বুলেট ট্রেনের কথা কে না জানে? মাঝে মাঝেই পত্র পত্রিকায়, টেলিভিশনে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে এই বিষয় নিয়ে চর্চা হয়। কিছুদিন আগে ভারতে জাপানি সাহায্যে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের কথা আমাদের সামনে আসে। এর আগে এ বছরের প্রথমদিকে আমাদের দেশের মন্ত্রীপরিষদেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বুলেট ট্রেন প্রকল্প হাতে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। তাই বুলেট ট্রেন নিয়ে একটু বিশদ আলোচনা করার দরকার আছে।
আজকের লেখায় থাকবে বুলেট ট্রেনের দ্রুতগতির কারণে এর যাত্রাপথের আশেপাশে কোন ধরনের পরিবর্তন হয়, একটি টানেলের ভিতর দিয়ে ট্রেনটি গেলে কী ঘটবে, আশেপাশের বাতাসের উপর কী প্রভাব পড়বে, ট্রেনের যাত্রাপথের আশেপাশে যদি মানুষ থাকে তাহলে তাদের উপর এই ট্রেনের গতির প্রভাব কী ইত্যাদি। এরপরের পর্বগুলোতে থাকবে পরিবেশের উপর বুলেট ট্রেনের প্রভাব, বুলেট ট্রেন কতটুকু খরচ সাপেক্ষ, এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে কী কী করণীয়, বাংলাদেশে বুলেট ট্রেন প্রকল্প কতটুকু যুক্তিযুক্ত ইত্যাদি।
সাধারণত যেসব ট্রেন ২৫০ কিলোমিটার গতিতে ছুঁটে যায় তারাই দ্রুত গতির ট্রেন বা বুলেট ট্রেন নামে পরিচিতি লাভ করে। এগুলোকে অনেক সময় ম্যাগলেভ ট্রেনও বলা হয়। এই ট্রেনগুলো চুম্বকের সাহায্যে রেলের উপরে ভেসে যাতায়াত করে। এই ভেসে থাকার কারণে রেলের সাথে ট্রেনের চাকার ঘর্ষণ কমে যায়। ঘর্ষণ কমার ফলে অনেক দ্রুতগতিতে একটি ট্রেন চলতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির বুলেট ট্রেন এখন চীনের অধিকারে। কিন্তু সবচেয়ে সফল এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে মোটামুটি সফল বলা যায় জাপানের বিখ্যাত বুলেট ট্রেন শিনকানসেনকে। প্রায় ৫৩ বছর ধরে যাত্রী সেবা দিয়ে যাচ্ছে ট্রেনটি। যা-ই হোক, ভূমিকা শেষ। এখন আমাদের আজকের পর্বের প্রতিপাদ্য বিষয়ে ফিরে যাই।
ধরা যাক, কোনো একটি দেশ বুলেট ট্রেনের সূচনা করলো। সেই দেশে সফলভাবে বুলেট ট্রেনটি চলছে। ট্রেনটি চলার সময় এর অনেক বেশী গতির কারণে বাতাসের সাথে এর ঘর্ষণ বেড়ে যাবে। ট্রেন যখন প্রচণ্ড গতিতে ছুটতে থাকবে তখন সে তার যাত্রাপথের চারপাশের উপরও বিরাট প্রভাব বিস্তার করবে, বিশেষ করে বাতাসের উপর। কী কী ঘটতে পারে বাতাসের মধ্যে? ট্রেনটি যদি কোনো টানেলের মধ্যে দিয়ে যায় তখন কী হবে? দুটি বুলেট ট্রেন বিপরীত দিক থেকে যখন পাশাপাশি আসবে তখন কী কী ঘটতে পারে? বুলেট ট্রেনের যাতায়াতের আশেপাশে যদি মানুষের আনাগোনা থাকে তাহলে তাদের উপর এর প্রভাব কেমন হবে? কোনো দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই তো?
