যুক্তরাষ্ট্রের ২০তম প্রেসিডেন্ট জেমস আব্রাম গারফিল্ড একবার বড় ধরনের হামলার শিকার হন। ১৮৮১ সালের ২ জুলাই সকালের ঘটনা। ওয়াশিংটনের একটি রেল স্টেশনে কোনো এক অজ্ঞাত ব্যক্তির হাতে দুবার গুলিবিদ্ধ হন তিনি। একটি গুলি তার একটি বাহুকে ছুঁয়ে চলে যায়। তাই তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। কিন্তু আরেকটি গুলি তার অগ্ন্যাশয়ের নিচের দিক দিয়ে শরীরের একদম ভিতরে ঢুকে যায়। এমন দুর্ঘটনার পর অপারেশন করে গুলিটি বের করে ফেলাটাই স্বাভাবিক, কিন্তু সমস্যা বাঁধে সেখানেই। চিকিৎসকরা অনেকবার পর্যবেক্ষণ করেও গুলিটির কোনো হদিস পাননি। প্রেসিডেন্টের শরীরে প্রবেশ করার পর গুলিটি পাঁজরের সাথে ধাক্কা খেয়ে বিচ্যুত হয়ে যায়। এমনকি গুলির প্রবেশ পথ থেকেও সেটার শরীরের ভিতরের অবস্থান সম্পর্কে খুব বেশী ফলপ্রসূ তথ্য তখনও পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছিলো না।
গারফিল্ড একজন রিপাবলিকান এবং তেজস্বী বলবান প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৮৮০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে এক বছর পরই চার্লস গেটে নামের এক আততায়ীর হাতে তাকে মৃত্যুবরণ করতে হয়। আততায়ী প্রেসিডেন্টকে পেছন থেকে গুলি করে। এই ঘটনার সময় তার আশেপাশে অনেক মানুষ ছিল, তাই আততায়ী সাথে সাথেই ধরা পড়ে যায়। স্থানীয় চিকিৎসক ড. ব্লিস ঘটনাস্থলে যান এবং গিয়ে দেখেন যে গারফিল্ডের চেহারা একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তখনও তার চেতনা ছিল। চিকিৎসককে তিনি তার অসাড়তার কথা বলেছিলেন।
সেখান থেকে গারফিল্ডকে নিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকরা মনে করেছিলেন যে, তাকে হয়তো বাঁচানো যাবে না। কারণ ১১টা নাগাদ তার পালস রেট ছিল প্রতি মিনিটে ১৫৮ বিট, প্রতি মিনিটে ৩৫ বার করে শ্বাস প্রক্রিয়া চলছিল এবং শরীরের তাপমাত্রা ৯৬.৫ ডিগ্রিতে নেমে যায়। কিন্তু মাঝরাতে তার অবস্থা একটু ভালোর দিকে যায়। তখন পালস রেট প্রতি মিনিটে ১২০ বিটে নেমে আসে, প্রতি মিনিটে ২০ বার করে শ্বাস প্রক্রিয়া চলছিল এবং শরীরের তাপমাত্রা ৯৮ ডিগ্রিতে উঠে আসে। চিকিৎসকরা তাকে আশ্বাস দেন যে, হয়তো তাকে বাঁচানো যাবে। প্রেসিডেন্টও তাদেরকে যা যা করণীয় তার সবই চেষ্টা করার নির্দেশ দেন।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেই হয়তো ব্যাপারটি নিয়ে তখন হইচই পড়ে যায়। কারণ ভিতরের গুলিটি বের না করা গেলে মৃত্যু অনিবার্য। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এরকম পরিস্থিতি প্রায়ই তৈরি হয়। কিন্তু তখনকার কথা আলাদা। কারণ চিকিৎসাবিজ্ঞান তখনও পর্যন্ত এত উন্নতি লাভ করেনি। তবুও চেষ্টা তো করতে হবে। তাই তখন গুলিটি খোঁজার জন্য অভিনব একটি কায়দা ভাবা হয়।
এটা যখনকার ঘটনা তখনকার দিনে টেলিফোন আবিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো এবং তা জনসমক্ষে প্রচারও হয়েছিলো। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল তখন এক বিখ্যাত নাম। এই গুলি শরীরের কোথায় লুকিয়ে আছে তা খুঁজে বের করার জন্য তার ডাক পড়লো। মেটাল ডিটেক্টরের মতোই তখন বেলের কাছে এমন একটি যন্ত্র ছিল যেটা ধাতব পদার্থ খুঁজে বের করতে পারে, যার নাম ইন্ডাকশন ব্যাল্যান্স (Induction Balance)।
