গত কয়েকদিন ধরে মনটা অস্থির হয়ে আছে মুহিনের। প্রচণ্ড রকমের দোটানায় ভুগছে সে। তিন বছর হলো মিলির সাথে বিয়ে হয়েছে তার। এতদিন স্ত্রীর সাথে সবসময়ই খুব ভালো ব্যবহার করে এসেছে সে। কখনো গলা উঁচু করে কথা বলেনি। কখনো ঝগড়ার উপক্রম হলেও সে অত্যন্ত চতুরতার সাথে তা এড়াতে সক্ষম হয়েছে। তবে ইদানিং কাজটি ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ছে তার জন্য।
মুহিন কখনোই চায় না মিলির সাথে বিবাদে লিপ্ত হতে, মিলির মনে কষ্ট দিতে। কিন্তু মিলির একটি চারিত্রিক ত্রুটি হলো, সে খুব বেশি মাত্রায় দীর্ঘসূত্রিতায় আক্রান্ত। একবার বললে কখনোই কোনো কাজ করে না। এমনকি তা অফিসের খুব জরুরি কাজ হলেও। প্রতিটি কাজের একদম ডেডলাইন ঘনিয়ে এলে কাজটি শুরু করে, এবং তখন তাড়াহুড়ায় কী করবে না করবে ভেবে না পেয়ে একেবারে চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করে। কাজটি ভালো করে করা তো হয়ই না, বরং নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়ে যায়। শেষমেশ কাজটি সন্তোষজনক না হওয়ায় তীব্র অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে। কেন কাজটি আগেই করলাম না, এমন আক্ষেপেও পুড়তে থাকে।
কিন্তু আক্ষেপে পুড়েই বা লাভ কী! এ যে এক অসীম চক্র। কিছুদিন যেতে না যেতেই সব ভুলে যায় মিলি, এবং পরেরবার কোনো কাজ করতে গিয়েও ঠিক একই পরিস্থিতির অবতারণা ঘটায়। মুহিন অনেকবার চেষ্টা করেছে মিলিকে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝাতে যে দীর্ঘসূত্রিতা কত বাজে একটি স্বভাব, কেন সময়ের কাজ সময়ের মধ্যে করে ফেলাই শ্রেয়। মিলি ভাব দেখিয়েছে ঠিকই যে সে বুঝেছে, কিন্তু কাজের বেলায় লবডঙ্কা! বারবার মিলিকে এমন করতে দেখে এখন মুহিনেরও ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে। সে আর পারছে না বিরক্তি চেপে রেখে ঠাণ্ডা মাথায় মিলিকে বোঝাতে।
এখন মুহিন ভাবছে, কাজটি এবারও সময়ের মধ্যে করতে না পারলে ব্যাপারটা কত বাজে হবে সে ব্যাপারে ভয় দেখিয়ে, প্রয়োজনে হালকা ধমক দিয়ে, এবং খানিকটা জোর করে হলেও মিলিকে দিয়ে কাজটি করাবে কি না। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার তার মনে হচ্ছে, সে তো শপথ নিয়েছিল আর পাঁচটা স্বামীর মতো সে নিজের স্ত্রীর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না, বরং সবসময় সদ্ভাব বজায় রাখবে। এখন তবে এমনটি করা কি ঠিক হবে?
এসব ভাবনাচিন্তায় দোনোমনা করতে করতে পুরো ব্যাপারটি মুহিন খুলে বলল তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। বন্ধুটি সব শোনার পর খানিকক্ষণ চিন্তা করে কী যেন ভাবল। তারপরই তার চোখদুটো জ্বলে উঠল। সে সোৎসাহে মুহিনকে বলল, “আরে এত চিন্তা কী! মনে নেই শেক্সপিয়ার হ্যামলেটের মুখ দিয়ে কী বলিয়েছিলেন?”
মুহিন জিজ্ঞেস করল, “কী?”
“I must be cruel, only to be kind!”
