প্রায় তিন মাস সময় ধরে পুরো পৃথিবীকে কোণঠাসা করে ফেলা এক ভাইরাস কোভিড-১৯। চীন থেকে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসের আক্রমণে প্রায় ৯,০০০ মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
এ ধরনের ভাইরাসের আক্রমণ ঠেকাতে অন্যতম জরুরী পদক্ষেপ হলো ভাইরাসের ভ্যাক্সিন বা টিকা প্রস্তুতকরণ। একটি টিকা প্রস্তুত করা বেশ সময়সাপেক্ষ, কখনো কখনো লেগে যেতে পারে বছরের পর বছর।
কোভিড-১৯ ভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ইতোমধ্যে তাদের প্রচেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। এখনও তারা তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু যেসব জায়গায় এই ভাইরাসের টীকা, ওষুধ তৈরির কাজ চলছে, সেসব কাজের তথ্য এক লেখার মধ্যে নিয়ে আসা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ লেখাটিতে এ মুহূর্তে কোন দেশের কোন প্রতিষ্ঠান কী কী কাজ করছে এবং তাদের ফলাফল কী– সেসব সম্পর্কে আলোচনা করা হবে।
গত সোমবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান মোডারনা একজন নারীর ওপর এম-আরএনএ ১২৭৩ টিকা দিয়ে প্রথম ট্রায়াল শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ হেলথ। তারা ৪৫ জনকে নিয়ে এই ট্রায়াল সম্পন্ন করবে, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৫৫ এর মধ্যে এবং পরবর্তীকালে এই টিকার সেফটি চেক তথা নিরাপত্তা-প্রত্যবেক্ষণ করা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি ওষুধ কোম্পানি রিজেনারন সোমবার থেকে কেভজেরো নামক একটি ওষুধ টেস্ট করে দেখছে। যেসব রোগী ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত এবং যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক- তাদের ওপর তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। এরকম ৪০০ জন রোগীর ওপর প্রয়োগ করে বোঝার চেষ্টা করা হবে, রোগীর জ্বরের সাথে এ ওষুধের সম্পর্ক আছে কি না।
এরকম মানুষের ওপর ভ্যাক্সিন প্রয়োগ একটি সফল প্রচেষ্টা বলে মনে হলেও এটাকে মাত্র শুরু বলতে হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অভ হেলথ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের শুরু করা ট্রায়ালের সবকিছু যদি ঠিকঠাক কাজ করে, তাহলে এই ভ্যাক্সিন বাজারে আসতে এবং তা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে এখন থেকে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৮ মাস লাগবে।
জার্মানির বায়োনটেক এবং চীনের ফোসান নামক দুটো ওষুধ কোম্পানি এম-আরএনএ ভ্যাক্সিনের ক্যান্ডিডেট বিএনটি ১৬২ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। তাদের এই কাজ শুরু হচ্ছে চীনে। ফোসান ফার্মা এই কাজে বায়োনটেক-কে ১৩৫ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে। এই প্রজেক্টে যুক্তরাষ্ট্রের ফিজার নামক আরেকটি কোম্পানি সাহায্য করছে।
চীন ইতোমধ্যে তাদের দেশের বিজ্ঞানী এবং গবেষকদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করার অনুমতি দিয়েছে। চীন থেকে ট্রায়ালের জন্য কাজ করছে চায়না অ্যাকাডেমি অভ মিলিটারি মেডিকেল সায়েন্স। তাদের সাথে কাজ করবে হংকং-এর শীর্ষস্থানীয় বায়োটেক ফার্ম কেনসিনো বায়োলজিক্স। গত মঙ্গলবার চীন থেকে এই তথ্য দেয়া হয়। মার্চ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মোট ১০৮ জনকে নিয়ে এই ট্রায়াল টেস্ট করা হবে বলে জানিয়েছে চীন।
যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনে এম-আরএনএ ভিত্তিক যে ভ্যাক্সিন তৈরি করা হচ্ছে, তা কিন্তু ভাইরাস দিয়ে করা হচ্ছে না, যা সাধারণত টিকা তৈরির সময় করা হয়ে থাকে। ভ্যাক্সিনটি তৈরির জন্য আরএনএ-কে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এম-আরএনএ’র মূল কাজ হচ্ছে তথ্য স্থানান্তর করা। ডিএনএ-তে প্রোটিন তৈরির যে তথ্য থাকে, তা জীবিত কোষে (প্রধানত রাইবোজমে) পৌঁছে দেয়াই এম–আরএনএ’র প্রধান কাজ।
ভ্যাক্সিন তৈরির ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে তা হলো, এম-আরএনএ থেকে তৈরি ওষুধ রোগীর শরীরের কোষকে নির্দেশ দেবে, যেন সে কোভিড-১৯ এর সাথে লড়াই করতে সক্ষম- এমন প্রোটিন তৈরি করে।
অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠান এ ভাইরাস মোকাবিলায় গবেষণা শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া এগিয়ে আছে। মেলবোর্নভিত্তিক একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কীভাবে একজন মানুষের শরীর ইমিউন সিস্টেম ভাইরাসের বিরুদ্ধে কাজ করে- সেটির ম্যাপিং করতে পেরেছে।
