Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সাইকোপ্যাথরা কি অন্যের কষ্ট অনুভব করে?

সাইকো, সাইকোপ্যাথ ইত্যাদি শব্দগুলো আমরা খুব সহজে ব্যবহার করি। যেকোনো ধরনের খুনিকে আমরা সাইকোপ্যাথ বলে ফেললেও তাদের রয়েছে একটি নির্দিষ্ট সংজ্ঞা। সাইকোপ্যাথরা উন্মাদ না। বরং তারা কিছু ক্ষেত্রে অনেক বুদ্ধিমান, স্বাভাবিক ও খুবই আকর্ষণীয় আচরণ করে। সাইকোপ্যাথদের সাইকোটিক বা সোসিওপ্যাথিক বলা হলেও তারা মোটেও তা নয়। সাইকোটিকদের মস্তিষ্কে সত্যিকার অর্থেই কোনো রোগ বা অস্বাভাবিকতা থাকে এবং সোসিওপ্যাথরাও খুবই অসামাজিক আচরণ করে, নিভৃতে থাকতে চায়।

প্রচলিত ধারণা- সাইকোপ্যাথদের আবেগ নেই;  Image Source: quora.com

অন্যদিকে, সাইকোপ্যাথরা সামাজিক হয় এবং অনেকে নিজেদের কর্মক্ষেত্রেও উজ্জ্বল। শুরু থেকেই বিশ্বাস করা হয়, সাইকোপ্যাথরা খুব ঠাণ্ডা মাথার খুনি। তারা তাদের কাজের জন্য কোনো ধরনের অনুতাপ অনুভব করেন না। সাইকোটিকরা যেখানে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, সেখানে ধারণা করা হয় সাইকোপ্যাথরা জেনে-বুঝেই অপকর্ম করে থাকেন। তারা অন্যের জন্য কোনো ধরনের সহানুভূতি অনুভব করেন না। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় এই ধারণা অনেকটাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে।

আমরা কেন অন্যের কষ্ট বুঝতে পারি?

মানুষ সবসময়ই অস্বাভাবিক ঘটনার পেছনে ব্যাখ্যা খোঁজার চেষ্টা করেছে। সাইকোপ্যাথরা এমন সব অকথ্য অত্যাচার করে যা সাধারণ মানুষ যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারে না। তাই তারা ভেবে নেয়, নিশ্চয়ই সাইকোপ্যাথরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি আলাদা। সেজন্যই বলা হয়, “সাইকোপ্যাথরা কিছুই অনুভব করে না। তাদের মস্তিষ্কের সেই ক্ষমতাই নেই”। এভাবেই তাদের যান্ত্রিক হওয়ার অভিযোগ দিয়ে আমরা খুব সহজে ঘটনার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাই।

কুখ্যাত সাইকোপ্যাথ অ্যাডমন্ড কেম্পার যখন তার দাদিকে মাথায় গুলি করার পর বলে বসেন, “আমি দেখতে চেয়ছিলাম দাদিকে গুলি করতে কেমন লাগে”, বা জেফেরি ডামার যখন বলেন, তার শিকারদের শরীর চিড়ে তাদের ভিতরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দেখলে তার ‘যৌন আবেদন’ তৈরি হয়, তখন সাধারণ মানুষ কী ভাবতে পারে?

যে কাজগুলো আমরা স্বপ্নেও করার কথা ভাবতে পারি না, সাইকোপ্যাথরা সেগুলো অনড় হাতে করে বলেই তাদের নিয়ে এ ধরনের একটি গুজব চলে এসেছে। আমরা কেন বা কীভাবে সাইকোপ্যাথদের থেকে আলাদা?

মিরর নিউরন ইফেক্ট

নেদারল্যান্ডস ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্স সাইকোপ্যাথদের মানসিক অবস্থা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষা করে আসছে। তারাই একটি গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছে কী করে মানুষ সহানুভূতি অনুভব করে। সহানুভূতি বলতে অন্যের অনুভূতিকে অনুভব করা বোঝায়। প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা মতে, আমরা যখন অন্যের দুঃখে দুঃখী এবং অন্যের সুখে সুখী হই তখন আমরা তাদের জায়গায় নিজেদের চিন্তা করি। সিঙ্গুলেট গাইরাস আমাদের মস্তিষ্কের একটি পেঁচানো অংশ, যা করপাস কেলোসামকে ঢেকে রাখে এবং এই অংশটিই আমাদের অনুভূতির উদ্রেক করে। যখন আমরা কাউকে কষ্ট পেতে দেখি, তখন আমাদের মস্তিষ্কের এই অংশটি কার্যকর হয়ে উঠে। তখন মস্তিষ্ক ভাবে যেন কষ্টটি তাকেই দেয়া হচ্ছে। আয়নার মতো অন্যের সুখ-দুঃখ আমাদের মধ্যে প্রতিফলিত হয় দেখেই এর নাম মিরর নিউরন ইফেক্ট। এটিই আমাদের সহানুভূতির কারণ।

