আমরা বাস করছি এমন এক গ্রহে, যেখানে পানি ছাড়াও আছে জীবাশ্ম জ্বালানী নামক আশীর্বাদ। ভূগর্ভে মিলিয়ন মিলিয়ন বছর ধরে বিশেষ প্রক্রিয়া তৈরি হওয়া এই আশীর্বাদের অংশগুলো হলো তেল, কয়লা, গ্যাস। প্রতি বছর পৃথিবী জুড়ে গড়ে প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ব্যারেলেরও বেশি জ্বালানি তেল ব্যবহার করা হয়, যেখানে ২০১৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই দিনে গড়ে প্রায় ৯.৩২ মিলিয়ন ব্যারেল জ্বালানী ব্যবহার করা হয়েছে। পৃথিবীকে গতিশীল রাখতে তাই এর গুরুত্ব নতুন করে মনে করিয়ে দেবার কিছু নেই। কিন্তু আশীর্বাদটা যখন সীমিত পরিমাণের আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে এর চাহিদাটাও বাড়তে থাকে তখন মাথা ঘামানোটা জরুরি হয়ে পড়ে। ইতোমধ্যেই আমরা পৃথিবীর মোট জ্বালানীর ৪০ শতাংশেরও বেশি খরচ করে ফেলেছি।
কিন্তু আশীর্বাদ যদি অভিশাপ ডেকে আনে তবে? এই সকল জীবাশ্ম জ্বালানীর মূল উপাদান কার্বন, যা ধীরে ধীরে পরিবেশের সাথে মিশে বিষাক্ত করে তুলছে পৃথিবীর পরিবেশ, খুব দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে বৈশ্বিক উষ্ণতা।
আগামী ৫০ বছরের মধ্যে ফুরিয়ে আসতে পারে এই জ্বালানী তেল। আর কয়লার ক্ষেত্রে লাগতে পারে ১০০ বছর। সময়টা আমাদের জন্য নেহায়েত কম নয়, তবে এর জন্য আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলোকে এর মাশুল গুণতে হবে।
আর তাই আমরা বিকল্প পথে হাঁটা শুরু করেছি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে, যাতে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা একেবারে কমে আসে, একইসাথে তা হয় পরিবেশবান্ধব এবং অফুরন্ত। তবে এখনো মোট শক্তির মাত্র প্রায় ১৩ শতাংশ আসে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে। যেখানে কেবলমাত্র সূর্য থেকেই প্রতিমুহূর্তে বিকিরিত হয়ে পৃথিবীতে আসে প্রায় ১৭৩ হাজার টেরাওয়াট সৌরশক্তি (১৭৩ এর পরে ১৫টি শূন্য), যা আমাদের বর্তমান প্রয়োজনের প্রায় ১০,০০০ গুণ।
আর এই সৌরশক্তিকে সংরক্ষণ করার জন্য আমাদের আছে উন্নত প্রযুক্তি- সোলার প্যানেল। হিসাব করে দেখা গিয়েছে, কয়েকশত হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা দখলকারী একটি সোলার প্যানেল পুরো পৃথিবীর শক্তি যোগানোর জন্য যথেষ্ট। তাহলে একটি প্রশ্ন মনের কোণায় উদয় হওয়া স্বাভাবিক, পুরো পৃথিবীর শক্তির যোগান দিতে কেন কেবলমাত্র সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হচ্ছে না?
