ধাতব পদার্থ ক্রোমিয়ামের একটি রূপ হলো ক্রোমিয়াম-৬। ক্রোমিয়াম পর্যায় সারণির গ্রপ ৬ এর ২৪ নম্বর মৌল। আর ষড়যোজী ক্রোমিয়ামই হলো ক্রোমিয়াম-৬। ক্রোমিয়াম-৬ ক্রোমিয়ামেরই একটি প্রকার হলেও এর বড় পরিচয় হলো এটি একটি ‘হিউম্যান কার্সিনোজেন’। অর্থাৎ মানবদেহে এই পদার্থ প্রবেশ করলে তা ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এই বিষয় নিশ্চিত করেন গবেষকেরা। ‘এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি’ (ইপিএ) এই ষড়যোজী ক্রোমিয়ামকে কার্সিনোজেন বলে অ্যাখায়িত করে। কিন্তু কতটুক ক্রোমিয়াম ৬ বিপদের লক্ষণ সেই সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য দিতে পারেনি ইপিএ। ১৯৯১ সালে পানযোগ্য পানিতে কতটুকু ক্রোমিয়াম থাকা উচিত এবং এই বিষয়ে কিছু নিয়ম-কানুন জানায় তারা। তবে হিসেবটা ছিল সম্মিলিতভাবে সব ধরনের ক্রোমিয়াম নিয়ে, শুধু ক্রোমিয়াম-৬ নিয়ে নয়। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ক্রোমিয়াম-৩, যা শরীরের গঠন এবং দৈহিক বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় দুটি উপাদানের হিসেব একসাথে করে মাত্রা নির্ধারণ করায় হিসেবটা সকলের কাছে অস্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায়।
শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ক্রোমিয়াম-৬ দেহে প্রবেশ করলে তা ফুসফুসে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া কিডনি এবং অন্ত্রে যেসব কৈশিক নালিকা রয়েছে সেগুলোরও ক্ষতিসাধন করতে পারে এই বিপজ্জনক পদার্থ। পরিবেশে ক্রোমিয়াম-৬ পদার্থটির বৃদ্ধি মানবদেহে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ রোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব কারখানায় ক্রোমিয়াম-৬ ব্যবহৃত হয় বা উৎপন্ন হয় সেসব কারখানার শ্রমিকরা প্রায়ই ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল অসুখে ভুগে থাকেন।
অবশ্য ক্রোমিয়াম ৬ পদার্থটির মূল উৎস ক্রোমিয়াম একদমই গন্ধহীন এবং স্বাদহীন একটি পদার্থ। প্রকৃতিতে এটি পাথর, মাটি, খনিজ, আগ্নেয়গিরির আশেপাশে পাওয়া যায়। এছাড়া উদ্ভিদ, প্রাণী, এমনকি মানুষের দেহেও কিছু পরিমাণ ক্রোমিয়াম থাকে। এর গুরুত্বপূর্ণ কোনো প্রভাবও নেই। তবে সমস্যা তখনই সৃষ্টি হয় যখন ক্রোমিয়াম-৬ শরীরে অধিক পরিমাণে প্রবেশ করে। প্রাকৃতিকভাবেই এই পদার্থ পরিবেশে পাওয়া যায়। তবে শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রক্রিয়ার কারণে এই পদার্থ অধিক পরিমাণে উৎপন্ন হয়। স্টেইনলেস স্টিল তৈরি, চামড়ার কারখানায়, কাঠ সংরক্ষণ করতে কিংবা কাপড় রং করতে এর ব্যবহার দেখা যায়। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মাটি, পানি বা বায়ু মাধ্যমে ছড়াতে পারে ক্রোমিয়াম-৬।
বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো- ক্রোমিয়াম-৬ মানুষের জন্য ক্ষতিকর হলেও ক্রোমিয়াম-৩ সুস্বাস্থ্য গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ক্রোমিয়াম-৬ এর কুফল
