১
মানুষের মহাকাশ অনুসন্ধানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তরে আপনার মাথায় দুটো উত্তর আসতে পারে। এক, টেলিস্কোপ, ও দুই, রকেট। আসলে রকেটের সাহায্যেই মানুষের পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।
রকেট যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা নিশ্চয়ই আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। মহাকাশযান থেকে নভোটেলিস্কোপ, পৃথিবীর সীমানার বাইরে যেকোনো কিছু পাঠানোর পেছনে এটি অপরিহার্য।
এখন, এই ২০২০ সালে এসে রকেট আমাদের কাছে খুবই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। নিয়মিত হারে একের পর এক রকেট উৎক্ষেপণ করছে মহাকাশ সংস্থাগুলো। রাশিয়ান মহাকাশ সংস্থা রসকসমস (ROSCOSMOS), ইউরোপিয়ান মহাকাশ সংস্থা ইসা (ESA) এবং মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার (NASA) মতো সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ছাড়াও স্পেস-এক্সের মতো বেসরকারি উদ্যোগেও রকেট উৎপাদন ও উৎক্ষেপণ করা হচ্ছে। বিশেষ করে স্পেস-এক্স তো রকেট প্রযুক্তিকে এক ধাক্কায় এগিয়ে নিয়ে গেছে অনেকদূর।
কিন্তু এই সব কিছুর শুরুটা কীভাবে হয়েছিল? বিমান আবিষ্কার ও এর পেছনের গল্পটা আমরা মোটামুটি জানি। জানি রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের কর্মকাণ্ডের কথা। কিন্তু রকেট কে আবিষ্কার করলেন? কীভাবে মানুষ পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখল? সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়নই বা করল কীভাবে?
এই ইতিহাসটা এত চমৎকার ও প্রাচীন যে, বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। নিশ্চয়ই ভাবছেন, কত প্রাচীন? এই দেড়-দু’শো বছর? উহু, হয়নি। প্রথম সত্যিকারের রকেটের গল্প শুনতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ৮০০ বছর আগের চীনে। ঠিক ধরেছেন। দ্য ফার্স্ট রকেট ওয়াজ মেইড বাই চায়না! তবে আদি-রকেটের আবির্ভাব আসলে আরো আগে। সেই প্রাচীন পৃথিবীতে।
২
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে বিস্মিত হয়েছে। কল্পনায় গ্রহ-নক্ষত্রদের ভেবে নিয়েছে স্বর্গীয় বস্তু। এসব স্বর্গীয় বস্তুরা আসলে কী এবং এরা ঠিক কীভাবে কাজ করে- এ ব্যাপারে মানুষের যথাযথ কোনো ধারণা ছিল না। তাই স্বর্গের পাশাপাশি আকাশের বুকে দেবতাদের আবাসের কথাও তারা ভেবেছিল। তবে মজার ব্যাপার হলো, দেবতারা নয়, তখনকার মানুষের হিসেবে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে কিন্তু ছিল মানুষ। অর্থাৎ মানুষ দেবতাদেরকে নিয়ে যতটা না চিন্তিত, কিংবদন্তী ঘাটলে দেখা যায়, দেবতারা মানুষকে নিয়ে তার চেয়ে বেশি চিন্তিত! মানে, নিজেদেরকে মহান কিছু ভাবার এই ব্যাপারটা আমাদের সুপ্রাচীন অভ্যাস।
রিচার্ড ফাইনম্যান প্রাচীন মানুষের এই ধারণার কথা লিখতে গিয়ে বলেছেন, তারা ভাবত, দেবদূতেরা এসব গ্রহ-নক্ষত্রকে কাঁধে নিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে উড়ে যায়। এছাড়াও, কিংবদন্তীতে সূর্যদেবের কথা এসেছে। রথে টানা গাড়িতে করে যিনি প্রতিদিন সকালে যাত্রা শুরু করেন। সেই যাত্রার শেষ হয় সাঁঝের বেলা। যা-ই হোক, সেই প্রাচীন পৃথিবীতেই মানুষ প্রথম আদি-রকেট বা রকেটের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে ছিল।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালের কথা। এই গল্পটা জানা যায় অলাস গিলিয়াস নামের এক রোমান লেখকের লেখা থেকে। আর্কিটাস নামের এক গ্রিকের কথা বলেছেন তিনি। ট্যারেন্টাম শহরে থাকতেন ভদ্রলোক। এই শহরটি বর্তমানে দক্ষিণ ইতালিতে পড়েছে। ভদ্রলোক প্রথমবারের মতো একটি কাঠের পাখিকে উড়িয়ে মেরেছিলেন। পাখিটা এমনিতে একটা দড়িতে বাঁধা ছিল। উড়িয়ে মারার সময় পাখিটির পেছন থেকে বাষ্প বেরিয়ে আসছিল, আর পাখিটি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। খেয়াল করলে বোঝা যাবে, নিউটনের তৃতীয় সূত্র, মানে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারটিই তিনি এখানে ব্যবহার করেছিলেন।
এখানে একটা জিনিস একটু পরিষ্কার করে বলে দেওয়া দরকার। অক্সিজেন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে মানুষ যেমন নিঃশ্বাস নিত, আর্কিটাসের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নীতির ব্যবহারও খানিকটা তেমনি। নিউটনের আগেই তিনি এই সূত্রের ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এর পেছনের ব্যাপারটা বুঝতে পারেননি।
আরো প্রায় ৩০০ বছর পরে আরেক গ্রিক, আলেক্সান্দ্রিয়ার ‘হিরো’ রকেটের মতো আরেকটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন। এই যন্ত্রটাও বাষ্প ব্যবহার করেই ঘুরত। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন। ঘুরত, সামনে এগোত না!