এর পেছনে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক বাধা, বৈজ্ঞানিক ও ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা, শক্তির রূপান্তর ও পরিবহনগত সীমাবদ্ধতা। তবে এই উত্তর পাবার আগে আমাদের সোলার প্যানেলের কার্যপদ্ধতির দিকে নজর দেওয়া যাক। কিন্তু এখানে রাজনৈতিক বাধা আমাদের আলোচনার অংশ না। শুরুতেই খুব সংক্ষেপে দেখা যাক সোলার প্যানেল কীভাবে কাজ করে।
সোলার প্যানেলের মূল গাঠনিক একক হলো সোলার সেল বা সৌর কোষ, যার অপর নাম ফটোভোলটাইক সেল। ছোট ছোট অনেকগুলো সেল নিয়ে তৈরি হয় একটি সোলার মডিউল, আর অনেকগুলো মডিউল নিয়ে একটি প্যানেল। আবার এই সেলগুলোর মূল উপাদান হলো সিলিকন। ইলেকট্রনিক্স পণ্য তৈরির ক্ষেত্রে জাদুর কাঠি বলা চলে এই সিলিকনকে। সিলিকনের অর্ধপরিবাহীতা ধর্মকে কাজে লাগানো হয় এসব ক্ষেত্রে। সোলার প্যানেলেও তার ব্যতিক্রম নয়।
ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট বা আলোকতড়িৎ ক্রিয়াকে কাজে লাগিয়ে সূর্যালোককে তড়িৎ প্রবাহে রূপান্তর করা হলো এই সকল ফটোভোলটাইক সেলের কাজ। খুব সংক্ষেপে, সহজ ভাষায় আলোকতড়িৎ ক্রিয়া হলো, যখন কোনো আলোর কণা কোনো ধাতব পদার্থে পড়ে, তখন সেই আলোক কণার আঘাতে পদার্থের বহিঃস্তরের ইলেকট্রন নির্গমন ঘটে। এই ক্রিয়া ব্যাখ্যার জন্য ১৯২১ সালে অ্যালবার্ট আইনস্টাইনকে নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়।
কিন্তু সোলার প্যানেলে এর কাজ কী? জটিল এই প্রক্রিয়াকে আরেকটু সহজ করে বলা যাক।
সিলিকন ক্রিস্টাল ব্যবহার করা হয় সোলার প্যানেল তৈরিতে। সিলিকন হলো বিশুদ্ধ অর্ধপরিবাহী। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর তড়িৎ পরিবাহীতা বৃদ্ধি পায়। সিলিকনের সাথে কিছু নির্দিষ্ট মৌল ভেজাল হিসেবে মিশিয়ে p টাইপ (পজিটিভ টাইপ) ও n টাইপ (নেগেটিভ টাইপ) অর্ধ-পরিবাহীতে পরিণত করা হয়। সোলার প্যানেলের প্রত্যেকটি সেলে p টাইপ ও n টাইপ অর্ধপরিবাহী সিলিকনকে স্যান্ডউইচের মতো স্তরে স্তরে স্থাপন করে p-n জাংশন তৈরি করা হয়। স্বাভাবিকভাবে এরা সাম্যাবস্থায় থাকে। ফলে এর মাঝে বিদ্যুৎ চলাচল করে না।
কিন্তু যখন আলোর কণা, ফোটন এসব সেলে এসে পড়ে, তখন আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ফলে ফোটনের আঘাতে সিলিকনের ইলেকট্রনগুলোর বন্ধন থেকে ছুটে যায়। ক্রমাগত ফোটনের আঘাতের ফলে p-n জাংশনে বিভব পার্থক্য থেকে তড়িৎক্ষেত্র সৃষ্টি হয়, যা থেকে বিদ্যুৎপ্রবাহ ঘটে। এই তড়িৎপ্রবাহ হয় একমুখী, যা প্যানেলের সাথে যুক্ত তারের মাধ্যমে প্রবাহিত করে সংরক্ষণ করা হয়।
নিঃসন্দেহে এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া শতভাগ পরিবেশ বান্ধব এবং পরিমাণে অফুরন্ত। আলো আর ইলেকট্রনই যখন এই প্রক্রিয়ার মূল চাবিকাঠি, তখন তা অতিরিক্ত টেকসই হওয়াটাই স্বাভাবিক। ১২টি সোলার সেল একটি মোবাইল ফোন চার্জ দেয়ার জন্য যথেষ্ট, যেখানে একটি পুরো বাড়ির জন্য প্রয়োজন কয়েকটি মডিউল। আর পুরো পৃথিবীকে পরিচালিত করতে মাত্র ৪,৯৬,৮০৫ বর্গ কিলোমিটার বিশিষ্ট সোলার প্যানেল স্থাপন করা প্রয়োজন, যেখানে সাহারা মরুভূমিই আয়তনে ৯.২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার।
তবে এই স্বপ্ন-প্রকল্প বাস্তবায়নে কীসের এত বাধা?