ক্রোমিয়াম-৬ মূলত দূষিত বায়ু থেকে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সৃষ্টি করে। এই পদার্থটি ফুসফুস, নাসারন্ধ্র এবং সাইনাসে ক্যান্সার তো সৃষ্টি করেই, পাশাপাশি কিডনির ক্ষতিসাধন, প্রজননতন্ত্রে জটিলতা সৃষ্টি এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশেও বাধাপ্রদান করে। নবজাতক, শিশু, বৃদ্ধ এবং যাদের কিডনি ঠিকমতো কাজ করে না কিংবা যারা নিয়মিত অ্যান্টাসিড খায় তারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হয়। মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়াম-৬ এর কারণে হাঁপানি, কাশি, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিসের মতো রোগে আক্রান্ত হতে হয় তাদের।
জিনগত ত্রুটি এবং গর্ভপাতের পেছনেও এই বিপজ্জনক পদার্থটির প্রভাব লক্ষ্যণীয়। দেহে ক্রোমিয়াম ক্রমাগত বাড়তে থাকলে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, বিশেষ করে কিডনি এবং লিভার নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এদের স্বাভাবিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত ঘটে। মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বিকাশে যেমন বাধা দেয় তেমনি এর সাধারণ কার্যক্রমেও ব্যাঘাত ঘটে। চোখের সাথে ক্রোমিয়াম ৬ সরাসরি বিক্রিয়া করে ক্ষতি সাধন করতে পারে। যেসব ধোঁয়া, ধুলো, অ্যারোসল বা তরল পদার্থে এই ক্রোমিয়াম থাকে সেগুলো যেন চোখের সাথে সরাসরি সংযোগে না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দীর্ঘ সময় ধরে ত্বকের সাথে ক্রোমিয়াম কোনো উপায়ে লাগলে ত্বকে জটিলতা দেখা যায়। যারা এমন কোনো কারখানায় কাজ করে যেখানে ক্রোমিয়ামের পরিমাণ অধিক তাদের মধ্যে মূলত এ ধরনের সমস্যা দেখা যায়।
পরবর্তীতে তাদের ত্বক এতটাই দুর্বল হয়ে যায় যে, খুব অল্প পরিমাণে ক্রোমিয়াম ত্বকের সংস্পর্শে আসলেও এর ফল হয় অত্যন্ত ভয়াবহ। ডার্মাটাইটিস এবং স্কিন আলসারও সৃষ্টি করতে পারে এই ক্রোমিয়াম-৬।
বাংলাদেশে ক্রোমিয়াম-৬
আমাদের প্রতিটি কাজের প্রভাব আমাদের উপরই এসে পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। আর এমনটাই দেখা যাচ্ছে ক্রোমিয়াম ৬ নামক পদার্থটির ক্ষেত্রে। শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে এই ঝুঁকিপূর্ণ পদার্থটি পানিতে এবং মাটিতে মিশে যাচ্ছে, যা উদ্ভিদ ও প্রাণির দেহেই নয়, বরং মানুষের দেহেও প্রবেশ করছে। একটি গবেষণায় দেখা যায় যে মাছ, মাংস ও হাঁস-মুরগিকে যেসব খাবার দেওয়া হয় সেগুলোতে অতিরিক্ত পরিমাণে এই পদার্থটি রয়েছে। অনেকে মনে করেন, ভালোভাবে সিদ্ধ করে রান্না করলে হয়তো সব ধরনের রোগ-জীবাণুই মরে যায়। বেশি তাপে রান্না করলেই সব সমস্যা শেষ। যুক্তিটা নিতান্তই ভুল নয়। তবে বাস্তবতা সবসময় একরকম হয় না। ক্রোমিয়াম-৬ পদার্থটির তাপ সহনক্ষমতা ২,৯০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কিন্তু সাধারণত রান্না করা হয় ১০০-১৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে। অর্থাৎ এত সিদ্ধ করেও মূল জীবননাশক পদার্থটিই দূরীভূত করা যায় না। বাংলাদেশে সম্প্রতি একটি গবেষণা করা হয় যেখানে দেখা যায় যে, প্রতি ১,০০০ গ্রাম মুরগির মাংসে রয়েছে ৩৫০ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম ৬।
তাছাড়া কলিজায় ৬১২ মাইক্রোগ্রাম, রক্তে ৭৯০ মাইক্রোগ্রাম, হাড়ে ২,০০০ মাইক্রোগ্রাম এবং মগজে ৪,৫২০ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম ৬ থাকে। ‘মাইক্রোগ্রাম’ শুনলে হয়ত অনেকের মনে হতে পারে যে এত কম পরিমাণে ব্যবহৃত কোনো পদার্থের প্রভাব তো বেশি হবে না। কিন্তু আমাদের দেহের জন্য এই পরিমাণ ক্রোমিয়াম বিপজ্জনক।