প্রিয় পাঠক, আসলে হ্যামলেট এই উক্তির মাধ্যমে কী নির্দেশ করেছিলেন, তা বুঝতে গেলে আপনাদের পড়তে হবে ‘হ্যামলেট’ নাটকটি। তবে মুহিনের বন্ধু এই উক্তির মাধ্যমে মুহিনকে কী বোঝাতে চেয়েছে, তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে ধরে ফেলেছেন।
স্ত্রী মিলির ভালোর জন্যই তার প্রতি সাময়িকভাবে রূঢ় হতে হবে মুহিনকে!
এখন প্রশ্ন হলো, এই যুক্তি কি আসলেই সঠিক? কারো ভালোর জন্য তার প্রতি কঠোর হওয়া কি উচিত? তাতে কি সত্যিই মানুষটির ভালো করা হয়, নাকি ভালো করতে গিয়ে হীতে বিপরীত হয়ে যায়?
এ প্রসঙ্গে অনেকের কাছে অনেক রকম তত্ত্ব ও ধারণা পাওয়া যাবে। তবে যারা কেবল বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ই বিশ্বাসী এবং এতদিন ভেবে এসেছে এ ধরনের একটি বিষয়কে কখনোই বিজ্ঞানের পক্ষে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে না, তাদের জন্য সুখবর: বৈজ্ঞানিকভাবেই প্রমাণ মিলেছে এ প্রশ্নের যে কারো মঙ্গলের জন্য তার প্রতি মাঝেমধ্যে নির্দয় আচরণ করা ফলদায়ক কি না।
বৈজ্ঞানিক গবেষণাটি করেছেন যুক্তরাজ্যের লিভারপুল হোপ ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের প্রভাষক বেলেন লোপেজ-পেরেজ ও তার দল। তারা ল্যাব গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, কারো মঙ্গলের জন্য তার প্রতি নিষ্ঠুর হওয়াটা অনেকসময়ই কাজে দেয়।
সাইকোলজিক্যাল সায়েন্স-এ প্রকাশিত লোপেজ-পেরেজের গবেষণা প্রবন্ধটি বলছে, কখনো কখনো অন্যের মনে স্বেচ্ছায় নেতিবাচক আবেগ ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে, যদি মনে হয় যে দীর্ঘযাত্রায় এই আবেগগুলো তার জন্য উপকারী হয়ে উঠবে।
ইতিপূর্বে কিছু গবেষণায় উঠে এসেছিল যে, একজন মানুষ যখন অন্যের মনে নেতিবাচক আবেগ স্থাপন করতে চায়, তার পেছনে মানুষটির ব্যক্তিগত স্বার্থ বা মানসিক প্রশান্তি কাজ করে। কিন্তু নতুন গবেষণাটি বলছে, কাউকে মানসিকভাবে আঘাত দেয়ার উদ্দেশ্য কেবল এটুকুতেই সীমাবদ্ধ নয়। ক্ষেত্রবিশেষে এই আঘাতগুলো কল্যাণকর উদ্দেশ্যেও দেয়া হয়ে থাকে।
বিষয়টি লোপেজ-পেরেজ এভাবে ব্যাখ্যা করেন,
“আমরা দেখেছি মানুষ সত্যিই পারে ‘cruel to be kind’ হতে। অর্থাৎ বিষয়টি এমন যে, তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে অন্য কাউকে মানসিকভাবে খারাপ অনুভব করাতে, যদি তাদের কাছে মনে হয় যে এই নেতিবাচক আবেগগুলো ওই অপর মানুষটির জন্য কল্যাণকর হবে। এমনটি তখনো হতে পারে, যদি প্রথম ব্যক্তিটির নিজস্ব কোনো স্বার্থসিদ্ধির সম্ভাবনা না-ও থাকে।
“আমরা দৈনন্দিন জীবনের এমন বেশ কিছু দৃষ্টান্ত শনাক্ত করতে পেরেছি। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় সেই বিশেষ ঘটনাটির কথা, যখন কাছের কোনো মানুষ পরীক্ষার আগে পড়াশোনার দীর্ঘসূত্রিতা দেখালে ভয় দেখিয়ে তাকে পড়তে বসানো হয়।”
গবেষকদের প্রাথমিক অনুমান ছিল এই যে, কোনো একজন অংশগ্রহণকারীকে যদি অন্য কোনো ব্যক্তির পরিপ্রেক্ষিত গ্রহণ করতে বলা হয়, তাহলে হয়তো সে ওই অপর ব্যক্তির উপর নেতিবাচক কোনো অভিজ্ঞতা চাপিয়ে দিতে চাইবে, কারণ সে মনে করবে এর মাধ্যমে অপর মানুষটির পক্ষে কোনো একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে।