১৯৫৮ সালে সোলার প্যানেল সর্বপ্রথম ব্যবহার করা হয় ইউএস ভ্যানগার্ড-১ স্যাটেলাইটটিতে। সেসময় খরচ পড়তো প্রতি ওয়াটে প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। আর বর্তমান সময়ে খরচের পরিমাণটা প্রতি ওয়াটে মাত্র কয়েক টাকা। গত ৬০ বছরে এই প্রযুক্তির পরিবর্তনটা না হয় মনে মনেই হিসাব করুন। কিন্তু হিসাবটা যখন পুরো পৃথিবীর তখন কল্পনাটা বাস্তবতার কাছে দুর্বল হয়ে যায়।
সূর্যের আলো পৃথিবীর সব স্থানে সমানভাবে পড়ে না। তাছাড়া রাতেও সূর্যের আলো থাকে না। সোলার প্যানেলের প্রধান শত্রু বৈরী আবহাওয়া এবং মেঘে ঢাকা দিন। অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দিনের পর দিন সূর্যের দেখা মেলে না অনেক সময়। বর্ষা এবং শীতপ্রধান অঞ্চলে এই সমস্যা আরো প্রকট। সেসব অঞ্চলে সোলার প্যানেল খুব একটা কাজে আসবে না। এছাড়াও আছে ভৌগলিক অবস্থানগত সীমাবদ্ধতা। কিছু কিছু অঞ্চল সারাবছর রৌদ্রজ্জ্বল থাকলেও মেরু অঞ্চল সারাবছর থাকে বরফে ঢাকা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই মেরু অঞ্চলে সোলার প্যানেল বসানোটা কতটা লাভজনক এই প্রশ্ন করাটা রীতিমতো হাস্যকর হয়ে দাঁড়াবে।
আবার সোলার প্যানেল নিজেই এর প্রসারের পথে অন্তরায়। এখন পর্যন্ত বাজারের সোলার প্যানেলগুলোর গড় কর্মদক্ষতা ১৫-২০ শতাংশ। অর্থাৎ কেবল একটি প্যানেল সূর্যের আলোক রশ্মির মাত্র ১৫-২০ শতাংশ শক্তিতে রূপান্তর করতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত চল্লিশ শতাংশের বেশি কর্মদক্ষতা সম্পন্ন প্যানেল তৈরি করতে পেরেছেন। তবে সেই প্রযুক্তি বিশিষ্ট সোলার প্যানেলের বাজারে আনলে তার দাম হবে আকাশচুম্বী।
সোলার প্যানেল থেকে সাধারণত দুভাবে শক্তি উৎপাদন সম্ভব। প্রথমত, বাসা বা প্রতিষ্ঠানের ছাদে সোলার প্যানেল স্থাপন করে, দ্বিতীয়ত, সোলার ফার্ম স্থাপন করে গ্রিডের মাধ্যমে নির্দিষ্ট অঞ্চলে সরবরাহ করে। কিন্তু এই উৎপাদিত বিদ্যুৎ পরিবহনে তারের মাধ্যমে অপচয় ঘটে দশ শতাংশ বা তার থেকেও বেশি। তাই আপনি যদি ভেবে থাকেন কেবল সাহারা থেকেই সারা পৃথিবীর শক্তি যোগানো সম্ভব তাহলে সেই ভাবনা বাদ দিতে হচ্ছে। কারণ তার জন্য আমরা এখনো প্রস্তুত নই প্রযুক্তিগত বা অর্থনৈতিক দিকে থেকে।
তাই সাহারা থেকে কয়েক হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে এত বিদ্যুৎ অপচয় করাটা কখনোই সাশ্রয়ী সমাধান নয়। এর সমাধানে আমাদের দরকার অতিপরিবাহী পদার্থ, যাতে কোনো রকম অপচয় না ঘটে। তবে দুঃখের বিষয়, এই প্রযুক্তি এখনো আমাদের নাগালের অনেক বাইরে। এখানেই শেষ নয়, আদতে সোলার প্রযুক্তির যে উন্নতি ঘটেছে গত অর্ধ শতাব্দীতে, তাতে এই স্বপ্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থের পরিমাণ বহুগুণে বেশি। সোলার প্যানেল প্রস্তুতিকরণে মূল্য যে হারে হ্রাস পেয়েছে, সেই হারে সোলার প্যানেল চালিত বিদ্যুৎ পরিবহনের মূল্য হ্রাস পায়নি।
