সকাল থেকেই তারিকের মন খারাপ। প্রেমিকার সাথে তুচ্ছ কারণে ঝগড়া হয়েছে। সেই থেকে কিছুই ভালো লাগছে না। সবকিছু অসহ্য মনে হচ্ছে। কোনো কাজেই মন বসাতে পারছে না। অথচ আগামীকাল থেকে তার সেমিস্টার ফাইনাল শুরু। একটু কিছু তো পড়তেই হবে, নাহলে নিশ্চিত ইমপ্রুভমেন্ট দিতে হবে। বেশ কয়েকবার পড়ায় মনোনিবেশের বৃথা চেষ্টা করলো সে। কোনো লাভই হলো না। মনে হতে লাগলো, বইয়ের ছাপা অক্ষরগুলো যেন শূন্যে ভাসছে। আর রোমান্টিক গানের তালে তালে নাচছে। দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসতে লাগলো তার।
বই বন্ধ করে দিয়ে, ‘ধুর ছাই’ বলে আপনমনেই মোবাইলটা হাতে নিলো সে। ঢুকে পড়লো ইউটিউব অ্যাপে। সেখানে দেখতে পেল একটি নতুন মুভির সাজেশন এসেছে। সাত-পাঁচ ভেবে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ফ্রি ওয়াইফাই-ই তো! একটু দেখাই যাক না কী রকম মুভিটা!
নাম-ধাম দেখানো শেষে শুরু হলো মুভিটা। তারিক ভেবে রাখলো, পাঁচ মিনিটের মতো দেখবে, তারপরই বন্ধ করে দেবে। কিন্তু মুভির কাহিনীর সাথে সে এতটাই একাত্ম হয়ে গেল যে, পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, বিশ মিনিট এমন করে কখন যে এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলো, সে টেরই পেল না। যখন তার হুঁশ ফিরলো, ততক্ষণে সে তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝে ফেলেছে, মুভির ক্লাইম্যাক্স ট্র্যাজিক হবে।
হায় হায়, আমি এই মুভি কেন দেখছি! এমনিতেই আমার মন খারাপ। মুভির ট্র্যাজিক এন্ডিং দেখে তো মন আরও খারাপ হয়ে যাবে! এরকমটাই ভাবতে লাগলো তারিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মুভির কাহিনীর দুনির্বার আকর্ষণের কাছে হার মানলো সে। রিজিউম করে বাকি অংশটা দেখতে শুরু করল। এবং শেষমেষ তার আশঙ্কাই সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। মুভির শেষটা আসলেই অনেক হৃদয়বিদারক। নায়িকার বিয়ে হয়ে যায়, আর সেই দুঃখে নায়ক বেচারা পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে থাকে।
তারিক বরাবরই খুব আবেগপ্রবণ ছেলে। কারও কষ্টই সে সহ্য করতে পারে না। বরং অন্য কাউকে কষ্ট পেতে দেখলে তার মনে হয়, কষ্টটা বুঝি সে নিজেই অনুভব করতে পারছে। আজও ঠিক তা-ই হলো। ব্যর্থ প্রেমিককে প্রেমিকার দুঃখে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করতে দেখে তার মনে হলো, ঐ ছেলেটা তো আমিই! এই ভেবে প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাঁদতে আরম্ভ করল সে। একেবারে চোখের জলে, নাকের জলে অবস্থা। এক পর্যায়ে তো হেঁচকিও উঠতে লাগল। কিছুতেই থামে না সেই হেঁচকি। পাশের রুমে বড় ভাইরা আছে। নতুবা সে হয়তো বিলাপ করে কাঁদতেই আরম্ভ করতো।
তবে এমন মানসিক অবস্থা খুব বেশিক্ষণ দীর্ঘস্থায়ী হলো না। কিছুক্ষণ বাদেই তারিকের মনে হলো, এত ছাগল কেন আমি! একদিকে প্রেমিকার সাথে ঝগড়া হয়েছে, ওদিকে কাল আমার পরীক্ষা। আর আমি কি না অন্যের দুঃখে কেঁদে ভাসাচ্ছি! এসব ভেবে নিজের উপর লজ্জা লাগতে শুরু করলো তার। তবে সেই লজ্জাও বেশিক্ষণ থাকলো না। তার বোধোদয় হলো, কালকের পরীক্ষার জন্য পড়া শুরু করা জরুরি। তারচেয়েও বেশি জরুরি প্রেমিকার সাথে বিবাদ ভঞ্জন।