সাইকোপ্যাথ অ্যাডমান্ড কেম্পার; Image Source: lavanguardia.com

তারা একইভাবে সাইকোপ্যাথদের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করছে। ২০১৩ সালে Reduced Spontaneous but Relatively Normal Deliberate Vicarious Representations in Psychopathy শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র তারা প্রকাশ করে। তাদের এই গবেষণা সাইকোপ্যাথদের সম্পর্কে থাকা ধারণাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়।

তাদেরও অনুভূতি রয়েছে

নেদারল্যান্ডস ইন্সটিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের এই গবেষণায় স্নায়ুতত্ত্ববিদ ক্রিস্টিয়ান কেইসার ও তার দল জেলে বন্দী ১৮ জন সাইকোপ্যাথের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা করেন। তাদের প্রত্যেককে কয়েকটি ভিডিও দেখানো হয়, যেখানে শুধু দুজন ব্যক্তির হাত দেখা যাচ্ছে। ঐ দুই হাত কখনো বন্ধুত্বসুলভ করমর্দন দেখায়, তো কখনো দেখা যায় একটি হাত আরেকটি হাতকে ব্যথা দিচ্ছে। এমনইভাবে তাদেরকে আরও কিছু ভিডিও দেখানো হয় এবং তাদের মস্তিষ্কের অবস্থা নিরীক্ষা করা হয়। দেখা যায়, একজন সাধারণ মানুষ ভিডিওর যেসব অংশ দেখে আবেগাপ্লুত হয়, সেই একই জিনিস একজন সাইকোপ্যাথের মাথায় কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করে না।

গবেষণাটি ভিন্ন মোড় নেয় তখন যখন গবেষকরা তাদের নির্দেশ দেন ভিডিওতে দেখানো চরিত্রের সাথে সহানুভূতি অনুভব করতে। এরপর আশ্চর্যজনকভাবে সেই একই দৃশ্যে সাইকোপ্যাথদের মস্তিষ্কও আবেগাপ্লুত হয়। এটি প্রমাণ করে যে, সাইকোপ্যাথরা মানুষের কষ্ট অনুভব করতে পারে, কিন্তু সচরাচর নিজেদের ইচ্ছায় করে না। তাদের হাত কাঁপে না, কারণ তারা কাঁপাতে চান না।

যদি মস্তিষ্কে সমস্যা না থাকে, তাহলে সমস্যাটি কোথায়?

এর এককথায় জবাব দেয়া বেশ কঠিন। স্বয়ং বিশ্ববিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড বলেন, “একজন পরিণত বয়সের সাইকোপ্যাথ বা খুনির ছোটবেলার ইতিহাস দেখে আন্দাজ করা যেতে পারে তার এমন হওয়ার কারণ কী। কিন্তু একজন ছোট বাচ্চাকে দেখে বোঝার উপায় নেই সে বড় হয়ে সাইকোপ্যাথ হবে কি না”।

সাইকোপ্যাথদের এমন হয়ে ওঠার কারণ কী হতে পারে তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। যেমন-

১) আদিমতা

ইতালীয় অপরাধবিজ্ঞানী সিজার লম্ব্রোসো ডারউইন তত্ত্বের প্রভাবে বলেন, মানুষ পশু থেকে বিবর্তিত হয়েছে বটে, কিন্তু আজও কিছু মানুষ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হতে পারেনি। তাদের মধ্যে আজও পশুত্ব আছে, যা তারা অন্যকে হত্যার মাধ্যমে প্রকাশ করে। তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে, সাইকপ্যাথদের কিছু চিহ্নিত শারীরিক বৈশিষ্ট্য আছে- বড় বড় চোখ, খাড়া কান, কুঁচকানো, চ্যাপ্টা কপাল ইত্যাদি।

লম্ব্রোসের মতে সাইকোপ্যাথদের শারীরিক গঠন;  Image Source: callingbullshit.org

২) মস্তিষ্কে আঘাত

লম্ব্রোসোর ধারণার তুলনায় আরও বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা হলো, সাইকোপ্যাথরা তাদের জীবনের কোনো একসময় মারাত্মক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছিল, যা তাদের মস্তিষ্কে আঘাত করে। দুর্ঘটনা ছাড়াও ছোটবেলার কোনো বাজে স্মৃতিও তাদের মস্তিষ্কের গঠনই বদলে দিতে পারে, যার ফলে তাদের আবেগ অনুভব করার অংশটি নষ্ট হয়ে যায়।

৩) বিরূপ শৈশব

বাবা-মায়ের প্রতি ক্ষোভ, অসহনশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা সাইকোপ্যাথির অন্যতম কারণ। পৃথিবীর মোটামুটি সকল সাইকপ্যাথের একটি ব্যাপারে মিল আছে- তাদের সবার শৈশব ছিল বিকৃত। ভগ্ন পরিবারের সাথে যুক্ত ছিল মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার। যেমন পূর্বোল্লিখিত সাইকোপ্যাথ অ্যাডমান্ড কেম্পার তার ঘুমন্ত মাকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিল, কারণ তার মা তার শারীরিক গঠন নিয়ে তাকে ফোঁড়ন কাটতেন, সবসময় তাকে কড়া শাসনে রাখতেন।

