কোনো প্রয়োজনে হঠাৎ ডিএনএ টেস্ট করানোর পরে যদি জানতে পারেন, আপনার শরীরে রয়েছে দুজন মানুষের অস্তিত্ত্ব, কিংবা আপনার দেহের ডিএনএ সেট যার থেকে পেয়েছেন তার এ পৃথিবীতে কখনো জন্মই হয়নি, ব্যাপারটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে কি?
এ ধরনের ব্যাপার সম্ভব এবং পৃথিবীতে নানা ঘটনার জের ধরে এর প্রমাণও পাওয়া গেছে। এমন অবস্থার নাম কাইমেরিজম এবং এ ধরনের বৈশিষ্ট্য ধারণকারী ব্যক্তিকে বলা হয় কাইমেরা বা কাইমেরিক।
প্রাচীন গ্রিক পুরাণে কাইমেরা নামের এক ধরনের প্রাণীর উল্লেখ আছে, যার একটি মাথা ও ঘাড় সিংহের মতো, পিঠ ছাগলের মতো, আরেকটি মাথা এবং লেজ সাপের মতো। অর্থাৎ এক প্রাণীর শরীরে কয়েক প্রাণীর অস্তিত্ত্ব। এ থেকেই মূলত জটিল এই শারীরিক অবস্থাটির এই নামকরণ করা হয়েছে।
বিজ্ঞানের ভাষায়, যখন একটি স্বতন্ত্র জীবের মাঝে দুটি আলাদা জিনের সেট থাকে, সেই অবস্থাই কাইমেরিজম। একজন কাইমেরার শরীরের কিছু কোষ তাদের নিজেদের নয়, বরং তাদের ভাই/ বোনের, যার কখনো জন্মই হয়নি পৃথিবীতে!
বিভিন্ন ধরনের কাইমেরিজম
টুইন কাইমেরিজম
ভ্রুণ অবস্থায় মায়ের শরীরে জমজ ভ্রুণের একটি ভ্রুণ অনেক সময় মারা যায়। এবং বেঁচে থাকা ভ্রুণটি মৃত ভ্রূণটিকে নিজের মধ্যে শোষণ (Absorb) করে নেয়। ফলে জন্ম নেওয়া মানুষটির শরীরে তার নিজের ও তার নিজের জন্ম না নেওয়া ভাই/বোনের, মোট দুই সেট ডিএনএ থাকে।
টেট্রাগ্যামেটিক কাইমেরিজম
মাতৃ গর্ভাশয়ে সাধারণত একটি শুক্রাণু দ্বারা একটি ডিম্বাণু নিষিক্ত হয়ে জাইগোট তৈরি হয়। কিন্তু, এক্ষেত্রে দুটি শুক্রাণু দুটি ডিম্বাণুকে নিষিক্ত করার পর একত্রিত হয়ে একটিমাত্র ভ্রুণে পরিণত হলেও এ ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। জন্ম নেওয়া শিশুর শরীরে তখন দুই সেট ডিএনএ পাওয়া যায়।
মাইক্রো কাইমেরিজম
গর্ভবতী অবস্থায় মা তার ভ্রুণের কিছু কোষ শোষণ করে নিতে পারে কিংবা উল্টোভাবে ভ্রুণটি মায়ের কিছু কোষ শোষণ করে নিতে পারে। এই কোষগুলো মা কিংবা শিশুর রক্তের মাধ্যমে কোনো অঙ্গে পৌঁছে স্থায়ীভাবে থেকে যায়।
কৃত্রিম কাইমেরিজম
ব্লাড ট্রান্সফিউশন, স্টেম সেল প্রতিস্থাপন কিংবা বোন ম্যারো প্রতিস্থাপনের মাধ্যমেও কোনো ব্যক্তির দেহে অন্য ব্যক্তির কিছু কোষ থেকে যেতে পারে। ফলে একজনের দেহে দুই সেট ডিএনএ দেখা যায়। যদিও বর্তমানে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে এ ধরনের ঘটনা কম দেখা যায়। এ ধরনের কাইমেরিজমে শুধু রক্তে দু’ধরনের ডিএনএ সেট দেখা যায়। কিন্তু অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় না।
কাইমেরিজমের বৈশিষ্ট্য
সকল কাইমেরিক ব্যক্তির মধ্যে একই ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। ব্যক্তি ভেদে নানা রকমের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।
১) দুই রকমের রঙ পরিলক্ষিত হয় শরীরে। পুরো শরীরের ছোট অংশ জুড়ে কিংবা প্রায় অর্ধেকের মতো অংশে শরীরের বাকি অংশের চেয়ে গাঢ় রঙ হলে তা হাইপারপিগমেন্টেশন আর হালকা রঙ হলে তা হাইপোপিগমেন্টেশন।
২) দুই চোখের রঙ দুই রকম হওয়া।
৩) রক্তে দুই ধরনের ডিএনএ সেট থাকা।
৪) শরীরে দুই ধরনের ইম্যুনিটি সিস্টেম একইসাথে কাজ করে।
বিখ্যাত কিছু ঘটনা
কারেন কিগ্যান
১৯৯৮ সালে বোস্টনে কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য কারেন কিগ্যান নামের এক ভদ্রমহিলা তার দুই ছেলের টেস্ট করান। উত্তরাধিকার সূত্রে সন্তানেরা মা-বাবা উভয়ের থেকে ডিএনএ পেলেও, তার সন্তানদের কারো সাথে তার ডিএনএ কোডের মিল পাওয়া যায়নি, যার দ্বারা প্রমাণ হয় তারা কেউ-ই কিগ্যানের সন্তান না। বোস্টনের ডাক্তাররা এরপর বেশ কিছু অনুসন্ধান চালান। তার শরীরের নানা অংশের কোষ পরীক্ষা করে দেখা হয়। অবশেষে কিগ্যানের থাইরয়েডের কোষে তার সম্পূর্ণ শরীর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ডিএনএ সেট পরিলক্ষিত হয়, যা তার ছেলেদের সাথে মিলে যায়। এ ঘটনার পরেই কিগ্যান জানতে পারেন তিনি মূলত একজন কাইমেরা। এক অর্থে তিনি নিজেই নিজের জমজ, নিজের মধ্যে অন্য এক সত্ত্বাকে ধারণ করেছিলেন।