তাই সারাদিন ইমোজি চালাচালির পর, প্রথমবারের মতো প্রেমিকাকে স্বাভাবিক একটি মেসেজ পাঠালো সে। প্রেমিকাও স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল। হয়ে গেল তাদের প্যাচ-আপ। কিছুক্ষণ তারা কী করো, খাইছো, ঘুমাইছো জাতীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ (!) আলোচনা চালালো। এরপর মোবাইল রেখে, বই খুলে ঠান্ডা মাথায় পড়তে শুরু করলো সে। না, এবার আর অক্ষরগুলো নাচানাচি করছে না। সুবোধ বালকের মতো যার যেখানে থাকার কথা, সেখানেই স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। আর সে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে পড়তে লাগলো। সারারাত পড়বে। দরকার হলে পরীক্ষার হলে বসে লেখা বাদ দিয়ে ঘুমাবে। কিন্তু যে করেই হোক, সারারাত পড়ে সিলেবাস কমপ্লিট তাকে করতেই হবে।
উপর্যুক্ত কল্পচিত্রটি পড়ে অনেকেরই অবাক লাগতে পারে। মনে হতে পারে, ট্র্যাজেডি মুভি দেখে একটা মন খারাপ করে থাকা মানুষ আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যায় কীভাবে! তার তো আরও মুষড়ে পড়ার কথা। এমনটি যারা ভাবছেন তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, বিষয়টি অবাস্তব কিছু নয়। বরং এমনটা হওয়ার পেছনে খুব শক্তিশালী একটি কারণ রয়েছে। আর সেই কারণের নাম হলো ক্যাথারসিস।
কী এই ক্যাথারসিস?
ক্যাথারসিস মানে হলো মানুষের নেতিবাচক আবেগের বিশুদ্ধিকরণ ও বিরেচন। দৈনন্দিন বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের ফলে মানুষের মনে বিভিন্ন নেতিবাচক আবেগ জমা হতে পারে। যেমন- ভয়, আশঙ্কা, ক্রোধ, ঘৃণা ইত্যাদি। কিন্তু কোনো বিশেষ উপায়ে মনের এসব অনাকাঙ্ক্ষিত আবেগের নিঃসরণ ঘটে মন হালকা ও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে, তাকে ক্যাথারসিস বলে।
উৎপত্তি
ইংরেজি Catharsis শব্দটি এসেছে গ্রিক ভাষার κάθαρσις বা katharsis শব্দ থেকে, যার অর্থ আগেই যেমনটি বলেছি, বিশুদ্ধিকরণ বা বিরেচন। প্রথম এই কথাটির ব্যবহারিক প্রয়োগ ঘটান অ্যারিস্টটল, তার Poetics নামক বইতে। এখানে তিনি ক্যাথারসিস শব্দটিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে রূপকার্থে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বিষয়টিকে katamenia বা মেয়েদের মাসিক চলাকালীন নিঃসৃত স্রাবের সাথে তুলনা করেছিলেন। মাসিক চলাকালীন নিঃসৃত স্রাবের মাধ্যমে যেমন শরীরের আভ্যন্তরীণ বর্জ্য ও ক্ষতিকর উপাদানগুলো বের হয়ে যায় এবং শরীর বিশুদ্ধতা লাভ করে, ক্যাথারসিসকে অ্যারিস্টটল ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করেছিলেন। তার মতে, ‘বিশেষ কোনো একটি উপায়ে’ মানুষের মনের নেতিবাচক আবেগ-অনুভূতিগুলো এভাবেই বের হয়ে আসে, আর তার মন বিশুদ্ধ হয়ে যায়।
বিশেষ উপায়টি কী?
