দিদ্যালুস আর ইকারাসের সেই মিথেরও আগে থেকে মনে হয় মানুষ পাখির মতো হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করছে। তাই বহুদিন ধরে পাখির নকশা দেখতে দেখতে ডা ভিঞ্চির সেই অরনিথপ্টার কিংবা জর্জ কেইলি তাদের বিমানের নকশা করেন। এরপর রাইট ব্রাদার্সের মতো যুগান্তকারী সব উদ্ভাবকের হাত ধরে এসেছে আজকের যুগের বিমান।
পাখিকে দেখে যে শুধু বিমান হয়েছে তা নয়। ১৯৮৯ সালে জাপানের শিনকানসেন বুলেট ট্রেনে এক সমস্যা দেখা দিলো। ট্রেন যেহেতু অনেক দ্রুত (১৬৭ মাইল/ঘন্টা) যাতায়াত করে, তাই কোনো সুড়ঙ্গের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় বাতাসের সংকোচনের জন্য অনেক জোরে চারিদিকে শব্দ ছড়িয়ে পড়তো। এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পড়লো ইঞ্জিনিয়ার এইজি নাকাতসুর উপর। তিনিও ছিলেন পাখি প্রেমিক। তার মূল অনুপ্রেরণা ছিলো মাছরাঙা পাখি। মাছরাঙা যেভাবে তার ঠোঁট এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে (বায়ু থেকে পানিতে) নিঃশব্দে নিয়ে যায়, ঠিক তেমনভাবেই তিনি ট্রেনের সামনের অংশ নকশা করলেন যেন বাতাসকে সহজে ভেদ করে যেতে পারে ট্রেনটি। এছাড়াও ট্রেনের কিছু অংশ নকশা করলেন পেঁচার ডানা আর পেঙ্গুইনকে দেখে। ব্যাস, হয়ে গেলো সমস্যা সমাধান!
অদ্ভুতভাবে হলেও আজকের যুগের সবচেয়ে আশ্চর্য সব উদ্ভাবনগুলো এসেছে প্রকৃতির ছোঁয়া থেকে। এভাবে প্রকৃতিকে মডেল ধরে বিভিন্ন জিনিস নকশা করার বিষয়কে বলে বায়োমিমিক্রি। এরকম কাজ বহুদিন ধরে হয়ে আসলেও শব্দটি মূলত জনপ্রিয় হয়েছে জেনিন বেনয়ূসের বই ‘Biomimicry: Innovation Inspired by Nature‘ থেকে। তার বইয়ে তিনি প্রকৃতির অদ্ভুত সব উদাহরণ দিয়েছেন। তার মতে, আজ আমরা বিভিন্নভাবে যে পরিবেশ দূষণ করে চলেছি কিংবা ছোট কাজে অনেক বেশি ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে চলেছি, সেটা প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিলে অনেকাংশেই কমানো সম্ভব। আজ আমরা সামান্য উৎপাদনের কাজে মেকানিক্যাল, ইলেক্ট্রিক্যাল, কম্পিউটার- হেন কোনো দিকের প্রকৌশলী বাকি রাখি না। কিন্তু কোনো জীববিজ্ঞানীকে দলে রাখা হয় না। তবে মনে রাখা উচিত, আমরা আজ যে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালাচ্ছি, পরিবেশ দূষণ করে চলেছি, প্রকৃতি এ জাতীয় উৎপাদন আরো বহু আগে আরো অনেক কার্যকরীভাবে করে আসছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে না হলেও একটু চিন্তা করলে দেখবো প্রকৃতি কীভাবে আমাদের ছেড়ে দেয়া কার্বন ব্যবহার করে সালোকসংশ্লেষণ করে চলেছে, দিনের পর দিন বায়ু থেকে পানি নিয়ে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে বড় বড় বন জঙ্গলও বানিয়ে চলেছে। আর এসব হচ্ছে খুব নীরব প্রক্রিয়াতে। আজ সামান্য মোবাইল ফোন বানাতে হাজার হাজার কঠিন সব ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করে চলেছি। কিন্তু প্রকৃতিতে বেশিরভাগ জীব হয় মূলত পাঁচ ধরনের যৌগ দিয়ে। আর এজন্য জেনিন ও তার প্রতিষ্ঠান আরো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করে চলেছেন এগুলোকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে। তার ওয়েবাসাইটে এর অসংখ্য সব উদাহরণ দেয়া আছে।