অনুমানটির সত্যতা যাচাই করার জন্য ১৪০ জন প্রাপ্তবয়স্ক অংশগ্রহণকারীকে altruistic affect-worsening শীর্ষক একটি ল্যাবভিত্তিক গবেষণায় নেয়া হয়। সেখানে প্লেয়ার বি হিসেবে তাদেরকে কম্পিউটার গেমস খেলতে হবে প্লেয়ার এ-র বিরুদ্ধে। তাদেরকে জানানো হয়, প্লেয়ার এ-ও একজন অংশগ্রহণকারী। কিন্তু আদতে প্লেয়ার এ বলতে কেউ ছিল না, স্বয়ং কম্পিউটারই ছিল প্লেয়ার এ।
খেলা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ আগে অংশগ্রহণকারীরা প্রত্যেকে প্লেয়ার এ-র কাছ থেকে একটি নোট পায়। সেখানে কাল্পনিক প্লেয়ার এ জানায়, সম্প্রতি তার ব্রেকআপ হয়েছে এবং সে খুবই মানসিক যাতনায় রয়েছে। এরপর অংশগ্রহণকারীদের একাংশকে বলা হয় প্লেয়ার এ-র প্রতি সহানুভূতিশীল হতে এবং সে কেমন বোধ করছে তা অনুভব করতে। অপর অংশকে বলা হয় প্লেয়ার এ-র ব্যাপারে মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকতে।
এরপর অংশগ্রহণকারীদের আবার দুটি আলাদা দলে ভাগ করে দেয়া হয়। একটি দলকে দেয়া হয় সোলজার অভ ফরচুন নামক ফার্স্ট-পারসন শ্যুটার গেমটি খেলতে, যেখানে তাদের কাজ হলো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। অপর দলকে বলা হয় ফার্স্ট-পারসন গেম এসকেপ ডেড আইল্যান্ড খেলতে, যেখানে তাদের কাজ হলো জোম্বি পরিপূর্ণ একটি ঘর থেকে পালিয়ে বাঁচা।
প্রত্যেক অংশগ্রহণকারী পাঁচ মিনিট করে একা একা গেমটি অনুশীলন করতে দেয়া হয়। এরপর তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের মতে কীভাবে তাদের কাল্পনিক প্রতিপক্ষ অর্থাৎ প্লেয়ার এ-র সামনে গেমটি উপস্থাপন করা উচিত। যেসব অংশগ্রহণকারী গভীরভাবে তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, তারা বলে সম্মুখ সমরে লড়াইয়ের গেমটিতে তাদের প্রতিপক্ষকে যেন রাগিয়ে দেয়া হয়, আর আত্মরক্ষার গেমটিতে তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয়, কেননা এই দুই ধরনের মনোভাবের ফলে প্লেয়ার এ-র পক্ষে গেমটি জেতার সম্ভাবনা বাড়বে; এবং তারা মানসিকভাবে কিছুটা ভালো বোধ করবে, আবার প্রাইজমানি হিসেবে ৫০ পাউন্ডের অ্যামাজন গিফট ভাউচারও জিতবে।
সহজ কথায় বলতে গেলে, সহানুভূতিশীল অংশগ্রহণকারীদের মনে হয়েছে, নেতিবাচক অনুভূতিই পারে মানসিকভাবে ভঙ্গুর ব্যক্তিকে সবচেয়ে ভালো প্রণোদনা যোগাতে। তাই তারা প্রতিপক্ষের কল্যাণের কথা ভেবেই তাদের মনে নেতিবাচক অনুভূতি সঞ্চার করতে চেয়েছে, এমনকি তাহলে নিজেদের জয় ও পুরস্কারপ্রাপ্তির সম্ভাবনা কমে যাবে জেনেও।
এভাবেই গবেষক দলটি হাতে-কলমে প্রমাণ পেয়ে যায়, মানুষ যখন কারো প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠে, তখন তার সাফল্যের স্বার্থেই তার মধ্যে রাগ, ভয় ইত্যাদি নেতিবাচক অনুভূতি প্রবেশ করাতে চায়, যেন এই অনুভূতিগুলোর প্রভাবে সে নিজের কাজটি আরো ভালোভাবে করতে পারে, এবং সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়।
গবেষকরা নিজেরাই স্বীকার করেন যে তাদের প্রাপ্ত এই ফলাফলের পরও কিছু প্রশ্ন রয়েই যায়। তারা তো তাদের গবেষণাটি পরিচালিত করেছেন মূলত অপরিচিত ব্যক্তিদের উপর। অন্যের মধ্যে নেতিবাচক আবেগ সঞ্চারের এই পদ্ধতি শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালে কতটা কার্যকর? কিংবা ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের বেলায়ই বা এটি কীভাবে কাজ করে?