বিশেষ উপায়টি যেকোনো শিল্প বা সাহিত্য মাধ্যম হতে পারে। তবে অ্যারিস্টটল যখন ব্যাখ্যা করেছিলেন, তখন তিনি বেছে নিয়েছিলেন ট্র্যাজেডি নাটককে। তিনি বিশ্লেষণ করেছিলেন ট্র্যাজেডি নাটক মানুষের মনে কী ধরনের প্রভাব ফেলে। তিনি দেখিয়েছিলেন, মানুষের মনে যেসব ভয়, শঙ্কা বা দুঃখবোধ কাজ করে, ট্র্যাজেডি নাটকের চরিত্রদের সাথে ঠিক সেগুলোই ঘটতে দেখে তাদের মানসিক আবেগের বিকল্প নিঃসরণ ঘটে। মানুষ স্বাভাবিকভাবে বুঝে উঠতে পারে না একই ধরনের কোনো ঘটনা তার সাথে ঘটলে তখন তার প্রতিক্রিয়া কী হবে। কিন্তু যখন সে কোনো একটি ট্র্যাজেডি নাটকের চরিত্রদের সাথে একাত্ম হওয়ার মাধ্যমে তাদের সাথে ঘটা অভিজ্ঞতাগুলো নিজেও অর্জন করে, তখন সে-ও তাদের মতো করেই নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে। এর ফলে তার মন হালকা হয়ে যায়, এবং নাটক শেষে ঠান্ডা মাথায় সে তার দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক কাজকর্মে ফেরত যেতে পারে। আর এভাবেই একজন ট্র্যাজেডি নাটকের দর্শকের ক্যাথারসিস ঘটে।
শিল্প বা সাহিত্য মাধ্যমটি হতে পারে অন্য কিছুও
অ্যারিস্টটল কেবল ট্র্যাজেডি নাটকের কথাই বলেছেন বটে, কিন্তু ক্যাথারসিস ঘটতে পারে যেকোনো ধরনের শিল্প ও সাহিত্য মাধ্যমেই। যেমন- নাটকেরই অন্যান্য অসংখ্য ধারা আছে। এছাড়াও শিল্প ও সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে রয়েছে চলচ্চিত্র, গান, চিত্রকর্ম থেকে শুরু করে গল্প, উপন্যাস, কবিতা সবই। মানুষ এসকল শিল্প ও সাহিত্য মাধ্যমের যেকোনো একটির কাল্পনিক জগতে প্রবেশ করে, সেটির চরিত্র ও ঘটনাক্রমের সাথে একাত্মতা অনুভবের মাধ্যমে ক্যাথারসিস লাভ করতে পারে।
ধরুন, আপনার মন প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কানে ইয়ারফোন গুঁজে আপনি একটি রবীন্দ্রসংগীত শুনতে শুরু করলেন। এবং ক্রমশ আপনার বিক্ষিপ্ত মন কেন্দ্রীভূত হয়ে ঐ গানের কথা ও সুরের দিকে ধাবিত হতে লাগলো। এর মানে হলো আপনার ক্যাথারসিস হলো। একইভাবে আপনি যদি একজন ধৈর্যশীল পাঠক হন, গল্প-উপন্যাসের জগতে প্রবেশ করেও আপনার ক্যাথারসিস হতে পারে। আবার আপনি শিল্প-সমঝদার হলে একটি বিমূর্ত চিত্রকর্ম দেখেও আপনার ক্যাথারসিস হতে পারে।
মূলত, ব্যক্তিভেদে ক্যাথারসিসের রকমফের হয়। সব মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তো আর এক না। আমার যা ভালো লাগবে, আপনার তা ভালো না-ও লাগতে পারে। আপনার হয়তো ভিন্ন কিছু ভালো লাগে। কিন্তু শিল্প বা সাহিত্য মাধ্যমের কোনো না কোনো একটি ধারার প্রতি সকলেরই দুর্বলতা থাকে, আর তার সেই মাধ্যমেই ক্যাথারসিস হতে পারে।
মনোবিজ্ঞানে ক্যাথারসিস
অ্যারিস্টটলের কল্যাণে প্রথমদিকে ক্যাথারসিস মূলত একটি শৈল্পিক টার্ম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু এতক্ষণে বুঝে গেছেন নিশ্চয়ই, ক্যাথারসিসের মূল ভিত্তি হলো মনোবিজ্ঞান। তাই একপর্যায়ে মনোবিজ্ঞানেও এই টার্মটির ব্যবহার শুরু হয়। মনোবিজ্ঞানে প্রথম এই টার্মের প্রয়োগ ঘটান সিগমুন্ড ফ্রয়েডের সহকর্মী জোসেফ ব্রয়ার। তিনি ইন্টেনসিভ হিস্টিরিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ক্যাথারটিক মেথডের সাহায্য নিতে শুরু করেন। আর এজন্য তিনি কাজে লাগাতেন সম্মোহনী শক্তিকে। ক্যাথারটিক মেথডের সম্মোহনের ফলে তার রোগীরা তাদের ট্রমাটিক অভিজ্ঞতাগুলো তার সাথে শেয়ার করতো। এর ফলে এতদিন তারা তাদের মনের মধ্যে যেসব আবেগ অবদমন করে রেখেছিল, সেগুলো বাইরে বেরিয়ে আসতো। এবং একবার আবেগ বাইরে বেরিয়ে আসলে সেগুলো ঐ রোগীকে পরবর্তীতে আর তাড়া করে বেরোতো না। ক্রমে সুস্থতা লাভ করতো রোগী।