কার্বন থেকে উদ্ভাবন
কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবেশের জন্য খুব খারাপ, তাই না? কিন্তু গাছ বা বিভিন্ন প্রাকৃতিক জিনিস তো একেই কাজে লাগায়। তাই নভোমার নামে এক কোম্পানি এই জ্ঞান কাজে লাগিয়েই কার্বন থেকে প্লাস্টিক বানাচ্ছে, আবার নিউলাইট নামে আরেক কোম্পানি মিথেন থেকে প্যাকেজিং দ্রব্য আর আসবাবপত্র বানাচ্ছে।
আচ্ছা, তো এবার আসা যাক কংক্রিটের কথায়। এর উৎপাদনের জন্যই সবচেয়ে বেশি কার্বন নির্গত হয়। কিন্তু ব্লু প্ল্যানেট নামক এক কোম্পানি অনুপ্রেরণা নেয় কোরাল থেকে। কোরাল যেরকম কংক্রিটের মতো কাজ করে, তারাও কোরাল বানানোর পদ্ধতি থেকে কংক্রিটের উপাদান বানায়, যার জন্য কার্বন নির্গমন প্রায় অর্ধেক কমে যায়।
প্রকৃতির নির্লবণীকরণ প্রক্রিয়া
প্রকৃতিতে বলতে গেলে কোনো প্রাণীই লবণাক্ত পানি ব্যবহার না করলেও থাকে লবণাক্ত পানির মধ্যেই। তাহলে পানিকে লবণ মুক্ত করে কীভাবে? কিংবা অন্য সব পদার্থ মুক্ত করে কীভাবে? তারা অসমোসিস প্রক্রিয়া কাজে লাগায়, আবার তাদের অন্যরকম নকশার জন্য দেখা যায় এসব ময়লা এমনিতেও দূর হয়ে যায়। একুয়াপোরিন নামে এক কোম্পানি এসব নকশা কাজে লাগাচ্ছে। আর ফরোয়ার্ড অসমোসিস নামে এক প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে পানি শোধন করছে। এটা যেমন একটা নীরব প্রক্রিয়া, তেমনি এর থেকে অনেক দ্রুত পানি শোধন সম্ভব হচ্ছে।
কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালের বিজ্ঞান
কাছিম, শামুক বা কাঁকড়ার খোলসের শক্তি দেখে কি আপনার অবাক লাগে না? কিন্তু এগুলো তো আমাদের জানা বস্তুগুলো দিয়ে বানানো না, তাই না? তাই এসব নিয়ে গবেষণা করছেন ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির ডেভিড ক্যাসইলাস। এরকম প্রাকৃতিক যৌগ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে যেমন নতুন উপাদান বানানো হচ্ছে, তেমনি তাদের নকশাগুলো থেকে এক যৌগকেও আরো ভালো মতো ব্যবহার করা হচ্ছে, যা ব্যবহৃত হচ্ছে শেইপ মেমোরি অ্যালয়, বিভিন্ন কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল ইত্যাদি বানাতে। এরা যেমন অনেক শক্তিশালী, তেমনি অনেক পরিবেশবান্ধব।
প্রকৃতি থেকে স্থাপত্যে
মাঝে মাঝে অদ্ভুত লাগে না কীভাবে মোমাছিরা মৌচাক বানায়, ভীমরুল বাসা বাঁধে কিংবা কীভাবে মথ হয়? চারপাশের এই প্রকৃতি থেকে অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে তা কাজে লাগাচ্ছে স্থাপত্যকর্মে। বেইজিং অলিম্পিকের বার্ড নেস্ট কিংবা সিঙ্গাপুরের সুপার ট্রিগুলো আসলে প্রকৃতি থেকে আলাদা করাই যেন কঠিন আজ।
