ক্রিস্টি মিলারের বয়স যখন ১১ হলো, তখন থেকে তার মাসিক আরম্ভ হলো। প্রতিমাসেই রক্তক্ষরণের পাশাপাশি বমি হতে শুরু করলো। অসহ্য যন্ত্রণায় তিনি না পারতেন খেতে, না পারতেন ঘুমাতে। তার কাছে মনে হতে লাগলো তিনি মারা যাচ্ছেন, কিন্তু কেউ তার তোয়াক্কা করছে না। তখন বিষয়টি না বুঝলেও এর ঠিক দশ বছর পরে গিয়ে ধরা পড়লো তার এই অসহ্য যন্ত্রণার কারণ। চিকিৎসক জানালেন, তিনি ‘এন্ডোমেট্রিওসিস’ নামক রোগে আক্রান্ত।
এন্ডোমেট্রিওসিস কী?
জরায়ুর সবচেয়ে ভেতরের স্তরের নাম এন্ডোমেট্রিয়াম। এই এন্ডোমেট্রিয়ামে থাকা বিশেষ কোষগুচ্ছ যদি জরায়ুর বাইরে অবস্থান নেয় তাহলে এই অবস্থাকে বলা হয় এন্ডোমেট্রিওসিস।
উপরে বর্ণিত ক্রিস্টির উপসর্গগুলো তুলে ধরা হয়েছে স্যালি রুনির উপন্যাসের ভিত্তিতে নির্মিত টিভি সিরিজ ’করভারসেশন উইথ ফ্রেন্ডন্স’-এ। এখানে দেখা যায় টিভি সিরিজের একটি চরিত্র ‘ফ্রান্সিস’ এন্ডোমেট্রিওসিসের যন্ত্রণায় কখনো ওয়াশরুমে কাতরান, কখনো বা ভীড়ের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে যান। টিভি সিরিজটি নির্মাণে সহায়তা নেয়া হয়েছে চিকিৎসক ফিওনা রেইডির, যিনি একাধারে একজন নারী রোগবিশেষজ্ঞ এবং এন্ডোমেট্রিওসিস রোগের চিকিৎসায় অভিজ্ঞ। সিরিজের মাধ্যমে একজন এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারীর সংগ্রাম সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
যেকোনো বয়সের নারীই এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন; এমনকি টিনেজাররাও! প্রতি ১০০ জনে অন্তত ১০ জন নারী রোগটিতে ভুগে থাকেন।
যেসব জায়গায় এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে
- ডিম্বনালী,
- ইউটেরাস বা জরায়ুর আশেপাশের লিগামেন্টগুলোতে,
- শ্রোণী গহ্বরের লাইনিংয়ে,
- ডিম্বাশয়ে,
- জরায়ুর বহিঃপৃষ্ঠে, এবং
- জরায়ু এবং মলাশয় বা মূত্রথলির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে।
লক্ষণসমূহ
- শ্রোণীদেশে ব্যথা হওয়া। একে ‘পেলভিক পেইন’ বলে। মাসিক চলাকালে এই ব্যথা আরো তীব্র আকার ধারণ করে৷
- তীব্র ব্যথাযুক্ত পিরিয়ড হওয়া, যা রোগীর দৈনন্দিন কাজকে বাধাগ্রস্থ করতে পারে। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ডিসম্যেনুরিয়া বলা হয়।
- মাসিক চলাকালে প্রস্রাব বা পায়খানা করার সময় ব্যথা অনুভব করা।
- মাসিকের সময় তীব্র রক্তপাত হওয়া।
- যৌন সহবাসের সময় বা পরে ব্যথা হওয়া।
- অসুস্থ অনুভব করা, কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা, ডায়রিয়া কিংবা প্রস্রাব-পায়খানা করার সময় রক্তপাত হওয়া।
- গর্ভধারণে সমস্যা হওয়া।
- বিষন্নতা।
এন্ডোমেট্রিওসিসের কারণ
১. এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুচ্ছ রক্ত বা লসিকার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে পরিচালিত হলে।
২. জিনগত কারণে হতে পারে। পরিবারের অন্য কারো এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে।
৩. সি সেকশন বা হিস্টেরেক্টমির মতো অপারেশনের কারণে এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুলো অন্ত্র বা অন্য কোনো অঙ্গের প্রাচীরে লেগে যেতে পারে। যার ফলে রোগটি হতে পারে।
৪. শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল হলে। এর ফলে জরায়ুর বাইরে তৈরি হওয়া এন্ডোমেট্রিয়াল কোষগুলোকে শরীর ধ্বংস করে দিতে পারে না।
রিস্ক ফ্যাক্টরস
- নির্দিষ্ট সময়ের আগেই মাসিক শুরু হওয়া (১১ বছর বয়সের পূর্বে)।
- দেরিতে মেনোপজ বা রজঃনিবৃতি ঘটা।
- সংক্ষিপ্ত রজঃচক্র হওয়া ( ২৭ দিনের কম)।
- রজঃস্রাবকাল ৭ বা তার অধিক দিন হওয়া।
- BMI বা শরীরের ওজনের সাথে উচ্চতার অনুপাত কম হওয়া।
- পারিবারিক ইতিহাসে আগে কারো এন্ডোমেট্রিওসিস হয়ে থাকলে। যেমন- মা/ বোন/ খালার এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে।
- জরায়ুর অস্বাভাবিক আকার।
- গর্ভাশয়ের কোনো রোগ থাকলে।
- এস্ট্রোজেন নামক হরমোন দেহে বেশি পরিমাণে উৎপন্ন হতে থাকলে।
রোগপরবর্তী জটিলতা
- গর্ভধারণে অক্ষমতা বা জটিলতা; প্রায় ৩৩%-৫০% এন্ডোমেট্রিওসিসে আক্রান্ত নারী এই জটিলতায় ভুগে থাকেন।
- ওভারিয়ান ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বেড়ে যায়। আরেক ধরনের ক্যান্সার হতে পারে যাদের একসময় এন্ডোমেট্রিওসিস ছিলো। এর নাম এন্ডোমেট্রিওসিস অ্যাসোসিয়েটেড এডেনোকারসিনোমা।
রোগনির্ণয় পদ্ধতি
- ল্যাপরোস্কপি,
- বায়োপসি,
- আল্ট্রাসাউন্ড, এবং
- এমআরআই (MRI)।
প্রতিরোধ
এন্ডোমেট্রিওসিস একটি ইডিওপ্যাথিক বা অজানা কারণঘটিত অবস্থা। একে মোকাবেলার নির্দিষ্ট কোনো পন্থা নেই। তবে লক্ষণ দেখা যাবার সাথে সাথে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে দ্রুত রোগনির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব।
গর্ভধারণ এবং স্তন্যদান এন্ডোমেট্রিওসিসের হবার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও, প্রাত্যহিক জীবনে ফলমূল খাওয়া, বিশেষ করে সাইট্রাস ফলসমূহ, বিশেষ উপকারী ভূমিকা রাখে।