এর নাম ছিল ‘হিরো ইঞ্জিন’। একটা পানি ভর্তি বোলের নিচে আগুন জ্বলছে। ওপরে, দুটো নল গিয়ে ঢুকেছে একটা গোল বলের ভেতরে। আগুনের তাপে পানি বাষ্প হয়ে গোলকটার ভেতরে ঢুকছে। এর দুই পাশে আবার দুটি এল-আকৃতির নল আছে। এই নল দিয়ে দুই পাশ একইসঙ্গে বাষ্প বেরিয়ে আসে। ফলে, বলটা ঘুরতে থাকে।
কথা হচ্ছে, এটাকে তাহলে আদি রকেটের মধ্যে ফেলছি কেন আমরা? কারণ, আধুনিক রকেট যে নীতি মেনে কাজ করে, এখানেও আমরা সেই একই নীতির ব্যবহার দেখতে পাচ্ছি। এসব টুকরো জ্ঞান, অপূর্ণাঙ্গ ধ্যান-ধারণার হাত ধরেই ধীরে ধীরে সামনে এগিয়েছে মানুষ ও সভ্যতা।
যা-ই হোক, আদি-রকেট নিয়ে অনেক তো হলো। এবারে চলুন, চীন থেকে ঘুরে আসা যাক!
৩
চৈনিকরা প্রথম ঠিক কবে ও কীভাবে রকেটের ধারণা পেয়েছিল, সেটা জানা যায়নি। তবে প্রথম শতকে সাধারণ গান-পাউডার আবিষ্কার করেছিল তারা। পরবর্তীতে সল্টপিটার, সালফার ও চারকোল দিয়ে তৈরি এই গান-পাউডার বাঁশের নল বা টিউবে পুরে যথাসম্ভব ধর্মীয় উৎসবে বাজি ফুটানোর জন্য ব্যবহৃত হতো। এই গান-পাউডারকে ‘ব্ল্যাক পাউডার’ও বলা হয়।
স্মিথসোনিয়ান’স ন্যাশনাল এয়ার এন্ড স্পেস মিউজিয়ামের সাবেক কিউরেটর ফ্র্যাঙ্ক উইন্টার ও তার সহকর্মী মাইকেল নিউফেল্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার পাওয়ারহাউজ মিউজিয়ামের কেরি ডোর্টি এ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। খুঁজতে গিয়ে চৈনিক লেখকদের পাণ্ডুলিপি থেকে এ সংক্রান্ত একটা গল্প আবিষ্কার করেছেন তারা। এই গল্পের সত্য-মিথ্যা অবশ্য জানার উপায় নেই। গল্প মতে, সে সময় বিস্ফোরকপূর্ণ বাঁশের টিউবকে বলা হতো তি লাও শু (মেটে-ইঁদুর)। কারণ, প্রথমদিকে এসব বাঁশের টিউব ওড়ানো হতো না। বরং বিস্ফোরিত হওয়ার সময় এরা মাটি ঘেঁষে চতুর্দিকে ছুট দিত।
তের শতকের কথা। রাজকীয় উৎসব চলছে। উৎসবের আয়োজন করেছেন চৈনিক সম্রাট লি চুং। হঠাৎ তার স্ত্রী চিৎকার করে উঠলেন। একটা ‘মেটে-ইঁদুর’ উড়ে এসে তার চেয়ারের নিচে ধাক্কা দিয়েছে। সেই উৎসবের ওখানেই সমাপ্তি। আর, এসব ‘মেটে-ইঁদুর’ যাদের দায়িত্বে ছিল, তাদের গ্রেপ্তার করে জেলে পুরেছিলেন লি চুং।
বিজ্ঞানীদের ধারণা, বিস্ফোরকপূর্ণ কিছু টিউব হয়তো বিস্ফোরিত হয়নি। হয়তো আগুন থেকে লাফিয়ে ওপরে উঠে গিয়েছিল। এ সময় ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল গ্যাস ও গান-পাউডার। এসব গান-পাউডার পোড়ার সময় টিউবগুলোকে ধাক্কা দিয়েছিল ওপরের দিকে। সাথে গ্যাসের ধাক্কা তো ছিলই। ফলে উড়াল দিয়েছিল বাঁশের এই টিউব রকেট।
