২০১৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন রাইনার ভাইস, ব্যারি ব্যারিশ, ও কিপ থর্ন। তারা নোবেল পুরস্কারের অর্থ ভাগাভাগি করে নেবেন। তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে সারা জীবন ধরে এমনকি মৃত্যুর পরেও ‘নোবেল লরেট’ হিসেবে যুগ যুগ ধরে সম্মানিত হবেন।
তারা যে কাজের জন্য সম্মানিত হয়েছেন, মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকরণ, সে কাজ তারা তিনজন করেননি। এ কাজের পেছনে জড়িত বিজ্ঞানীর সংখ্যা হাজারেরও উপরে। যে গবেষণাপত্রে তাদের আবিষ্কারের বিস্তারিত বিবরণ প্রকাশিত হয় সেখানে তিন পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল অথর (গবেষক)-দের নাম। মহাকর্ষ তরঙ্গের আবিষ্কার যদি নোবেল পুরস্কার জেতে তাহলে সে নোবেলের ভাগীদার গবেষকদের সকলে। কিন্তু নোবেল কমিটি মাত্র তিনজনকে পুরস্কৃত করলো। তিনজনকে প্রদান করার ফলে তারা হয়তো সম্মানিত হয়েছেন, কিন্তু বাকি সকল গবেষক হয়েছেন উপেক্ষিত। অথচ গবেষণা দলে কারো অবদানকেই খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই।
এখনকার গবেষণার ধরন আর আগের মতো নেই। একটা সময় ছিল যখন বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই নিজে নিজে সাধনা করে কিছু একটা করেছেন। কিন্তু এখনকার বিজ্ঞান গবেষণার বিষয়গুলো এতটাই জটিল যে একজনের পক্ষে সেখান থেকে ফলাফল বের করে আনা সম্ভব হয় না। ছোটখাট ব্যতিক্রম হয়তো থাকতে পারে, কিন্তু সার্বিকভাবে পরিস্থিতি বর্তমানে এমনই। গবেষণাগুলো চলে গবেষক দল বা রিসার্চ টিমের মাধ্যমে।
ধরা যাক, কোনো এক গবেষণা দল রক্তের নমুনা থেকে ক্যানসার শনাক্ত করার পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছে। এখানে একজন চিকিৎসাবিদ ও একজন রসায়নবিদ একটি রাসায়নিক পদ্ধতি বের করলো। কোনো বিক্রিয়ার মাধ্যমে কিংবা কোনো রঞ্জক পদার্থের মাধ্যমে ক্যানসার কোষকে আলাদা করে শনাক্ত করতে পারলো। সেখান থেকে উৎসাহিত হয়ে একজন পদার্থবিদের সাথে মিলে আরো একটি পদ্ধতি বের করলো। পদার্থবিদ দেখলেন, স্বাভাবিক রক্তের আণবিক বৈশিষ্ট্য এবং ক্যানসার আক্রান্ত রক্তের আণবিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। কারো রক্তে যদি এরকম ভিন্নতা পাওয়া যায় তাহলে ধরে নিতে হবে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত।
এরপর চিকিৎসাবিদ একজন প্রকৌশলীর সাহায্য নিয়ে মানুষের জন্য ব্যবহার উপযোগী যন্ত্র বানালেন। মানুষ এটি দলে দলে ব্যবহার করতে শুরু করলো এবং উপকৃত হলো। এই দেখে নোবেল কমিটি খুশি হলো। পরের বারই রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যানসার শনাক্তকরণ পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল দিলো চিকিৎসককে। কিন্তু এখানে তো নোবেলের দাবিদার রসায়নবিদ, পদার্থবিদ এবং প্রকৌশলীও। তাদেরকে সম্মানিত না করে নোবেল কমিটি কি তাদের প্রতি অবিচার করছে না?
এখনকার বিজ্ঞান গবেষণাগুলো এমন হয়ে গেছে যে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের একটি দিকের বিশেষজ্ঞ তা সম্পন্ন করতে পারে না। বেশিরভাগ গবেষণাতেই জ্ঞানের বিভিন্ন দিকে বিশেষজ্ঞ বিভিন্ন বিজ্ঞানীর প্রয়োজন হয়। কিংবা গবেষণাগুলোতে এত বেশি ডাটা বিশ্লেষণ করতে হয় যে একজনের পক্ষে সারা জীবন পেরিয়ে যাবে সম্পন্ন করতে। বহু সংখ্যক বিজ্ঞানীর প্রয়োজন হয়ই। যেমন- হিগস বোসনের ভর নিয়ে করা এক গবেষণায় গবেষকের পরিমাণ ছিল ৫,১৫৪ জন।
এখন কোনো গবেষণা যদি পুরস্কৃত করতে হয় তাহলে অবশ্যই সেই গবেষণা দলকে সামগ্রিকভাবে করতে হবে। তাদের মাঝখান থেকে ২/৩ জনকে দিলে সেটি ন্যায়সঙ্গত কাজ হবে না।
মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্ত করার মতো বিষয় এতটাই জটিলতায় পরিপূর্ণ যে তা করতে গেলে কয়েকশ বিজ্ঞানীর প্রয়োজন হবে তা স্বাভাবিক। মহাকর্ষ তরঙ্গ শনাক্তকরণ নিয়ে কাজ করা বিজ্ঞানীর শর্ট লিস্ট যদি করা হয় তাহলে অন্তত ৫১ জনকে রাখতেই হবে। প্রত্যেকের অবদান তাদের নিজ নিজ দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নোবেল পাওয়া তিন বিজ্ঞানীর পাশে তাদের নামও থাকার দাবিদার। এখন তাদের কাজের সফলতায় তাদের মাঝ থেকে মাত্র তিনজনকে পুরস্কৃত করলে বাকিদের কি বঞ্চিত করা হচ্ছে না?