এটি আবার নেচার মেডিসিন জার্নালে গবেষণা প্রবন্ধ হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে, যাকে গবেষকদের জন্য বড় সাফল্যই মানা হচ্ছে। কেননা, এর ফলাফলের উপর নির্ভর করে ভ্যাক্সিন তৈরির কাজে দ্রুততা আসতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
এছাড়া কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা এইডস এবং ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহৃত দুটো ওষুধ কোভিড-১৯ চিকিৎসায় প্রয়োগ করার চেষ্টা করছেন। ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ দুটো ওষুধ একসাথে প্রয়োগ করলে ভাইরাস নির্মূল করা সম্ভব। এখন তারা অস্ট্রেলিয়ার ৫০টি হাসপাতালে ওষুধটির প্রায়োগিক টেস্ট সম্পন্ন করার ধাপে আছে।
এই কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাজ্যের ইম্পেরিয়াল কলেজ অভ লন্ডন। মোট চারটি ভ্যাক্সিন তৈরি করা হবে। এদের মধ্যে যে ভ্যাক্সিন সবচেয়ে ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করবে, সেটিই বিতরণের জন্য ব্যবহার করা হবে।
ফ্রান্সের একটি মেডিকেল ল্যাবরেটরি সানফি ২৪ জন করোনা রোগীর ওপর প্ল্যাকুইনিল নামক একটি ওষুধ প্রয়োগ করে সফলতা লাভ করেছে, যা ম্যালেরিয়া চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়। চীনেও এ ওষুধের সফল প্রয়োগ করা সম্ভব হয়েছে। ফ্রান্সে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে ক্লোরকুইন ফসফেট এবং হাইড্রক্সি ক্লোরকুইন ব্যবহার করা হচ্ছে।
সবচেয়ে আশাব্যঞ্জক খবর পাওয়া গেছে জাপান থেকে। জাপানের ফুজিফিল্ম-এর একটি ওষুধ কোম্পানি তোয়ামা কেমিক্যাল ২০১৪ সালে ফ্লু মোকাবেলা করার জন্য এভিগান নামক একটি ওষুধ তৈরি করে। সেই ওষুধ চীনের উহান এবং শেনজেনে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীদেরকে চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়।
চীন থেকে জানানো হয়েছে, ওষুধটি প্রয়োগের পর অভূতপূর্ব সাফল্য পাওয়া গেছে! প্রায় ৩৪০ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা করার পর জানা যায় যে, এতে রোগীর ফুসফুসের অবস্থা ৯১% পর্যন্ত উন্নতি হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে, এ ওষুধ প্রয়োগের আগে গড়ে ১১ দিন পর্যন্ত সময় লাগত রোগীর ভালো হতে। কিন্তু এখন সেটি নেমে গড়ে ৪ দিন হয়ে গেছে।
যদিও চীন দাবি করছে, রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠছে; কিন্তু জাপানের তোয়ামা কেমিক্যাল থেকে এ প্রসঙ্গে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কোভিড-১৯ আক্রান্ত অতি-সংকটাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে ওষুধটি ভালো ফল দিচ্ছে না। যেসব রোগীর শারীরিক অবস্থা মাঝামাঝি মাত্রার, কেবল তাদের ক্ষেত্রেই ভালোভাবে কাজ করছে ওষুধটি।
কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী যেভাবে বেড়েই চলেছে, তাতে খুব দ্রুত এ ভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি করাটাই মুখ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের বড় বড় এবং উন্নত ল্যাবগুলো ইতোমধ্যে কাজ তো বটেই, ট্রায়াল পর্যন্ত শুরু করে দিয়েছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে দ্রুত কাজ করার কিছু বিপদ আছে। একটি ভ্যাক্সিন তৈরি করার পর সেটা শরীরের জন্য কতটুকু নিরাপদ- সেটি পরখ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই বিষয়টি বিবেচনা না করে দ্রুত ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করা হিতে বিপরীত ঘটনা ঘটাতে পারে।
এখন যে কাজ বিভিন্ন দেশের ঔষধ কোম্পানি এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো করছে, সেগুলো হচ্ছে প্রথম ধাপ। এখানে খুব সূক্ষ্মভাবে দেখতে হবে, তাদের তৈরি ভ্যাক্সিন মানব শরীরের জন্য কতটুকু নিরাপদ। এরপর আসবে দু’নম্বর ধাপ, যেখানে দেখা হবে, ভ্যাক্সিনটি আসলেই দক্ষতার সাথে কাজ করছে কি না। প্রথম ধাপ থেকে দ্বিতীয় ধাপ সম্পন্ন করতে বেশি সময়ের প্রয়োজন।
ভ্যাক্সিন তৈরি হবার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা, নিজেরা নিরাপদে থাকা, নিয়ম মেনে চলা, বাইরে খুব বেশি চলাফেরা না করা খুবই জরুরী পদক্ষেপ। এটা যেমন নিজের জন্য জরুরী, ঠিক তেমনি জরুরি আশেপাশের মানুষদের জন্য।