লিডিয়া ফেয়ারচাইল্ড
২০০২ সালে লিডিয়া ফেয়ারচাইল্ডের ঘটনাটি সবচেয়ে চমকপ্রদ। তার স্বামীর সাথে বিচ্ছেদে সময় ‘সন্তানের ভরণপোষণ’ এর জন্য কোর্টে আবেদন করেন। এই আবেদনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়াই ডিএনএ টেস্ট করানো। রিপোর্টে দেখা যায়, তার ২ সন্তানের কারো সাথেই তার ডিএনএ মিলছে না! স্বাভাবিকভাবেই কোর্টে তিনি নকল মা সেজে স্বার্থোদ্ধারের জন্য প্রতারক হিসেবে সাব্যস্ত হন। তার আইনজীবী কোর্টের সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করার অনুরোধ করেন, যত দিন পর্যন্ত লিডিয়ার তৃতীয় সন্তান জন্ম না নেয়। কোর্ট একজন স্বাক্ষী উপস্থিত থাকবে সন্তান জন্মদানের সময় এই শর্তে আবেদন মঞ্জুর করেন। তৃতীয় সন্তানের জন্ম হয়, এবং তার সাথেও ডিএনএ মেলেনি লিডিয়ার। তখনই তার আইনজীবী ধারণা করেন, লিডিয়ার কাইমেরা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তখন আদালতের নির্দেশে পুনরায় ডিএনএ টেস্টে লিডিয়ার শরীরে আরেক সেট ডিএনএ খুঁজে পাওয়া গেলো। ঐ একই ধরনের ডিএনএ সেট লিডিয়া মায়ের শরীরে পাওয়া যায়। এ থেকে প্রমাণিত হয় লিডিয়া একজন কাইমেরা। বেকসুর খালাস হয় তার এবং তার সন্তানদেরও ফিরিয়ে দেয়া হয়।
টেইলর মুহল
একজন কাইমেরা হওয়ার সবচেয়ে বড় শারীরিক বৈশিষ্ট্য দেখা যায় আমেরিকান মডেল ও গায়িকা টেইলর মুহলের মাঝে। তার শরীরের মাঝ বরাবর একটি দাগ তার শরীরকে দুটি রঙে বিভক্ত করেছে। প্রথমদিকে একে তিনি জন্মদাগ বলেই জানতেন। বয়ঃসন্ধিকালের কিছু আগে থেকেই তিনি প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ১৫০টি এলার্জি টেস্টে প্রায় সবগুলো পজিটিভ আসে তার। অবশেষে এক ডাক্তার তাকে কাইমেরা হিসেবে ঘোষণা দেন। তার শরীরে একইসাথে দুটি ইমিউন সিস্টেম কাজ করে। টেইলর বিভিন্ন সময় জানান, ছোটবেলা থেকেই তার মধ্যে একধরনের অনুভূতি কাজ করতো যে, তার মধ্যেই আরেকটি সত্ত্বা বাস করছে।
কাইমেরিজমের প্রভাব
১) যে ধরনের কাইমেরিজমের প্রভাবে উভলিঙ্গতার বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, সেক্ষেত্রে প্রজননের ঝুঁকি থাকে।
২) টুইন কাইমেরার ক্ষেত্রে নানা ধরনের অটো ইমিউন রোগ দেখা যেতে পারে।
৩) ডিপ্রেশনসহ নানা ধরনের সাইকোলজিক্যাল সমস্যা দেখা যেতে পারে।
কোনো ব্যক্তি কাইমেরিক কি না তা রক্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমেই নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। পৃথিবীতে এ ধরনের ঘটনা পাওয়া গেছে একশোর মতো। লিখিত আছে ৩০টি ঘটনা। পূর্বে ধারণা করা হতো, কাইমেরিজম খুবই বিরল একটি ব্যাপার। কিন্তু বর্তমানে নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে কাইমেরিজমের ধরণ ও নানা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করে গবেষকদের ধারণা, কাইমেরা রোগীর অস্তিত্ত্ব পৃথিবীতে আমাদের ধারণার চেয়েও অনেক বেশি। অনেক ক্ষেত্রেই শারীরিক তেমন কোনো লক্ষণ না দেখা যাওয়ায় এই ব্যাপারে মানুষ তার জীবদ্দশায় জানতেও পারে না। বিভিন্ন প্রয়োজনে মানুষ ব্লাড ও ডিএনএ টেস্ট করানোতেই জানতে পেরেছেন তারা আসলে কাইমেরা।
একজন মানুষের দেহ থেকে এ অবস্থার নির্মূলকরণ সম্ভব নয়। তবে গবেষকদের মতে, ব্যক্তিকে তার অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দিলে এবং বিভিন্ন লক্ষণের উপশমে নিয়মিত চিকিৎসা চালিয়ে গেলে ঐ ব্যক্তির জীবনধারণ সহজ হবে।