এমআইটি মিডিয়া ল্যাবে নেরি অক্সম্যন ও একদল গবেষক এরকম সব উপাদান থেকে আসবাবপত্র, জামাকাপড় থেকে শুরু করে বাড়িঘর সবই বানাচ্ছে। আর শুধু যে প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা তা-ই নয়, প্রকৃতির সাথেও তারা কাজ করে চলছেন। কম্পিউটার সায়েন্স, রোবটিক্সের মতো বিষয়গুলো ব্যবহার করে তারা জটিল সব আকৃতির ভবন যেমন বানাচ্ছেন, তেমনি কিছুদিন আগে অনেকগুলো রেশমগুটি ব্যবহার করে তারা বানালেন ছোটখাট এক প্যাভিলিয়ন।
প্রকৃতি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আর রোবটিক্স
রোবটিক্সের উদাহরণ মনে হয় আর না দিলেও চলবে। বোস্টন ডায়নামিক্সের চিতা বা কুকুরের মতো রোবটগুলো আমরা অনেকেই দেখেছি। কিন্তু এছাড়াও আরো জটিল সব গবেষণা চালাচ্ছেন আজ বিজ্ঞানীরা।
পিঁপড়া, মৌমাছি জাতীয় প্রাণীরা কীভাবে সংঘবদ্ধভাবে বাসা বানায় কিংবা চলাচল করে তা দেখে রোবটিক্সের এক নতুন শাখা ‘সোয়ার্ম রোবোটিক্স’ এর কাজ চালানো হচ্ছে। সেখানে এই সংঘবদ্ধ চলাফেরাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন বড় কাজ করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
আসলে কম্পিউটার বিজ্ঞানে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা বহুদিন থেকে চলে আসছে। স্টিফেন উলফ্রাম তার নিউ কাইন্ড অফ সায়েন্স বইতে এ জাতীয় অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। যারা সামান্য কম্পিউটার গ্রাফিক্সে কাজ করেন, তাদের কীভাবে রিকারশন ব্যবহার করে বিভিন্ন ফ্র্যাক্টাল ডিজাইন করতে হয় তা শেখা লাগে। তাছাড়া বিবর্তনের আচরন বা মস্তিষ্কের গঠন থেকে নিউরাল নেটওয়ার্ক বা বিভিন্ন অ্যালগরিদমই আজ সর্বত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। আর এগুলোকে টুল হিসেবে ব্যবহার করে যখন আমরা নতুন সব কম্পোনেন্ট বানাতে যাচ্ছি, তখন দেখি আমরা আবার সেই প্রকৃতির নকশার দিকেই ফিরে যাচ্ছি। অটোডেস্ক রিসার্চের বিজ্ঞানীরা যখন হাজার হাজার সিমুলেশন করে সেরা ড্রোন বা গাড়ির নকশা বের করার চেষ্টা করছিলেন, তখন দেখলেন, সেগুলো আবার এই প্রকৃতির বস্তুর মতোই হয়ে আসছে। ড্রোনের ডিজাইন দেখতে হলো অনেকটা কাঠবিড়ালির মতো। আবার গাড়ির চেসিসের ডিজাইন এমন অদ্ভুত, যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বানানো সম্ভব না।
বায়োমিমিক্রি বিজ্ঞানের খুব নতুন একটি শাখা। বহুদিকে এর প্রসার আছে। ধীরে ধীরে আমরা আরো এরকম গবেষণা পাবো। আসলে প্রকৃতিকে দূরে রেখে নয়, বরং প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমেই আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর সমাধান বের হয়ে আসবে। জীবন যেমন হয়ে যাবে অনেক সহজ, তেমনি দূষণের মাত্রাও কমবে অনেক।