আকাশ আর মেঘের সাথে আমাদের পরিচয় যত দিনের, তাকে নিয়ে আমাদের কৌতুহল হয়তো তার থেকেও পুরোনো। আমাদের কাছে যেসব ডকুমেন্ট আছে, তাতে ধারণা করা হয় ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মানুষেরাও মেঘ নিয়ে ভাবতেন। আবহাওয়া আর আকাশের মিতালী, আমাদের প্রাচীন অপ্রাতিষ্ঠানিক পূর্বপুরুষেরাও উপলব্ধি করতে চেষ্টা করেছেন, মেঘের ভাষা বুঝতে চেষ্টা করেছেন। বর্তমান সময়ে বিজ্ঞান সে যাত্রাকে সহজ করে তুলেছে বহুগুণে। কিন্তু তারপরও কিছু বিষয় থেকে যায় যা ব্যাখ্যাতীত, কিংবা ব্যাখ্যা করার জন্য নতুন কোনো তত্ত্ব দাঁড় করানোর প্রয়োজন হয়। তেমনই কিছু বিষয় নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা।
ছোটবেলায় মেঘের মাঝে বিভিন্ন আকৃতি খুঁজে নেওয়াটা আমাদের জন্য বেশ আমুদে ছিলো। কেন হয় বা কিভাবে হয়, তা জানবার প্রয়োজন আমাদের তখন পড়েনি। আনমনে আকাশ দেখতে দেখতে আমাদের চোখে পড়তো বিশাল কোনো হাতি, পাখি, পরিচিত কোনো মানচিত্র। কিংবা পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ আবিষ্কার করে ফেলতাম আমরা কেউ কেউ। অথবা দেখা মিলতো দৌড়ানোর ভঙ্গিতে স্থির থাকা মানুষ কিংবা কোনো ঘোড়ার। ব্যাপারগুলো খানিকটা কাকতালীয়, খানিকটা প্রকৃতির খেয়াল। কিন্তু কিছু ফেনমেনন আমাদের সামনে এসেছে, যার ব্যাখ্যা বিজ্ঞান করতে পারে নি- কেবল অনুকল্প দাঁড় করাতে পেরেছে, আবার নিতান্ত কাকতাল বলতে ইচ্ছে হয় না।
মেঘ মানব
সময়টা জানুয়ারী মাসের প্রথম পক্ষ, ২০১৬ সাল। রোজকার ফ্লাইট শিডিউল অনুযায়ী অস্ট্রিয়া থেকে আয়ারল্যান্ডের শহর কর্কের উদ্দেশ্যে উড়ে যাচ্ছে একটি বিমান। প্রায় ৩০ হাজার ফুট উঁচুতে উড়ছিলো বিমানটি। ধূসর স্তর মেঘ বা স্ট্রাটাসে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। কিন্তু তার মাঝে কী যেন নজর কাড়ে বিমানযাত্রীদের।
সহযাত্রীর ইশারায় বাইরে নজর দেন নিক ও’ডনোগিউ। প্রথমে অবশ্য টের পাননি। কিন্তু পরে যখন বুঝতে পারলেন ভ্রমে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর ভ্রমের রেশ কাটিয়ে বিমানটি বেশি দূর এগিয়ে যাওয়ার আগেই তুলে নিলেন কিছু ছবি। আর এ ছবিগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হলো আকাশ কিংবা মেঘ বিজ্ঞানীদের, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, প্যারালাল ইউনিভার্স আদৌ বিরাজ করে কিনা, সে প্রশ্নও তুললেন কেউ কেউ! কিন্তু কী এমন দেখেছিলেন তারা? এর উত্তর খুঁজতে আগে নিচের ছবিটি দেখুন।
মেঘের বুকে ছায়া সমেত একটি মানুষের আকৃতি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ছবিটিতে। প্রকৃতির হেয়ালিতে আপনা আপনি তৈরী হয়েছিলো মেঘের এমন আকার? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এমন কোনো তথ্য, যা ব্যাখ্যা করার সাধ্য এখনও মানবজাতির হয়নি?
ছবিটিকে প্রকৃতির নিতান্ত খেয়াল বলতে কিছুটা ইতস্ততা বোধ করি, কারণ ছবিটিকে খানিকটা বড় করলে একে একে ফুটে ওঠে দুটি চোখ, মুখ! মেঘ বিজ্ঞানীদের কাছে আজও রহস্য হয়ে আছেন এই মেঘমানব। ছবিটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয়। অনেকেরই তাকে দেখে ‘দ্য আয়রন জায়ান্ট’ কার্টুনের রোবটটির কথা মনে পড়ে যায়!
