চারিদিকে প্রচণ্ড বিদঘুটে গন্ধ। এর তীব্রতা চারপাশে ছড়াচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, এটি মৃত্যুর গন্ধ। চারিদিকে, খোলা মাঠের ওপর, জঙ্গলের ভেতরে, মাটির গর্তের ভেতর রয়েছে পচিত, গলিত মানুষের মরদেহ। সেখান থেকেই বের হয়ে আসছে এই গন্ধ। কোনো কোনো মরদেহ মাত্র এনে রাখা হয়েছে, আবার কোনো মরদেহ এক থেকে দেড় বছর ধরে পড়ে আছে। এমনি সব দৃশ্যের দেখা মেলে বডি ফার্মগুলোতে।
বডি ফার্ম কী?
বডি ফার্ম বলতে মূলত এমন গবেষণাগারগুলোকে বোঝায়, যেখানে মৃতদেহ ডিকম্পোজিশন বা পচনের জন্য বিভিন্ন অবস্থায় রেখে দেওয়া হয়। মৃতদেহগুলোকে কখনও খোলা মাঠে রেখে দেওয়া হয়, কখনও বা রাখা হয় একটি খাঁচার ভেতর। মাঝে মাঝে পরীক্ষামূলকভাবে পানির নিচে রেখে দেওয়া হয়। মৃতদেহের ক্ষয় পর্যবেক্ষণের জন্য বডি ফার্মগুলোর উৎপত্তি।
যদিও আগে থেকেই মানবদেহের ওপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে, মানব দেহের বিভিন্ন জটিল রোগের সমাধান করা হয়েছে, কিন্তু মৃত্যুর পর দেহের ক্ষয় এবং পচে যাওয়া নিয়ে মানুষের ধারণা ছিল না, কিংবা থাকলেও খুব কম ছিল। এর একটি বড় কারণ হলো- আমরা মৃত্যুর পরে মানবদেহ যেসব বিভীষিকাময় অবস্থার মধ্যে দিয়ে যায়, তা ভাবতে চাই না। তবে ধীরে ধীরে এটি কিছু বিজ্ঞানীর আগ্রহ এবং গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
১৯৭০ এর দশকে ফরেনসিক চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এমন ধরনের একটি গবেষণাগারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। এর আগে সাধারণত শূকরের মৃতদেহের পচন থেকে মানুষের মৃতদেহের পচন সম্বন্ধে ধারণা করা হতো। বর্তমানে যেসব দেশে কোনো বডি ফার্ম নেই, সেখানে এখনও শূকরের মৃতদেহের পচনের ওপর নির্ভর করে ফরেনসিক বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন অপরাধের মীমাংসা করে থাকেন।
বডি ফার্মের ইতিহাস
১৯৮১ সালে ড. উইলিয়াম বেসের হাত ধরে আমেরিকার নক্সভিলের টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম বডি ফার্মের উৎপত্তি ঘটে। এর পেছনে রয়েছে একটি ঘটনা।
পুলিশ দেখতে পায়, আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়কার কর্নেল উইলিয়াম শাইয়ের কবরটি বেশ ক্ষতিগ্রস্ত এবং সেখানে একটি তাজা লাশ রাখা। তখন তারা মনে করে, কেউ একজন তার অপরাধ লুকানোর জন্য কাউকে খুন করে সেই পুরাতন কবরে রেখে দিয়েছে, যাতে করে কেউ তার ওপর সন্দেহ না করে। সেই লাশটি যাচাই করার জন্য বেসের কাছে পাঠানো হয়। বেসও ধারণা করেন লাশটি নতুন এবং সেটি এক বছরের বেশি পুরনো নয়। তবে লাশটির নখ এবং কাপড়ের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা যায়, লাশটি উইলিয়াম শাইয়েরই। তার মৃতদেহ একটি শক্ত করে আটকানো লোহার কফিনের ভেতর সংরক্ষিত ছিল।
এই ঘটনার পর থেকেই বেস উপলব্ধি করতে পারেন, মানুষের মৃতদেহের পচন নিয়ে বিস্তর গবেষণা দরকার। এই দরকারকে বাস্তবায়িত করার জন্য তিনি টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১.৩ একর জমির ওপর প্রথম বডি ফার্ম গড়ে তোলেন।
বর্তমানে সমগ্র বিশ্ব জুড়ে মোট ৮টি বডি ফার্ম রয়েছে। এর মধ্যে ৭টি আমেরিকায় এবং ১টি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে। আমেরিকায় যথাক্রমে ক্যারোলাইনা, টেক্সাস, ইলিনয় ও কলোরাডোতে রয়েছে ৬টি বডি ফার্ম, যার মধ্যে ২টির অবস্থান টেক্সাসে।
টেক্সাসে যখন প্রথম বডি ফার্ম খোলা হয়েছিল, তখন অনেকেই তীব্রভাবে এর প্রতিবাদ করে। প্রথম প্রথম ফার্মগুলোতে মৃতদেহের সংখ্যা খুবই কম ছিল, কেউ মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ বৈজ্ঞানিক কাজে ব্যবহার করতে দিতে চাইতো না। কিন্তু পরবর্তীতে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং অনেকেই স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ এই ফার্মগুলোতে দান করে দিয়েছেন।
এই পর্যন্ত আমেরিকার ৬টি বডি ফার্মে হাজার হাজার মৃতদেহ গবেষক ও নৃবিজ্ঞানীদের গবেষণার বস্তু হয়েছে। এর মধ্যে টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয় ফার্মে প্রায় ১৮০০ এর মতো মৃতদেহ দান করা হয়েছে এবং আরও ৪০০০ জন জীবিত ব্যক্তি তাদের মৃত্যুর পর মৃতদেহ দানে সম্মত হয়েছেন।
ফার্মে কেন আনা হয়?
মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, মৃত মানবদেহ ফার্মগুলোতে আনার পর কী ঘটে? ফার্মে রাখার জন্য মৃতদেহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংগ্রহ করা হয়। এরপর এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যায়, যা পরিবেশ ও ফার্ম ভেদে ভিন্ন হয়ে থাকে।
সাধারণত প্রক্রিয়াটি হলো এরকম- ফার্মে আনার পর গবেষকরা প্রথমে মৃতদেহের পরিমাপ, ছবি, চুল ও রক্তের নমুনা নিয়ে রাখেন। এরপর দেহগুলোকে আলাদা আলাদা নাম্বার দেয়া হয় সনাক্তকরণের জন্য এবং এরপর সেগুলোকে মাঠে নিয়ে রাখা হয়। এসব কাজ গবেষকদের ১২ ঘণ্টার মধ্যে করতে হয়। এরপর মৃতদেহগুলোকে মাটির ওপর নামিয়ে রাখা হয় অন্য একটি মৃতদেহ থেকে কয়েক ফুট দূরে। একই সময়ে প্রায় ৫০টি দেহ রাখা হয়।
গবেষকরা বডি ফার্মগুলোতে মৃতদেহ বিশেষ বিশেষ অবস্থায় রেখে দেন গবেষণার ধরন অনুযায়ী। কখনো নগ্ন অবস্থায়, আবার কখনো কাপড় পরিয়ে; কখনো স্যাঁতস্যাঁতে স্থানে, আবার কখনো শুকনো কোনো জায়গায়; ঘাসের ওপর, আবার কখনো ছায়ার মধ্যে রেখে দেওয়া হয়। এর ফলে অবস্থাভেদে মানবদেহের পচনে যে বিভিন্নতা দেখা যায়, তা খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা যায়।
দেহগুলো মাঝে মাঝে খাঁচার ভেতর রাখা হয়, যাতে করে শকুন বা অন্য কোনো প্রাণী দেহগুলোকে নষ্ট না করতে পারে। আবার গবেষকেরা কখনো কখনো বাস্তবে ঘটে যাওয়া খুনের কেস অনুকরণে লাশগুলোকে পানির ট্যাংকের মধ্যে, গাড়ির ট্রাঙ্কে বা গাছের সাথে বেঁধে রাখেন। উদ্দেশ্য হলো মৃতদেহগুলোর পচন পরীক্ষার মাধ্যমে দেহের যা যা পরিবর্তন আসে, তা তথ্য আকারে সংগ্রহ করা এবং নানা রকমের ফরেনসিক কেসের ক্ষেত্রে এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে মার্ডার কেসে ভিক্টিমের মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করা।
বডি ফার্ম নিয়ে বেশ কিছু বইও লেখা হয়েছে। প্যাট্রিসা কর্নওয়েলের লেখা ‘দ্য বডি ফার্ম’ ও সিমন বেকেটের লিখা ‘হুইস্পারস অব দ্য ডেড’ উপন্যাসটি বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। যদিও এর কাহিনী বডি ফার্মকে কেন্দ্র করে লেখা, কিন্তু বইগুলোতে উল্লিখিত চরিত্র ও ঘটনাগুলো কোনো সত্যি ঘটনা অবলম্বনে বানানো হয়নি। বডিফার্ম নিয়ে এ পর্যন্ত নানা ধরনের ডকুমেন্টারি ফিল্ম বানানো হয়েছে। এর মধ্যে ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বানানো ডকুমেন্টারিটি উল্লেখযোগ্য। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে এসব ডকুমেন্টারি পাওয়া যায়। তাছাড়া নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক বিখ্যাত ফটোগ্রাফার স্যালি মানের তোলা বডি ফার্মের ৬০টি মনোক্রম (সাদাকালো) ছবি নিয়ে বানানো ‘হোয়াট রিমেইনস’ বইটি বেশ আলোচনা-সমালোচনার বিষয় ছিল, যেখানে মৃত্যু ও ক্ষয় নিয়ে ফটোগ্রাফারের নিজস্ব ধারণার প্রতিফলন ঘটেছে। বডি ফার্ম বেশ কয়েকটি মুভির কেন্দ্রীয় বস্তুও হয়ে উঠেছে। ২০১১ সালে বিবিসিতে সম্প্রচারিত ক্রাইম ড্রামা টিভি সিরিজ ‘দ্য বডি ফার্ম’ এমনই একটি টিভি শো ছিল। এরপর সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘বডি ফার্ম’ মুভিটির কাহিনীও মূলত একটি বডি ফার্মকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে।
ফিচার ইমেজ-Vice.com