এই দুর্ঘটনা চৈনিকদের সামনে নতুন এক দিগন্ত খুলে দিল। গান-পাউডারপূর্ণ বাঁশের টিউব নিয়ে গবেষণা শুরু করল তারা। প্রথমদিকে টিউবে বিস্ফোরক পুরে, তীরের আগায় বেঁধে ছুঁড়ে দেওয়া হতো। কিছুদিন পরে তারা আবিষ্কার করল, এসব টিউব নিজে নিজেই ছুট দিতে পারে। টিউবের পেছনের অংশটা থাকে খোলা। ভেতরের বিস্ফোরকে আগুন ধরিয়ে দিলে বিস্ফোরণের ফলে টিউবের পেছন থেকে যে গ্যাস ও গান-পাউডার গুঁড়ো বেরিয়ে আসে, তাতে ভর করে সবেগে ছুট দিতে পারে এসব টিউব। জন্ম নিল প্রথম সত্যিকারের রকেট। আর, কিছুদিনের মধ্যেই এসব রকেটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করার সুযোগও এসে গেল।
১২৩২ সাল। চীনে হামলা করতে এল মঙ্গোলরা। এটি ‘কাই-কেং এর যুদ্ধ’ বলে খ্যাত। এই যুদ্ধেই প্রথম রকেট ব্যবহার করে চীনারা। যদিও চৈনিক লেখকরা এগুলোকে ‘উড়ন্ত অগ্নি-তীর’ বলে উল্লেখ করেছেন। এসব অগ্নি-তীর আসলেই কতটুকু কার্যকরী ছিল, সেটা জানার কোনো উপায় নেই। তবে মঙ্গোলদের মনোবল ভেঙে গিয়েছিল। যুদ্ধে হেরে ঘরে ফিরে গিয়েছিল তারা। পরে, দেশে ফিরে তারা নিজেরাই রকেট গবেষণায় মেতে ওঠে। পরবর্তীতে ১৩ থেকে ১৫ শতকের মধ্যে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় নানারকম রকেট-এক্সপেরিমেন্টের দেখা পাওয়া যায়। ধারণা করা হয়, ইউরোপে রকেট ছড়িয়ে দেওয়ার পেছনেও এই মঙ্গোলরাই ভূমিকা রেখেছে।
এই সময়টায় রকেট আনন্দ-উপাদান থেকে পুরোপুরি ধ্বংসাত্মক অস্ত্রে পরিণত হলো। রজার বেকন নামের এক ইংরেজ গান-পাউডারের কিছুটা উন্নতি করেন। ফলে রকেটের পাল্লা গেল বেড়ে। ফ্রান্সের জিন ফ্রয়সার্ত খেয়াল করলেন, খালি রকেট না ছেড়ে এটাকে যদি কোনো ক্ষেপনাস্ত্র টিউবের মাধ্যমে ছুঁড়ে দেওয়া যায়, তাহলে আরো ভালোভাবে লক্ষ্য ভেদ করা যাচ্ছে। ফ্রয়সার্তের এই ধারণার ওপরে ভিত্তি করেই পরবর্তীতে আধুনিক বাজুকা গড়ে ওঠে। এদিকে জোয়ানস দে ফন্টানা নামের এক ইতালিয়ান নতুন একধরনের অস্ত্র আবিষ্কার করলেন। এটা মাটি কামড়েই ছুট দেবে। তীরে দাঁড়িয়ে এই অস্ত্র দিয়ে কাছাকাছি যে কোনো জাহাজে আগুন ধরিয়ে দেওয়া যাবে। আসলে, এটা ছিল রকেটচালিত একধরনের টর্পেডো।
পরবর্তী বেশ কিছুদিন রকেটের মূল ব্যবহার হয়েছে অস্ত্র হিসেবেই। আধুনিক রকেটও আসলে যতটা না মহাশূন্যে পাড়ি জমানোর জন্যে জন্ম নিয়েছে, তার চেয়ে ধ্বংসের দূত হিসেবেই এর ভূমিকা বেশি হতে পারত। কিন্তু হয়নি। সেই গল্পে আমরা আরেকটু পরে আসছি। আসলে, সরলরৈখিকভাবে ইতিহাসের পাতা উল্টে গেলে কিছুটা সামনে এসে আবারো পেছনে ফিরে যেতে হবে আমাদের। প্রথম দেখায় মনে হবে, ১৫ শতকের পরের তিনশ বছরে রকেট নিয়ে তেমন কিছুই হয়নি। তারপর, ১৯ শতকের শুরুর দিকের কংগ্রেভ রকেট আধুনিক রকেটের সূচনা করেছে। আসল ঘটনা কিছুটা ভিন্ন। মাঝের এই তিনশ বছরে রকেটের ইতিহাস দুজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের দেখা পেয়েছে। কারা তারা?