পরবর্তীতে ফ্রয়েড নিজেও ক্যাথারসিসের দিকে ঝোঁকেন। তিনি যে সাইকো-অ্যানালাইসিসের ধারণা প্রবর্তন করেছিল, সেটিও আবর্তিত হতো ক্যাথারসিসকে কেন্দ্র করেই। তবে তিনি তার সাইকো-অ্যানালাইসিসে সম্মোহনের বিকল্প হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন ফ্রি অ্যাসোসিয়েশন। আধুনিক সাইকোথেরাপিতেও, বিশেষত ফ্রয়েডিয়ান সাইকো-অ্যানালাইসিসে ব্যবহৃত হচ্ছে ক্যাথারসিস।
ক্যাথারসিস ও সহিংসতা
শুরুর দিকে ক্যাথারসিসের মাধ্যমে কেবল মানুষের দুঃখ, হতাশা জাতীয় আবেগের অবমুক্তি ঘটতো বলে মনে করা হলেও, পরবর্তীতে তার সাথে যুক্ত হয় অন্যান্য আবেগও। যেমন- প্রচন্ড রাগ বা ক্রোধ, যা মানুষকে এতটাই আগ্রাসী করে তোলে যে, তারা হিংস্রতার পথ বেছে নেয়। কিন্তু অনেকের মতে, ক্যাথারসিসের মাধ্যমে এ ধরনের অনুভূতিরও বিকল্প বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ফলে যাদের মধ্যে হিংস্রতার প্রবণতা রয়েছে, তারা ক্যাথারসিসের মাধ্যমে তা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
যেমন বিখ্যাত থ্রিলার পরিচালক আলফ্রেড হিচকক একবার বলেছিলেন, “One of television’s greatest contributions is that it brought murder back into the home where it belongs. Seeing a murder on television can be good therapy. It can help work off one’s antagonism”, অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, একজন দর্শক যখন টিভির পর্দায় খুনের মতো সহিংস কোনো ঘটনা দেখে, তখন তার মনের মধ্যে অনুরূপ কিছু করবার অবদমিত বাসনা থেকে থাকলে, তা দূর হয়ে যায়।
একই রকম কথা বলেছিলেন টোটাল রিকল খ্যাত পরিচালক পল ভারহোভেনও। তার মতে, “I think it’s a kind of purifying experience to see violence.”, সুতরাং তিনিও মূলত গণমাধ্যমে সহিংসতা দেখার প্রভাবকে ক্যাথারসিস হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
গণমাধ্যমের সহিংসতার সাথে ক্যাথারসিসের সম্পর্ক নিয়ে একই রকম উক্তি করেছেন সম্প্রতি তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া থ্রিলার আন্ধাধুনের পরিচালক শ্রীরাম রাঘবনও। তার মতে, “We all are scared of bad things. So when you are watching a film, you see your fears on the screen. You have this thought ‘Thank God, it is happening to someone else.”, তার মানে দাঁড়াচ্ছে, দর্শকের মনের কোণে লুকিয়ে থাকা ভয়গুলো কাটানোর জন্যই তাদের থ্রিলার মুভি দেখা উচিত।
এই ধারণার উপর ভিত্তি করেই আজকাল প্রচুর সহিংস চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, টিভিতেও অনেক অপরাধমূলক অনুষ্ঠান তৈরি হচ্ছে। এবং সেগুলোর স্বপক্ষে যুক্তি বা ঢাল হিসেবে নির্মাতারা ব্যবহার করছেন ক্যাথারসিসকে। তাদের মতে, পর্দায় তারা এজন্যই এগুলো দেখাচ্ছেন, যাতে এর মাধ্যমে দর্শকমনের অবদমিত বাসনা বিকল্প উপায়ে পূরণ হয়, বাস্তবে কাউকে এ ধরনের কাজে লিপ্ত হতে না হয়।
ক্যাথারসিসের ধারণা মেনে প্রচুর সহিংস ভিডিও গেমও তৈরি হচ্ছে, যা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯০ এর দশকে সেগা গেমসের হাত ধরে। তারা ভার্চুয়াল কপ, হাউজ অফ দ্য ডেডের মতো সহিংস ভিডিও গেমস নির্মাণ করতে থাকে, এবং যুক্তি দেখায় যে, এসব গেমস খেললে গেমাররা একটি কাল্পনিক জগতে বিচরণ করতে পারবে, এবং সেখানে নিজেদের মর্জিমতো রাজত্ব কায়েম করতে পারবে। আর মানুষ মারার মতো আনন্দদায়ক আর কী-ই বা হতে পারে! বাস্তবে সেই আনন্দ লাভের পরিবর্তে, ভিডিও গেমস খেলে আনন্দ পাওয়া ঢের ভালো নয় কি?