বুলেট ট্রেন যখন অনেক দ্রুতগতিতে চলে, যেমন ২৭০ কিলোমিটার কিংবা তার উপরে, তখন যাত্রাপথে এটি এর সামনের বাতাসকে আঘাত করে। এই আঘাত করার কারণে বাতাস সংকুচিত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ বাতাসে এক ধরনের সংকোচন তরঙ্গের সৃষ্টি (Compression wave) হয়। এই বাতাস ট্রেনের উপর দিয়ে, দুই পাশ ঘেষে প্রবাহিত হতে থাকে। খুব স্বাভাবিক যে এর ফলে আশেপাশের বাতাসের প্রবাহ বেশী থাকবে [১]।
এখন ধরা যাক, যাত্রাপথে ট্রেনকে একটি টানেলের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। ট্রেনটি প্রচণ্ড গতিতে যখন টানেলের মধ্যে প্রবেশ করবে এবং এর ভিতর চলতে থাকবে, তখন যাত্রীরা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু কম চাপ অনুভব করবে। এই ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য আমরা ধরে নিই টানেলের ভিতর ট্রেন স্থির অবস্থায় আছে, কিন্তু বাতাস দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হচ্ছে। এরকম অবস্থায় ট্রেনের শরীর এবং টানেলের দেয়ালের মাঝামাঝি জায়গা অনেক কম হওয়াতে এখানে বাতাস সংকুচিত হয়ে পড়বে এবং বাতাসের গতি এর মাঝে স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যাবে। এই বেড়ে যাওয়াটা কিন্তু এমনি এমনি ঘটবে না। এটুকু গতি বৃদ্ধির জন্য যতটুকু শক্তির দরকার সেটা আসবে বাতাসের চাপ থেকে। বাতাসের চাপ থেকে শক্তি নেয়ার কারণে টানেলের ভিতরে বাতাসের চাপ কমে যাবে। এই চাপ কমে যাওয়া ট্রেন এর যাত্রীরা কানের মাধ্যমে বুঝতে পারে। কারণ কানের ভিতর আটকে যাওয়া বাতাস বাইরে বের হতে চায়, যেহেতু বাইরে চাপ কম। আর তখনই উপরে উল্লেখিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। প্লেন যখন উপর থেকে নিচে নামে তখন প্লেনের যাত্রীদের কানের ভিতর এই ধরনের অনুভূতি হয় যেন কোনো অদৃশ্য বল তাদের কানের পর্দাকে বাইরের দিকে টেনে বার করে দিতে চাচ্ছে [২]।
দুটি বুলেট ট্রেন যদি পাশাপাশি আসে তখনও তাদের প্রচণ্ড গতির কারণে দুই ট্রেনের পরস্পরের মাঝের জায়গায় বাতাসের চাপ কমে যাবে। এই পাশাপাশি অবস্থান করা দুটি ট্রেন যদি টানেলের ভিতর থাকে তাহলে বাতাসের এই চাপ আরও বেশী পরিমাণে কমে যাবে। প্রথম প্রথম যখন বুলেট ট্রেন চালু হলো তখন দুটি ট্রেন বিপরীত দিক থেকে অনেক দ্রুতগতিতে পাশাপাশি আসলে অনেক সময় ট্রেনের জানালা ভেঙ্গে যেত [৩]।
এখানে যদিও খুব সহজ করে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে বুলেট ট্রেনের সাথে বাতাসের প্রবাহ ব্যাখ্যা করা অনেক কঠিন। টানেলের ভিতর হোক কিংবা খোলা জায়গা হোক- ট্রেনগুলো যখন মুখোমুখি আসে বা পাশাপাশি যায় বা পরস্পরকে অতিক্রম করে চলে যায়, তখন বাতাসের প্রবাহ ট্রেনের চারদিকে কেমন ব্যবহার করবে সেটা খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়া। এটি ব্যাখ্যা করতে কম্পিউটার মডেলের প্রয়োজন। তবে এখনও পর্যন্ত এই বিষয় নিয়ে যতগুলো গবেষণা হয়েছে সেখানে একটি কথা স্বীকার করা হয় যে, দুটি বুলেট ট্রেন পাশাপাশি আসলে তাদের প্রচণ্ড গতির কারণে বাতাসকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে অর্থাৎ স্পেস থেকে বাতাসকে তাদের পরস্পরের পাশাপাশি জায়গার মধ্যে টানে বা Drag করে, যে কারণে বাতাসের পরিমাণ দুই ট্রেনের মাঝে কম থাকে, অর্থাৎ বাতাসের চাপ কমে যায়।
বুলেট ট্রেন যখন ছুঁটে চলে তখন এর কাছাকাছি মধ্যে খালি জায়গায় মানুষের আনাগোনা বিপজ্জনক। কারণ আগেই বলা হয়েছে, এই ধরনের দ্রুতগতির ট্রেন বাতাসকে সংকুচিত করে। ট্রেনের সামনের অংশে বাতাসে একধরনের সংকোচন তরঙ্গ তৈরি হয় যেটা ট্রেনের গতির সাথে সাথে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই বাতাসে সৃষ্ট তরঙ্গ এত বেশী টারবুলেন্স (Turbulence) বা উত্তালতা সৃষ্টি করে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে যে মানুষকে ট্রেনের সামনে বা রেল ট্র্যাকে ফেলে দিতে পারে [৪]।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, শুধু প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেই হবে না। একটি প্রকল্প হাতে নেয়ার আগে এর ফলে আশেপাশে কী ধরনের প্রভাব পড়বে সেই বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। যেহেতু আমাদের হাতে বিজ্ঞানের মতো মহাস্ত্র আছে, তাই একটু কষ্ট করে এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা মোটেও কঠিন কোনো কাজ না।
তথ্যসূত্র
[১] Schetz, J. A. (2001). Aerodynamics of high-speed trains. Annual Review of Fluid Mechanics. 33, 371-414
[২] Camerlingo, C., and A. Varlamov (1990). An incident on the train. Quantum. page:42-44
[৩] Fuji, K., and T. Ogawa. (1995). Aerodynamics of high speed trains passing by each other. Computers & Fluids. 24, No. 8, 897-908
[৪] Walker, J. (2007). Flying Circus of Physics. John Wiley & Sons, Inc.
ফিচার ইমেজ- Ezperienza-WordPress.com