৪
১৯৬১ সাল। সিবিউ। এই শহরটি বর্তমানে সেন্ট্রাল রোমানিয়ার ট্রানসিলভানিয়ায় পড়েছে। সিবিউ পাবলিক রেকর্ড ঘাঁটতে গিয়ে গবেষকরা হঠাৎ এক অদ্ভুত পাণ্ডুলিপি পেলেন। এর নাম হয়ে গেল ‘সিবিউ পাণ্ডুলিপি’। জার্মান ভাষায় লেখা ৪৫০পৃষ্ঠার এই পাণ্ডুলিপি রকেটের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের এতদিনের ধারণা রাতারাতি বদলে দিল। মানে, চোখ কপালে উঠে যাওয়ার মতো অবস্থা!
পাণ্ডুলিপির লেখক কনরাড হাস। ভদ্রলোক ট্রানসিলভানিয়ার (মতান্তরে অস্ট্রিয়ান) প্রধান সামরিক প্রকৌশলী ছিলেন। ১৫০৯ সালে জন্মেছিলেন হাস। পাণ্ডুলিপিতে অবশ্য তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি। মূল পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে বিস্তারিত খুব বেশি তথ্যও পাওয়া যায়নি। তবে গবেষকরা ধারণা করছেন, পাওয়া যাওয়া অংশটি মূল পাণ্ডুলিপির তৃতীয় খন্ড।
হাস এখানে ‘ফ্লাইং জ্যাভেলিন’ বা ‘উড়ুক্কু বর্শা’ নামে নতুন এক প্রযুক্তির বর্ণনা দিয়েছেন, আশ্চর্যজনকভাবে যা বহুস্তর বিশিষ্ট রকেটের বর্ণনার সাথে বহুলাংশে মিলে যায়। ডেলটা বা ত্রিভুজাকৃতির ডানা, ঘণ্টাকৃতির নল, বিভিন্ন তরলের সংমিশ্রণে তরল জ্বালানি তৈরি থেকে শুরু করে কয়েক প্রকোষ্ঠ বিশিষ্ট রকেটের গতিতত্ত্বও আবিষ্কার করেছিলেন হাস।
এমনিতে পাণ্ডুলিপি থেকে দেখা যায়, সামরিক এই প্রকৌশলী যুদ্ধবিরোধী ছিলেন। তার এসব আবিষ্কার তিনি বাস্তবে ব্যবহার করেছেন কি না, এ নিয়ে তাই বিতর্ক আছে। ব্যবহার করেছেন, এমন কোনো নিরেট প্রমাণ নেই। অর্থাৎ এরকম কোনো বিবৃতি পাওয়া যায়নি। আবার, এ ধরনের প্রযুক্তি বানানোর মতো সব উপাদান থাকার পরেও না বানানোর কোনো কারণ বা যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া একজন মানুষ রকেট ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এরকম চিত্রও পাণ্ডুলিপিতে আছে। সে যা-ই হোক, কনরাড হাসকেই এখন বহুস্তরবিশিষ্ট রকেট উদ্ভাবকের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। [সিবিউ পাণ্ডুলিপি নিয়ে বিস্তারিত পড়া যাবে এখানে।]
আগে এই স্বীকৃতি ছিল কাজিমিয়ার্জ সিমেনোউইকজকের। হাসের কারণে তিনি শুধু স্বীকৃতিই না, গুরুত্বও হারিয়েছেন। আসলেই, ইতিহাস দ্বিতীয় স্থান অধিকারীকে মনে রাখে না!