মেঘের বুকে শহর
আচ্ছা, ধরুন মেঘের দেশে হাঁটতে থাকা মানুষটি হয়তো প্রকৃতির খেয়াল। কিন্তু মেঘের বুকে শহর! প্রকান্ড সব দালান নিয়ে চীনের শহর ফুশাং-এ হঠাৎ দেখা দিয়েছিলো এক শহর। মেঘের আড়ে ভেসে ওঠা বিশাল সেই শহরকে দেখা গিয়েছিলো মোটে দশ বারো মিনিটের জন্য। স্থানীয়দের মুঠোফোনে তা বন্দী হয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভার্চয়াল দুনিয়ায়।
বিজ্ঞানী মহলে শোরগোল পড়তে সময় লাগেনি। সি এন এন লন্ডন আবহাওয়া অফিসের বরাত দিয়ে বলে, এটা এক ধরণের বিশাল প্রতিবিম্ব। কিংবা একে বৃহৎ মরিচীকা বলা যেতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই মরিচীকার নাম দিয়েছেন ফাটা মরগানা! অর্থাৎ মেঘের বুকে ভেসে ওঠা শহরটি ফুশাং শহরেরই প্রতিবিম্ব! অনেকে আবার বলছেন, প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতায় পৌছে যাওয়া চীন হয়তো নতুন কোনো সিক্রেট হলোগ্রাফিক প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করছে, মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য হয়তো কিছুক্ষণ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছিলো সেদিন।
আকাশে মেঘের বিশাল চাকতি
গত বছর ইহুদীদের নতুন বছর ‘Rosh Hashanah’ উৎসব শুরু হয়েছিলো ২ অক্টোবর। তার ঠিক আগের দিন অর্থাৎ ১ অক্টোবর, ২০১৬ ইহুদী জেরুজালেমবাসী যখন নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, সেদিন আকাশে দেখা গিয়েছিলো অদ্ভুত ধরণের এক মেঘ। মেঘের বিশাল এক চাকতি তৈরি হয়েছিলো জেরুজালেম শহরের আকাশে। সেই বলয়ের মেঘগুলো সিরাস গোত্রীয় হলেও ঠিক কি কারণে তৈরি হয়েছিলো এমন মেঘের বলয় বা এর পেছনে অন্য কোনো ঘটনা লুকিয়ে আছে কিনা বা কিভাবেই বা এরূপ আকার পেয়েছিলো তার সঠিক ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি কেউ। স্থানীয়দের কেউ কেউ বলেছেন, “ঈশ্বর এই বলয় তৈরি করেছেন নতুন বছর উপলক্ষ্যেই! হয়তো তিনি বিশেষ কোনো ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন এর মাধ্যমে।”
ইউএফও নাকি লেন্টিকুলার মেঘ?
ইউএফও নিয়ে আমাদের জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। কিন্তু মেঘ যখন বারে বারে ইউএফও হয়ে আমাদের কাছে ধরা দেয়, তখন তা দেখা মাত্র আমাদের ভ্রম হয়। কিছু পরে হয়তো আমরা বুঝে ফেলি, আসলে তা ছিলো মেঘ! অতি উৎসাহী কেউ কেউ আবার বলে, “আসলে এটা ছিলো ইউএফও, মেঘ সেজে এসেছে!’
আকাশে এই ‘ইউএফও’ আকৃতির মেঘ প্রায়শ দেখা যায়। বিজ্ঞানীরা এদের জন্য আলাদা একটা নাম ঠিক করেছেন। এদের ডাকা হয় ‘লেন্টিকুলার মেঘ’ বলে। লাতিন শব্দ ‘লেন্টিকুলার’ এর অর্থ হলো ‘লেন্স আকৃতি’। বলা বাহুল্য, দ্বি-উত্তল বা অবতলোত্তল লেন্সের সাথে এই মেঘের সাদৃশ্য ব্যাপক। পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই এই মেঘ দেখা যায়। বিশেষ করে পাহাড় চূড়ায় লেন্টিকুলার মেঘ আলাদা আবহ সৃষ্টি করে।
আমাদের আকাশে ‘অ্যাসপেরাটাস’ মেঘ
মেঘ সংক্রান্ত আমাদের প্রথম আলাপে আমরা এক বিশেষ মেঘের কথা বলেছিলাম। নাম আনডুলেটাস অ্যাসপেরাটাস। বলেছিলাম, ক্লাউড অ্যাপ্রিসিয়েশান সোসাইটি তথা ক্যাসের সদস্যদের আনডুলেটাস অ্যাসপেরাটাস মেঘের প্রতি ভালোবাসার সেই গল্প। মেঘ মানচিত্রে সদ্য যোগদান করা মেঘ অ্যাসপেরাটাস এই উপমহাদেশে তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, এমনটাই দাবি করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে কলকাতার প্রভাবশালী দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা।
২০১২ সালের ২৫ শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে আনন্দবাজার পত্রিকা কলকাতার আবহাওয়াবিদদের বরাতে বলে, “এ ধরনের মেঘ ভারতীয় আবহাওয়ায় তৈরি হয় না। সাধারণত ইউরোপের দেশেই দেখা যায়।” কিন্তু আমার ধারণা, এ ধরণের মেঘ এই উপমহাদেশেও সম্ভব। ইউরোপের অ্যাসপেরাটাস মেঘের মতো আমার ধরা এই মেঘটি ততটা প্রকট না হলেও অ্যাসপেরাটাস শ্রেণীভুক্তই হবে বোধ করি।
ছবিটি তোলা হয় গত ২২ শে এপ্রিল, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। সময় ন’টা পয়তাল্লিশ মিনিট।