পূর্বের আরো কিছু গবেষণার উদাহরণ টেনে তারা বলেন, নেতিবাচক আবেগকে প্রণোদনার যোগানদাতা হিসেবে ব্যবহারের এই কৌশলটি আরো বেশি স্পষ্টভাবে ধরা দিতে পারে। অপরিচিত কারো কাছ থেকে প্রাপ্ত নেতিবাচক আবেগ একজন মানুষকে যতটা না প্রভাবিত করে, তার চেয়ে অনেক বেশি নাড়া দেয় তখন, যখন খুব কাছের কারো মাধ্যমে সে এই নেতিবাচক অনুভূতিগুলো লাভ করে। আর তাই নিজের কাজটি ঠিকভাবে করার মাধ্যমে নিজের দক্ষতা, যোগ্যতা বা কার্যকারিতা প্রমাণ করে দিতে সে আরো বেশি মরিয়া হয়ে ওঠে। একই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় শিশু-কিশোরদের মাঝেও।
সুতরাং এটি প্রমাণিত যে, “কোমলতার জন্য কঠোরতা” কোনো অমূলক বাগাড়ম্বর নয়। সত্যিই কাউকে সাফল্যের জন্য কঠোর পরিশ্রমে তাতিয়ে দিতে কঠোরতা ও নিষ্ঠুরতা হতে পারে বেশ কার্যকরী একটি পদ্ধতি। তাই কারো ভালোর জন্যই যদি আপনি মাঝেসাঝে তার সাথে রূঢ় আচরণ করেন, তাকে কষ্ট দেন, তাতে অনুতপ্ত হওয়ার কিছু নেই। কারণ চাণক্য তো বলেছেনই, দিনশেষে ফলাফলই শেষ কথা। সেই ফলাফল যদি ইতিবাচক হয়, তাহলে ক্ষণস্থায়ী নেতিবাচক অনুভূতির কারণে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
তবে গবেষকরা এটিও সাবধান করে দিয়েছেন যে, সবসময়ই রূঢ়তা বা নিষ্ঠুরতা কোনো সমাধান হতে পারে না। অর্থাৎ কেউ কোনো কাজ করতে না চাওয়া, কিংবা সামান্য কোনো ভুল করা মাত্রই যদি আপনি তাকে গালমন্দ করতে শুরু করেন, তাকে খারাপ অনুভব করাতে চান, সেটি কখনোই ভালো ফল বয়ে আনবে না। বরং এটিই প্রমাণিত হবে যে তার প্রতি আপনার একটুও আস্থা নেই। এতে করে সে-ও মনোবল খুইয়ে, কাজটি ঠিকভাবে সম্পন্ন করার উদ্যম হারিয়ে ফেলবে।
তাই কারো প্রতি রূঢ় আচরণ করে মনে নেতিবাচক আবেগ সঞ্চার করা হওয়া উচিৎ সর্বশেষ ধাপ। আগে তাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে, অনুপ্রেরণা যুগিয়ে কাজটি করানো উচিৎ। নিজের অবস্থান থেকে যতটুকু সম্ভব সাহায্যও তাকে করা দরকার। নিতান্তই যদি এগুলো কাজে না দেয়, তাহলেই আপনি খেলতে পারেন নিষ্ঠুর আচরণের ট্রাম্পকার্ডটি।
বিজ্ঞানের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/