৫
গত একশ বছরের বেশি সময় ধরে দ্য গ্রেট আর্ট অফ আর্টিলারি বইটি আধুনিক রকেট প্রযুক্তির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। পোলিশ এই বইটির জার্মান (১৬৭৬ সাল) ও ইংরেজি (১৭২৯ সাল) অনুবাদও হয়েছে।
কাজিমিয়ার্জ সিমেনোউইকজক ছিলেন পোল্যান্ডের রাজার লেফট্যানান্ট জেনারেল অফ অর্ডিন্যান্স ইন সার্ভিস। তিনি মূলত ‘কমপ্লিট আর্ট অফ আর্টিলারি’ নামে দুই খণ্ডের একটি বই লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগে প্রথম খন্ডটির কাজই শুধু শেষ হয়েছিল। এই বইয়ের প্রথম পাঁচ অধ্যায়ে ক্যালিবার, পাইরোটেকনিক, রকেট, অগ্নিগোলক এবং নানা ধরনের ক্ষেপনাস্ত্র ইত্যাদির পেছনের সবকিছু উঠে এসেছে।
যেহেতু এর আগের কোনো গ্রন্থ বা পাণ্ডুলিপিতে এ সংক্রান্ত কিছু পাওয়া যায়নি, তাই আগে তাকেই বহুস্তরবিশিষ্ট রকেটের উদ্ভাবক ভাবা হতো। আগেই বলেছি, তিনি এই স্বীকৃতি হারিয়েছেন। কারণ, তার আগেই এই প্রযুক্তির কথা শুধু ভাবাই হয়নি, লিপিবদ্ধও করা হয়েছে।
এই প্রসঙ্গে আরেকজন মানুষের কথাও বলতে হবে। জোহান শ্মিডল্যাপ। ১৬ শতকের মানুষ। দুই এবং তিনস্তরবিশিষ্ট রকেট নিয়ে প্রথম এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি।
তবে মাঝের তিনশ বছরে যে দুজন গুরুত্বপূর্ণ মানুষের কথা বলা হয়েছে, সিমেনোউইকজক বা শ্মিডল্যাপ তাদের মধ্যে পড়েন না। এই দুজনের একজন কনরাড হাস। আরেকজন আমাদেরই উপমহাদেশের এক বীরযোদ্ধা। টিপু সুলতান!
৬
১৯৬৩ সালের কথা। এ পি জে আবদুল কালাম প্রশিক্ষণের জন্য নাসার ওয়ালপস ফ্লাইট ফ্যাসিলিটিতে গিয়েছিলেন। রিসেপশন লবিতে হাঁটার সময় তার চোখ আটকে গেল একটি চিত্রকর্মে। একটা যুদ্ধক্ষেত্রের ছবি ঝোলানো আছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, পেছন থেকে বেশ কিছু রকেট ধেয়ে আসছে, আর সামনে রকেট হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে একটি সেনাবাহিনী।
একটি রকেট ফ্লাইট কেন্দ্রে এমন পেইন্টিং থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু আব্দুল কালাম বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলেন, রকেট নিক্ষেপকারী সৈন্যদের ঠিক ইউরোপিয়ান, মানে শ্বেতাঙ্গ মনে হচ্ছে না। বরং তাদের মুখাবয়ব দেখে উপমহাদেশের লোক বলে মনে হচ্ছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে পেইন্টিংটির আরো কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।
এটি ছিল মহীশুরের বীর টিপু সুলতানের বাহিনীর সাথে ব্রিটিশ সৈন্যদের যুদ্ধের ছবি। মহীশুরের সেনাবাহিনীর বিধ্বংসী রকেট ক্ষেপণাস্ত্রের হামলায় নাকাল ব্রিটিশ সৈন্যদের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল সেখানে। আবদুল কালামের একইসাথে বেদনা ও গর্ববোধ হলো। ইতিহাসের পাতায় যে মানুষটির নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকার কথা, উপমহাদেশের মানুষ তাকে কী অবলীলায় ভুলে গেছে! ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকলেও তাই একরকম হারিয়েই গেছে টিপু সুলতানের কীর্তি। কথা হলো, কী নিয়ে এত হইচই? ঠিক কী করেছিলেন তিনি?