সহিংস ক্যাথারসিস ধারণার সমালোচনা
গণমাধ্যমের সহিংসতাকে বৈধতা দিতে অনেকেই ক্যাথারসিসের অজুহাত দেয় বটে, কিন্তু এর বিপক্ষে দাঁড়ানোর মতো লোকেরও অভাব নেই। পর্দায় সহিংসতা দেখলে ক্যাথারসিস হবে, মানুষ আর ব্যক্তিজীবনে সহিংস হতে চাইবে না, এমন যুক্তি মানতে চায় না অনেকেই। তাদের কথা হলো, এর ফলে উল্টো আরও নতুন করে অনেকের মনে সহিংসতার সৃষ্টি হতে পারে।
যেমন- একজন মানুষ হয়তো কোনোদিনই কোনো ধরনের সহিংসতা দেখেনি। এ ব্যাপারে তার ন্যূনতম কোনো ধারণাই ছিল না। কিন্তু একটি মুভিতে যখন সে প্রথমবারের মতো নায়ককে সহিংস হতে দেখল, এবং এর মাধ্যমে সবার কাছে সেই নায়ক প্রশংসিত হলো, তখন সেই দর্শকের মনেও সহিংস হওয়ার মনোবাসনা জন্মাতেই পারে। তবে সবার ক্ষেত্রেই যে এমনটি হবে, তেমনটিও দাবি করা যায় না।
বিষয়টি অনেকটা ধূমপানের মতো। ধূমপান করলেই যে কারও ফুসফুসে ক্যান্সার হবে, তা তো নয়। আর ফুসফুসে ক্যান্সার হওয়ার একমাত্র কারণও শুধু ধূমপান নয়। কোনোদিন ধূমপান করেনি এমন ব্যক্তিরও ফুসফুসে ক্যান্সার হতে পারে, আবার সারাজীবন ধূমপান করে যাওয়ার পরও একজন মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে। বিষয়টি আপেক্ষিক। কিন্তু তাই বলে তো ধূমপানের ফলে ফুসফুসে ক্যান্সার হবে, এই আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যায় না। সেজন্য সিগারেট কোম্পানিগুলোও প্যাকেটে এ ব্যাপারে সতর্কবাণী দিয়ে দেয়।
তাছাড়া ধূমপানের সাথে সহিংসতা দেখার আরও মিল রয়েছে। যে ব্যক্তি কোনোদিন ধূমপান করেনি, তার কিন্তু ধূমপানের প্রতি আসক্তি জন্মাবে না। প্রথম একবার-দুইবার ধূমপানের পরে ভালো লেগে গেলেই সে নিয়মিত ধূমপায়ী হয়ে যাবে। অনুরূপ ঘটতে পারে সহিংস গণমাধ্যমের দর্শকের ক্ষেত্রেও। একজন দর্শক হয়তো আজীবন রোমান্টিক ঘরানার মুভিই দেখে এসেছে। তাই অ্যাকশন ঘরানার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই। কিন্তু একবার অ্যাকশন ঘরানার মুভি দেখে মজা পেয়ে গেলে সে বারবার ঐ ঘরানার মুভিই দেখতে চাইবে। এবং একপর্যায়ে সে যে নিজেও একদিন সহিংস হতে চাইবে না, সেই গ্যারান্টি দিতে পারবে না কেউই।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পর্দায় সহিংসতা দেখার আগে অনেক দর্শকই সহিংসতার নিত্য-নতুন উপায় সম্পর্কে অবগত ছিল না। কিন্তু আজকাল এ জাতীয় অনুষ্ঠান দেখে মানুষ শিখছে অপরাধের নতুন নতুন সব উপায়। অনেকে সেগুলো বাস্তব জীবনে প্রয়োগও করছে। তার মানে তো তাদের মধ্যে ক্যাথারসিস হচ্ছে না। বরং তারা আরও অনুপ্রাণিত হচ্ছে নিজেরাও এগুলো করতে।
আর গণমাধ্যমে সহিংসতার সবচেয়ে বড় প্রভাব দেখা দিতে পারে শিশুদের মধ্যে। শিশুরা যা দেখে তা-ই শেখে। আর তাদের মধ্যে ক্যাথারসিস হওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতাও নেই। ফলে আজকাল যখন কার্টুনে বা কমিকে তারা সহিংসতা দেখে, ধীরে ধীরে তারা নিজেরাও ওগুলো রপ্ত করে নিতে থাকে, যা কখনোই কোনো ভালো ফল বয়ে আনে না।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/