একজন মানুষ সাধারণত ৩৫ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম ৬ গ্রহণ করতে পারে। এখন মনে করুন, কেউ ২৫০ গ্রামের এক টুকরা মাংস খেলো। তাহলে তার শরীরে ৮৭.৫ মাইক্রোগ্রাম ক্রোমিয়াম প্রবেশ করবে। অর্থাৎ মানুষের শরীর যতটুকু ক্রোমিয়াম সহ্য করতে পারে তার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি পরিমাণ ক্রোমিয়াম দেহে প্রবেশ করবে। পরবর্তীতে তা পরিপাকও হয় না কিংবা দেহ থেকে সহজে বেরও হতে পারে না। ফলে তা দেহেই থেকে যায় এবং বিভিন্ন রোগবালাইয়েরও সৃষ্টি করে। এজন্য বিশেষজ্ঞরা যেসব ফার্মে মুরগির জন্য অতিরিক্ত ক্রোমিয়ামযুক্ত খাদ্য ব্যবহার করে সেসব ফার্ম থেকে মুরগি ক্রয়ে বিরত থাকতে বলে। তবে এই বিষয়ে সরকারিভাবে গৃহীত পদক্ষেপ জরুরি। কেননা, সাধারণ জনগণের পক্ষে কোনো ফার্মের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিবেচনা করা সম্ভবপর নয়।
এখন আপনি হয়তো মনে করলেন এত ঝামেলা পোহাবেন না। তাই মুরগিসহ সব ধরণের গবাদিপশু খাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখবেন৷ মাছ এবং শাকসবজি দিয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু এখানেও বিশেষ কোনো সুবিধা আপনি করতে পারবেন না। কারণ এসব খাবারেও রয়েছে ক্রোমিয়াম। এমনকি পানি এবং বায়ুতেও থাকতে পারে এই বিপজ্জনক পদার্থ। ট্যানারি এবং অন্যান্য শিল্প কারখানার বর্জ্য খুব সহজেই বিভিন্ন জলাশয়ে গিয়ে মিশে যায়। আর এই বর্জ্যে ক্রোমিয়াম-৬ থাকার সম্ভাবনাও বেশি। এখন এসব জলাশয়ে মাছ থাকলে সেসব মাছে এই জীবনঘাতি পদার্থ প্রবেশ করবেই। আর সেই মাছ খেলে আমাদের দেহেও এই পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে, ফসলের ক্ষেতে ক্রোমিয়ামযুক্ত পানির ব্যবহার শাকসবজিতেও ক্রোমিয়ামের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অর্থাৎ এসব সবজি সেবনেও রয়েছে বিপদ। সবচেয়ে বড় সংকট হলো পান করার পানিতেও মিশে আছে এই ক্রোমিয়াম। আর এটি সীসাসহ অন্যান্য পদার্থের মতো ভালো করে ছাঁকা হলেই দূরীভূত হয় না। এমনকি শিল্প কারখানা থেকে নির্গত ধোঁয়ার মাধ্যমে দেহে ঢুকতে পারে এই ক্রোমিয়াম-৬। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মোতাবেক প্রতি লিটার পানিতে ক্রোমিয়ামের সর্বোচ্চ মাত্রা হলো ০.০৫ মিলিগ্রাম।
কিন্তু আমাদের দেশে পান করার পানিতে এই মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বেশি। আর যেসব অঞ্চলে কারখানার সংখ্যা বেশি সেসব অঞ্চলের পানি পান করার অযোগ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমনকি উন্নত দেশে বেশি শিল্প প্রতিষ্ঠানের দরুন সেখানেও এই ক্রোমিয়ামের কুফল পরিলক্ষিত হচ্ছে।
শিল্পায়নের যুগে ক্রোমিয়াম-৬ এর উৎপাদন কোনোভাবেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে এর পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। সরকারের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন কোনো কারখানা থেকে বর্জ্য যেন পরিশোধিত না করেই মাটি, পানি বা বায়ু মাধ্যমে না ছড়ানো হয়। অন্যদিকে, সাধারণ জনগণকেও সর্বদা সতর্ক থাকতে হবে যেন পানি খাওয়ার আগে তা ফুটিয়ে ভালো মানের কোনো ফিল্টারে ছেঁকে নেওয়া হয়। মাছ বা মাংস যতটা সম্ভব ভালো জায়গা থেকে কিনতে হবে এবং বাইরের খাবার এবং পানি থেকে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কারণ কিছু অসাধু ব্যবসায়ী প্রায়ই পানি এবং খাবারে অন্যান্য উপাদান ব্যবহারে সতর্ক থাকে না।