পুরোপুরিভাবে সোলার প্যানেলের উপর নির্ভরশীল হতে গেলে অবকাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে ব্যাপকভাবে। শুরুতেই লাগবে কার্যকর ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টোরেজ। বর্তমানে এর জন্য আমাদের উন্নত প্রযুক্তির লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি আছে, কিন্তু এর ধারণক্ষমতা প্রতি কেজিতে ২.৫ মেগাজুল, যা গ্যাসোলিনের থেকে বিশ শতাংশ কম। একটি জেট প্লেন চালাতে প্রয়োজন পড়বে ১০০ টনের লিথিয়াম ব্যাটারি। সুতরাং, উচ্চ শক্তি-ঘনত্ব ও ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারি তৈরি থেকে আমরা যে অনেকটা পিছিয়ে আছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এছাড়া পেট্রোলচালিত সব যানবহনের পরিবর্তে বিদ্যুতচালিত যানবাহনের প্রচলন ঘটাতে দরকার হবে প্রচুর পরিমাণ বিনিয়োগের, যাতে লেগে যেতে পারে কয়েক দশক। রাতারাতি তাই এই বিপ্লব ঘটানো সম্ভব নয়।
উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র দেশগুলোর জন্য এই পরিবর্তন রীতিমতো এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত একটি দেশে এই পরিবর্তন আনতে লেগে যেতে পারে কয়েক বছর, সেখানে দরিদ্র, স্বল্পোন্নত কিংবা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য তা কয় দশক লাগবে সেটা আরেক প্রশ্নের দাবিদার।
কিন্তু এত সীমাবদ্ধতা থাকার পরও আমাদের যে প্রযুক্তি আছে তাতেই পুরো পৃথিবীর জৈব জ্বালানী নির্ভরশীলতা অর্ধেকেরও বেশি কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানীগণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন আরো কার্যকর প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য। এলন মাস্কের সোলার সিটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করে যাচ্ছে একটি সবুজ পৃথিবী উপহার দেবার জন্য। আমাদের অদূর ভবিষ্যতের কল্পনাও থেমে নেই যেখানে ভাসমান সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌরশক্তি সংগ্রহ করা হবে মহাকাশ থেকে। আর বিদ্যুৎ পরিবহন হবে তার ছাড়াই। কিংবা ব্ল্যাকবডি রেডিয়েশন থেকে সংগ্রহ করা হবে শক্তি।
কেবলমাত্র বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলেই ৩.৫ মিলিয়নেরও বেশি বাড়িতে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হয়। সারা পৃথিবীব্যাপী এই সংখ্যাটা ১.৩ বিলিয়ন। যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করে যাচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের জ্বালানীর ৩০ শতাংশ সোলার প্যানেল থেকে ব্যয় করার জন্য। আর ২০২০ সালের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ২৩.৫ শতাংশ করার জন্য, যেখানে আইসল্যান্ড, কোস্টারিকা, আলবেনিয়া, প্যারাগুয়ে, ইথিওপিয়ায় শতভাগের থেকে কিছুটা কম শক্তি আসে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে।
আপনার কী মনে হয়? আবারো কী পৃথিবীটা সবুজ করে তোলা সম্ভব সবুজ শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে? কতটা সময় লাগতে পারে তাতে? আর কী কী ধরনের বাধা আসতে পারে বলে আপনার মনে হয়?