আবার, আমরা সবাই জানি, আমেরিকার কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার আলবার্ট ফিশের কথা, যে শিশুদের ধর্ষণ এবং হত্যার পরে তাদের মাংস খেত। কিন্তু খুব কম মানুষই জানি কী করে ছোটবেলায় তাকে এতিমখানার তত্ত্বাবধায়ক উলঙ্গ করে বেত দিয়ে সবার সামনে মারতেন। উইলিয়াম বোনিন নামের একজন সাইকোপ্যাথকে স্কুলে নিয়মিত অন্য ছেলেরা ধর্ষণ করতো।

এসব কারণে বোঝা যায়, সাইকোপ্যাথরা সাইকোপ্যাথ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে তারা ছোটবেলায় সহানুভূতি অনুভব শেখেইনি। তারা এমন পরিবেশে বড় হয়েছে যা তাদের মধ্যে এই গুণটি গড়ে ওঠার সময় দেয়নি।

তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন সিরিয়াল কিলার জেফরি ডামার ও টেড বান্ডি। টেড বান্ডি তার নানা-নানির সাথে থাকতেন এবং তারা তাকে তাদের নিজেদের সন্তানের মতো বড় করেছেন। কিন্তু দেখা যায়, টেড বান্ডির পিতৃপরিচয় ছিল না। অন্যদিকে ডামারের পরিবার ভালো হলেও ধারণা করা হয় ছোটবেলা তিনি প্রতিবেশী বা অন্যদের দ্বারাও অত্যাচারিত হয়ে থাকবেন।

তাদের রয়েছে সহানুভূতির সুইচ

সাইকোপ্যাথদের অপরাধগুলো একদিকে সরিয়ে রেখে তাদের জীবনের দিকে তাকালে বোঝা যাবে, তারা শুধু আবেগ অনুভবই করে না, বরং তারা অতি আবেগে ভোগে। গবেষকরা যাকে বলেছেন হাইপারইমোশনাল। একটি বাচ্চা কতটুকু কষ্ট অনুভব করলে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তার মাকে হত্যা করতে পারে?

তবে এভাবে সাইকোপ্যাথদের অপরাধকে ন্যায্য দাবি করার কোনো উপায় নেই। সামাজিক দুর্ব্যবহার ও মানসিক সমস্যা দুই-ই একজনকে সাইকোপ্যাথে পরিণত করতে পারে। ফ্রয়েডকে স্মরণ করে আবার বলা যায়, খারাপ পরিবেশে বেড়ে ওঠা সকল বাচ্চাই সাইকোপ্যাথ হয় না, আবার সব সচ্ছল পরিবারের বাচ্চারা ভালো মানুষও হয় না।

তাদের জন্য কী শাস্তি হতে পারে?

যেহেতু সাইকোপ্যাথরা নিজেদের ইচ্ছায় কারো জন্য দুঃখ অনুভব করে না, তাই প্রচলিত নিয়মে তাদের শাস্তি দেয়াটা যৌক্তিক নয়। কেননা এই শাস্তির কোনো অর্থ নেই তাদের কাছে। বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন গবেষক ম্যাল স্লেটার ও ম্যাভি সানেজ সাইকোপ্যাথদের মধ্যে সহানুভূতি তৈরি চেষ্টা করছেন। তাদের মতে, “যদি ব্রেনের ঐসব অংশ সচল করা যায় যেগুলো আমাদের আবেগের সাথে জড়িত, তাহলে সাইকোপ্যাথদের মানসিকতাও বদলানো যাবে”

সাইকোপ্যাথদের ব্রেনে পরিবর্তন আনা যাবে;  Image Source: scienceleadership.org

সে লক্ষ্যেই তারা একটি সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে সাইকোপ্যাথদের বলা হয় তাদের ভিক্টিমদের স্থানে যাতে তারা অভিনয় করে। অর্থাৎ, অভিনয়ের মাধ্যমে বাস্তব পরিবেশে তাদেরকে বোঝানো যে ভিক্টিম হতে আসলে কেমন লাগে।

সাইকোপ্যাথী কোনো বিশেষ মানসিক ব্যাধি নয় যা নিরাময় করা যাবে না। এটি বাচ্চার সামাজিকীকরণের উপরই বেশি নির্ভর করে। সাইকোপ্যাথদের সম্পর্কে লব্ধ এই নতুন জ্ঞান মানুষকে আরও সচেতন করবে। সাইকোপ্যাথদের শেষ ঠিকানা সবসময় ফাঁসিকাষ্ঠ হবে না, যদি তাদের যথাযথ মানসিক পরিবর্তন আনা যায়।

Related Articles