিষয়টি কিন্তু বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। যেমন- ৩/৪ বছর বয়সের বাচ্চারা খেলতে খেলতে যদি নিজে হঠাৎ করে ব্যথা পায় তাহলে কাঁদে না, কিন্তু অন্য কেউ ফেলে দিলে বা খেলতে ইচ্ছা না করলে বা অপছন্দনীয় কারও সামনে থাকলে খুব কান্না করে, যেন ব্যথাটা একটু বেশি পেয়েছে।
২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে আরেকটি গবেষণা প্রকাশিত হয়, যেখানে দেখানো হয়েছে, যখন আমাদের মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না, তখন তা অন্যের দুঃখে সাড়া দেওয়ার সহজাত সামর্থ্যকে (সহমর্মিতা) প্রভাবিত করে। এই গবেষণায় একদল অংশগ্রহণকারীর পায়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকারক যন্ত্র লাগিয়ে দেয়া হয় যেন তারা কষ্ট অনুভব করেন। এর পাশাপাশি তাদেরকে ইতিবাচক এবং একটি নেতিবাচক (অন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে এমন) কিছু সিনেমার অংশ দেখানো হয়। অংশগ্রহণকারীদের মস্তিষ্ককে একটি স্ক্যানারের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ করা হয়। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, নিজের কষ্টানুভূতি অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের ক্ষমতাকে দমিয়ে রাখে!
অনেকটা এরকরমই আরেকটি গবেষণা করে ঐ গবেষক দল। এ গবেষণায় দেখা যায়, একটি নেতিবাচক সিনেমার দৃশ্য দেখানোর পর কারও ভাবভঙ্গিতে নিরপেক্ষ আবেগের প্রকাশ হলেও সেটিকে অনেক বেশি নেতিবাচক হিসেবে দেখেন। এসকল গবেষণার ফলাফল থেকে বাস্তব জীবনের অনেক কিছুই ব্যাখ্য করা সম্ভব। যেমন, শক্তিধর একজন ব্যক্তি, ধরা যাক কোনো একটি অফিসের মালিক, তিনি যদি নিজের জীবনে খারাপ সময় অতিবাহিত করে থাকেন, বা গবেষণাগুলোর মতো কোনো নেতিবাচক সিনেমা দেখেন, ঐ ব্যক্তিটি তার কর্মচারীদের দুঃখ-কষ্টগুলো কিন্তু বুঝতে চাইবেন না, বরং তাদেরকে খারাপ ভাবতে শুরু করবেন। একটু ভেবে দেখলে এমন অনেক পরিস্থিতি আপনি নিজে উদাহরণ হিসেবে পেয়ে যাবেন। অর্থাৎ, আমাদের মন খারাপ আসলেও অন্যদেরকে গ্রহণে এবং অনুধাবনে বাধা সৃষ্টি করে। আবার যারা দুশ্চিন্তা এবং উদ্বিগ্নতার রোগী, তারা নিজেরা এতটাই নেতিবাচক আবেগের ভেতর দিয়ে যান যে তারা অন্যকে বোঝার চেষ্টা না করে নিজেদের সমস্যাগুলোর দিকে কেন্দ্রীভূত থাকেন।
গবেষণাগুলোর ফলাফলের আরও কিছু ব্যখ্যা সহজেই পাওয়া যায়। যেমন- যাদের ভেতর সহমর্মিতা কম, তারা খুবই কম দান করেন (বিশেষত অর্থ অনুদান)। মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, নিজস্ব সামাজিক গন্ডির বাইরের কারোর প্রতিও আমরা কম সহমর্মী (যেমন- অন্য দলের খেলোয়াড়দের প্রতি)।
কেন এমন হয়?
নেতিবাচক আবেগগুলো সহমর্মিতা কমিয়ে ফেলার এই বিষয়টিকে বলা হয় ‘সহমর্মিতার পীড়া’, যেখানে নিজের সাথে মন্দ কিছু ঘটে থাকলে অতিরিক্ত আবেগে ব্যক্তিটি নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। ফলে সে প্রথমেই সর্বাত্মক চেষ্টা করে নিজেকে রক্ষা করতে (নিজের নেতিবাচক অনুভূতিগুলোকে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা নয়)। এই ধরনের পীড়াই প্রাকৃতিকভাবে ব্যক্তির সহমর্মিতার মাত্রাকে কমিয়ে দেয়।
একটু স্নায়বিক ব্যাখ্যা দেওয়া যাক। যখন একজন ব্যক্তি ব্যথা পায় বা বেদনা অনুভূত হয় বা মানসিক পীড়ায় ভোগে, তখন একটি নির্দিষ্ট নিউরাল সার্কিট সক্রিয় হয়ে ওঠে। স্নায়ুবৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অন্য কাউকে ব্যথা বা বেদনায় দেখলেও ঐ একই সার্কিটই সক্রিয় হয়। তাই অন্যকে কষ্ট পেতে দেখলেও আমরা কষ্ট পাই, সহমর্মিতা প্রকাশ করি। এখন, যদি নিজেরা কষ্টের মধ্য দিয়ে যাওয়ার সময় আবার অন্য কারও কষ্ট দেখা হয় তখন নিজের কষ্টের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়ে আবেগে এবং মন্দ অনুভূতিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে। তখন অন্যের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের পরিবর্তে ব্যক্তি নিজেই কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়। এই কারণেই বলা হচ্ছে, মন্দ অনুভূতি সহমর্মিতা হ্রাস করে।
মন্দ অনুভূতি এবং সহমর্মিতার ভারসাম্য রাখা সম্ভব
একটু সচেতন হলেই এই ভারসাম্য আনা সম্ভব। সহমর্মিতার মূল কথাই হলো অন্যের ক্ষতকে অনুধাবন করা, ডুবে যাওয়া নয়। তাই সচেতন হয়ে নিজের অনুভূতিগুলোকে কাজে লাগাতে হবে যেন অন্যের কষ্টে নিজে ডুবে না যায়। এতে করে নিউরাল সার্কিট অতি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং ব্যক্তিও মাত্রাতিরিক্ত আবেগে নিমজ্জিত হবে না। আর অন্যের প্রতি সঠিক মাত্রায় সহমর্মিতা প্রদর্শনও সম্ভব হবে।
ফিচার ইমেজ- npr.org