টিপু সুলতানের বাবা হায়দার আলীর সময় থেকেই ইংরেজদের সাথে একাধিক যুদ্ধ হয়েছে মহীশুরের। হায়দার আলীর বাহিনীতেই রকেট-সৈনিকের সংখ্যা ছিল বারোশজনের মতো।
টিপু সুলতানের আমলে মহীশুরকে আরো শক্তিশালী ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির মুখোমুখি হতে হয়। টিপু বুঝতে পেরেছিলেন, ইংরেজদের সাথে টিকে থাকতে হলে আরো নতুন কিছু উদ্ভাবন করতে হবে। এই ভাবনা থেকেই রকেট গবেষণায় জোর দেন তিনি। মহীশুরের গবেষকদের হাত ধরে রকেট প্রযুক্তিতে একটা বড় পরিবর্তন আসে। রকেটের জ্বালানীকক্ষ হিসেবে আগে বাঁশ বা এরকম কিছু ব্যবহার করা হতো। চৈনিকদের সময় থেকে এভাবেই চলে আসছে সব। টিপুর লোকেরা বাঁশের বদলে লোহার বাক্স ব্যবহার করতে শুরু করেন।
এই ধাতব কাঠামোর জন্য রকেটের জ্বালানীর বিস্ফোরণ আরো ভয়ংকর ও তীব্র হয়ে উঠল। ফলে রকেটের গতিবেগ ও পাল্লা গেল বেড়ে। এসব রকেট সর্বোচ্চ দুই কিলোমিটার পর্যন্ত দূরে গিয়ে লক্ষ্যে আঘাত করতে পারত। সে সময়ের ইউরোপিয়ান রকেটগুলোর পাল্লা বা গতিবেগ এর ধারেকাছেও ঘেঁষতে পারেনি।
রকেটের সাথে তলোয়ার ও বাঁশের ফলাও যুক্ত করে দিত টিপু সুলতানের দল। লোহা দিয়ে তৈরি জ্বালানিকক্ষের খাঁজে এটি বসিয়ে দেওয়া যেত। এক্ষেত্রে, জ্বালানি কক্ষ হিসেবে সাধারণত আট ইঞ্চি লম্বা ও দেড় থেকে তিন ইঞ্চি ব্যাসের লোহার টিউব ব্যবহার করা হতো। টিউবের ব্যাস ও লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব হিসেব করে নির্দিষ্ট কৌণিক দিকে রকেট ছোঁড়ার জন্য রকেট-সৈনিকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও ছিল। এছাড়াও ছিল বিশেষভাবে নির্মিত রকেট লঞ্চার। এই লঞ্চার থেকে একসাথে পাঁচ থেকে দশটি পর্যন্ত রকেট নিক্ষেপ করা যেত।
তারপরও দুর্ভাগ্য ও প্রতিবেশী রাজ্যের অসহযোগিতার ফলে ১৭৯৯ সালে তুরানখাল্লির যুদ্ধে শহীদ হন টিপু সুলতান। এ যুদ্ধ থেকে ৭০০ রকেট এবং ৯০০ রকেটের যন্ত্রাংশ ব্রিটিশদের হস্তগত হয়। এ রকেটগুলো উইলিয়াম কনগ্রেভ ইংল্যান্ডে নিয়ে যান। রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে মহীশুরের রকেটের ভেতরের কলাকৌশল বুঝতে পেরেছিল ইংরেজরা। এর ওপরে ভিত্তি করেই উইলিয়াম কনগ্রেভ উদ্ভাবন করেন কনগ্রেভ রকেট।
হ্যাঁ, তিনি ও তার দল আরো কিছুটা উন্নয়ন করেছিলেন রকেট প্রযুক্তির। কিন্তু এর ভিত্তি হিসেবে মহীশুরের রকেটের কথা অস্বীকার করা যাবে না কোনোভাবেই।
ইতিহাসের পাতার এক কোণে ঠিকই লেখা আছে এই মানুষটির কথা। থাকবে আজীবন। কিন্তু কোনো জাতি যদি নিজেদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ভুলে যায়, বাকিরা সেসব মনে রাখবে কেন? সেজন্যই আধুনিক রকেট প্রযুক্তির ভিত্তি হিসেবে কনগ্রেভ রকেটের কথা উঠে আসে। আড়ালে পড়ে যায় টিপু সুলতানের মতো এক বীর শহীদের কীর্তি।