এই যন্ত্রের দুটি ভাগ ছিল। একটি ছিল এর ভিতরকার তড়িৎচুম্বক (Electromagnet) যেটা ব্যাটারির মাধ্যমে চলে। আরেকটি ছিল ছোট্ট কয়েল যেটা টেলিফোনের রিসিভারের সাথে লাগানো থাকতো। তখনকার সময়ে এই রিসিভারের মতো জিনিসটি কানের কাছে ধরে অন্য পাশের কথা শুনতে হতো। ব্যাটারি সবসময়ই তড়িচ্চুম্বকের ভিতর দিয়ে সুষম তড়িৎ (Steady Current) প্রেরণ করে। এর ফলে সেই তড়িচ্চুম্বকের চারপাশে একটি চৌম্বক বলয় তৈরি হয়।
এই প্রক্রিয়া মাথায় আসার পর বেল একটি ব্যবহারিক পদ্ধতি তৈরি করলেন। তিনি রিসিভারের কয়েলটিকে এমনভাবে রাখলেন যেন চৌম্বক বলয় সেটার সাথে উলম্বভাবে থাকে। যদি বেল কোনোভাবে কয়েলের মাধ্যমে এই বলয়ে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেন তাহলে সেই কয়েলটিতে তড়িৎপ্রবাহ উৎপন্ন হবে এবং তা উৎপন্ন হওয়ার সাথে সাথে একধরনের ক্লিক হওয়ার মতো শব্দ সেখানে তৈরি হবে যেটা রিসিভারে ধরা পড়বে।
গ্রাহাম বেলের উদ্দেশ্য ছিল গারফিল্ডের আহত শরীরের উপর দিয়ে এই তড়িৎচুম্বক এবং কয়েলটি নিয়ে আনা-নেওয়া করা। যদি এই যন্ত্রটি কোনোভাবে বুলেটের উপর দিয়ে যায় তখন বুলেটিতে সেই তড়িৎচুম্বক বলয়ের দিক পরিবর্তন করবে এবং এর ফলে রিসিভারের মাধ্যমে একটি শব্দ শোনা যাবে। এই শব্দ থেকেই শরীরের ভিতরে বুলেটের অবস্থান সম্পর্কে জানা যাবে। বেল অনেকবার যন্ত্রটি গারফিল্ডের শরীরের বিভিন্ন দিকে নিয়ে গেলেন, কিন্তু কোনোভাবেই বুলেটটির অবস্থান জানতে পারলেন না।
আসল কথা হচ্ছে, বেলের যন্ত্রে কোনো সমস্যা ছিল না। আসলে বুলেটটি ছিল সীসার (Lead) তৈরি, যে কারণে যন্ত্রটি একে ভালোভাবে শনাক্ত করতে পারছিলো না। কিন্তু বুলেটটি সীসা না হয়ে ইস্পাতের যদি তৈরি হতো তাহলে খুব সহজেই এই শনাক্তকরণ সম্ভব হতো। এছাড়া আরেকটি সমস্যা ছিল। পরে গিয়ে জানা গিয়েছে যে, বুলেটটি গারফিল্ডের শরীরের উপরিভাগ থেকে অনেক ভিতরের দিকে চলে গিয়েছিলো, এ কারণেও বেলের সেই যন্ত্রের সাহায্যে শনাক্তকরণ সম্ভব হয়ে উঠছিল না।
যখন কোনোভাবেই আর সম্ভব হলো না বেল হাল ছেড়ে দিলেন। এই ঘটনার প্রায় এক মাস পরে জেমস গারফিল্ড মারা যান। প্রায় ৮০ দিন পর্যন্ত তাকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে হয়। উল্লেখ্য যে, এই সময়ে তার বড় কোনো অস্ত্রোপচার হয়নি, কোনো এন্টিবায়োটিক দেওয়া হয়নি, ইন্ট্রাভেনাস ফ্লুইড বা ব্লাড ট্রান্সফিউশনও দেওয়া হয়নি।
যদি প্রেসিডেন্ট গারফিল্ডকে আধুনিক চিকিৎসা দেয়া যেত, তাহলে হয়তো তাকে বাঁচানো যেত। কারণ ১৮৮১ সালে অস্ত্রোপচারও তেমন উন্নতি করেনি যে, সঠিকভাবে বুলেটটি খুঁজে বের করা যাবে। একদিক দিয়ে হতভাগাই বলতে হয় প্রেসিডেন্ট গারফিল্ডকে। আহত হওয়ার পর নিবিড় চিকিৎসা দিয়েও তাকে বাঁচানো যায়নি।
তথ্যসূত্র:
[১] Walker, J. (2007). Flying Circus of Physics. John Wiley & Sons, Inc.
[২] Stevens, R. L. A president’s assassination, JAMA – Journal of the American Medical Association, 246, No. 15, 1673-1674 (9 October 1981)
[৩] Bell, A. G. (1883). Upon the Electrical Experiments to Determine the Location of the Bullet in the Body of the Late President Garfield and Upon the Successful Form of Induction Balance for the Painless Detection of Metallic Masses in the Human Body. American Journal of Science, 25(145-150), 22-61.
[৪] First attempt to Locate a Bullet without Surgery: An Application of Electromagnetism to 19 th Century Medicine, Physics Education Research Group, Kansas State University (Modern Miracle Medical Machines)
ফিচার ইমেজ সোর্সঃ youtube.com