এরকম হবার পেছনে অন্যতম কারণ তিনজনের বেশি কাউকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া যায় না। শান্তিতে কোনো সংস্থাকে নোবেল দেওয়ার রীতি থাকলেও বিজ্ঞানে নেই। বিজ্ঞানের মাহাত্মের প্রশ্নে নোবেল পুরস্কারের ভূমিকা আসলে প্রশ্নবিদ্ধ। বিজ্ঞান মূলত যা আর নোবেল পুরস্কার সম্মানিত করছে যেভাবে তার মধ্যে আসলে বিস্তর ফারাক। সময় এসেছে নোবেল পুরস্কারের পদ্ধতি নিয়ে নতুন করে ভাবার। সময় এসেছে সেকেলে বৈষম্যময় নিয়ম পরিহার করার।
২/৩ জন ব্যক্তিকে নোবেল না দিয়ে নিয়ম পাল্টে পুরো গবেষণা টিমকে নোবেল দিলে যে ক্ষতি হবে তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হবে অবদান রাখা বিজ্ঞানীকে স্বীকৃতি না দিলে।
সময় এসেছে শান্তিতে নোবেলের মতো বিজ্ঞানেও একদল অবদানকারীকে সম্মানিত করার। ড. মুহাম্মদ ইউনুসের উদাহরণটিই দেখুন। তাকে দেওয়া হয়েছে পুরস্কারের অর্ধেক আর বাকি অর্ধেক দেওয়া হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংককে, যার প্রতিনিধিত্ব করে হাজার হাজার কর্মী, যারা এর পেছনে শ্রম দিয়েছে, অবদান রেখেছে। এর চেয়ে সুন্দর উদাহরণ আর হতে পারে না।
বিজ্ঞানেও এরকম পদ্ধতি চালু হওয়া দরকার। একদল বিজ্ঞানীর মাঝে কোনো একজন বা দুজন খুব বেশি অবদান রাখলে তাকে বা তাদের দুজনকে দেওয়া হবে অর্ধেক আর দলের বাকি সদস্যদের দেওয়া হবে অর্ধেক। এভাবে হয়তো নোবেল পাবে LIGO কিংবা CERN-এর মতো গবেষণাগার।
এটি চালু হলে নোবেল পুরস্কারের অন্যান্য বিতর্কগুলোও এড়ানো যাবে। যেমন- নোবেল বর্তমানে যারা শেষপর্যন্ত টিকে থাকে তাদের দেওয়া হয়। ডিএনএর গঠন আবিষ্কারের জন্য সকল কাজ করেছিলেন রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিন। কিন্তু মারা যাবার কারণে তা আর পাননি তিনি। তার বদলে পেয়েছে টিকে থাকা ওয়াটসন, ক্রিক ও উইলকিন্স। তারা মূলত রোজালিন্ডের কাজই নকল করেছিলেন।
এন্টি-টক্সিন আবিষ্কারের সম্মানে চিকিৎসাবিদ্যায় নোবেল দেওয়া হয়েছিল এমিল ডন বেরিংকে। সেই আবিষ্কারের পেছনে মূল্যবান ভূমিকা রেখেছিলেন তার ছাত্র শিবাসাবুরো কিতাসাতো। এন্টিবায়োটিক স্ট্রেপটোমাইসিন আবিষ্কারের জন্য ১৯৫২ সালে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় সালমান ওয়াকস্মানকে, কিন্তু তার ছাত্র আলবার্ট শটজকে পুরোপুরিই এড়িয়ে যাওয়া হয়। অথচ তিনিই মূল কেমিক্যালটা খুঁজে পেয়েছিলেন। এরকম উদাহরণ ভুরি ভুরি দেওয়া যাবে।
নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানের জন্য নোবেল পুরস্কার অনেক কিছু করছে। যেখানে সারা দুনিয়া নায়ক-নায়িকার আলোচনায় মত্ত, বিনোদন সংক্রান্ত বিষয়েই যেখানে সকল প্রতিষ্ঠান অর্থ ঢালে, অস্কার কিংবা অ্যামি অ্যাওয়ার্ড নিয়েই যেখানে মাতামাতি, সেখানে বিজ্ঞানের কাজকে মূল্য দিয়ে পুরস্কৃত করা এবং সম্মান দেওয়া আসলেই অনেক মহৎ একটি কাজ। কিন্তু সেটি করতে গিয়ে যদি সবার প্রতি ন্যায়বিচার করা না হয় তাহলে এর মাহাত্ম্য থাকে কোথায়? অর্থনৈতিকভাবে এবং সামাজিকভাবে হয়তো নোবেল পুরস্কার বিজ্ঞানের অনেক উপকার করছে, কিন্তু দার্শনিক দিক থেকে প্রয়াসটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিজ্ঞানেরই ভালোর জন্য, বিজ্ঞানীদেরই স্বীকৃতির জন্য নিয়ম পাল্টে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানীকে একত্রে পুরস্কৃত করার মাঝে ক্ষতির কিছু নেই।
আরো দেখুন