যেকোনো আবিষ্কারের পেছনেই রয়েছে মানবজীবনে এর প্রয়োজনীয়তা। প্রয়োজনীয়তা ছাড়া কখনো কোনো কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। কারো না কারো কাছে একটা কিছুর প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে যা পৃথিবীতে তখনো তৈরি করা হয়নি। হয়তো তিনি আইডিয়া প্রদান করেছেন, কিংবা যতটুকু সম্ভব তৈরি করে গিয়েছেন। পরবর্তীতে দিনে দিনে আগ্রহীরা একে উন্নত করে তুলেছেন। এভাবেই আজকের দিনে আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে প্রতিটি প্রযুক্তি।
তাহলে এই কথা বলা যেতেই পারে, সুন্দরতম কোনো আবিষ্কারের পেছনে প্রয়োজনীয়তা ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ভুল-ত্রুটি। যুগে যুগে আবিষ্কারটির ব্যবহার করেছে মানুষ, ব্যবহারকারীদের মাঝ থেকেই ধীরে ধীরে উঠে এসেছে ভুল-ত্রুটিগুলোর সমাধান। সামান্য একটি অ্যাপের পেছনেও হাজার হাজার লাইনের কোডে থাকে বাগ। এই বাগগুলো ধীরে ধীরে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তবেই বেটা ভার্সন থেকে অ্যাপটি পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠে।
রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতিও একইভাবে আমাদের কাছে এসেছে। প্রথমদিকে যখন শুরু হয়, তখন সেটাকে পদ্ধতি না বললেও চলবে। তবু আইডিয়াটাই বা কম কীসে! কোনো এক চিকিৎসক ভাবলেন, রক্ত ক্ষরণ কিংবা নির্দিষ্ট ব্যাধিতে বাইরে থেকে রক্ত দেয়া গেলে হয়তো রোগীর উপকার হবে। তখন রোগীকে রক্ত মুখগহ্বর দিয়ে খাইয়ে দেয়া শুরু হলো। কিন্তু সেই রক্ত আসলে রোগীর কোনো উপকারেই আসতো না। বেশিদিন সময় লাগে না তৎকালীন মানুষদের এই ব্যাপারটি বুঝে নিতে।
পৃথিবীতে প্রথম সফল রক্ত সঞ্চালন কিন্তু কোনো মানুষে হয়নি। ব্রিটিশ চিকিৎসক রিচার্ড লওয়ার ১৬৬৫ সালের মাঝামাঝিতে একদিন দেখলেন, একটি কুকুর রক্তক্ষরণ হয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। তিনি তখন কুকুরটিকে বাঁচাতেই অন্য একটি কুকুরের ধমনী থেকে সরাসরি রক্ত সঞ্চালন করেন। এভাবে কুকুরটি প্রাণে বেঁচে যায়।
মানবদেহে রক্তের সিস্টেমিক সার্কুলেশন প্রথমবারের মতো সবার সামনে উন্মোচন করেন উইলিয়াম হার্ভে। তখনি মানুষ জানতে পারে শরীরের সমস্ত রক্ত সর্বদা একটি নির্দিষ্ট দিকে চলাচল করে থাকে; হৃৎপিন্ডের দিকে। এরপর চিকিৎসকেরা যখন টের পেলেন এই রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট কিছু রোগীকে বাঁচানো সম্ভব, তখন তারা ফাউন্টেইন পেনকে সূঁচ হিসেবে ও সিলভার পাইপকে রক্ত সঞ্চালক হিসেবে ব্যবহার করে রক্ত সঞ্চালন শুরু করলেন। কিন্তু ভুল যা করলেন তা হলো, তারা জানতেন না কোনো মানুষ ব্যতীত অন্য কোনো প্রজাতির প্রাণীর রক্ত মানুষের দেহে কার্যকর হবে না। এই রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা একটি অবুঝ প্রাণীর রক্ত মানুষের শরীরে সঞ্চালন করতে শুরু করলেন। ফলস্বরূপ মানুষের মৃত্যু হতে লাগলো। এই পদ্ধতির প্রয়োগ তখন বন্ধ হয়ে যায়।
তবে ভেড়ার শরীর থেকে রক্ত দেয়ার পরও মানুষের বেঁচে যাবার একটি ঘটনা রয়েছে, ১৬৬৭ সালে একজন চিকিৎসক, নাম জন ব্যাপ্টিস্ট ডেনিস, ১৫ বছরের এক ছেলের দেহে ভেড়ার রক্তের সঞ্চালন ঘটান। জন ব্যাপ্টিস্ট ডেনিস এই রক্ত সঞ্চালনকে সফল সঞ্চালন হিসেবেই রিপোর্ট করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে অবুঝ প্রাণী থেকে মানুষে যতগুলো রক্ত সঞ্চালন হয়, সবগুলো ব্যর্থ হয়েছিল। জন ব্যাপ্টিস্ট ডেনিস সত্য লুকিয়েছিলেন কিনা এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি, তবে এই রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতিটি আইন করে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ঐ বছরেই।
উনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ১৮১৮ সালে জেমস ব্লান্ডেল পুনরায় রক্ত সঞ্চালন শুরু করেন। তবে এবার আর কোনো অবুঝ প্রাণী নয়, একদম মানুষের রক্তই ব্যবহার করেন তিনি। তবে এর আগে তিনি আরো একটি কাজ করেন। রক্তক্ষরণ হয়েছে এমন একটি কুকুরকে অপর একটি কুকুরের রক্ত দিয়ে দেখান যে, এর থেকে বাঁচাতে হলে রক্ত সঞ্চালন করা প্রয়োজন। মানুষের রক্ত কুকুরের দেহে প্রবেশ করিয়েও পরীক্ষা চালান, কিন্তু কুকুরটি মারা যায়। তখন তিনি মানুষের রক্ত অপর মানুষের দেহে প্রবেশ করানোর সিদ্ধান নেন। এজন্য তিনি দুই মুখ খোলা একটি পাইপ তৈরি করেন যার দুই মুখেই স্টপকর্ক লাগানো আছে। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে এক মহিলার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। মহিলার স্বামীর হাত থেকে সিরিঞ্জের মাধ্যমে ১২০ মিলিলিটারের মতো রক্ত নিয়ে রক্ত সঞ্চালন শুরু করেন তিনি। ১৮২৫-৩০ সালের মাঝে ব্লান্ডেল প্রায় দশজনের দেহে এভাবে রক্ত সঞ্চালন করেন।
দেখা গেলো যে, কিছু ক্ষেত্রে মানুষ মারা যাচ্ছে, আর কিছু ক্ষেত্রে মানুষ সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠছে। এই তো রক্ত সঞ্চালন ব্যবস্থা মানুষের হাতে লেগে গেলো, এবার দিনে দিনে শুধু এর উন্নয়ন চলবে।
মানুষ থেকে মানুষে রক্ত সঞ্চালনে কিছু মানুষ মারা যাচ্ছে, কিছু বেঁচে থাকছে; এই ব্যাপারটি চিকিৎসকদের ভাবিয়ে তুললো। মানুষ তখনো জানতো না ব্লাড গ্রুপিংয়ের কথা।
১৯০১ সালটি ইতিহাসে বিশাল এক ল্যান্ডমার্ক হয়ে আছে। এই সালেই কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার ব্লাড গ্রুপিং আবিষ্কার করলেন; ABO Blood Grouping। ল্যান্ডস্টাইনারের এই অসামান্য আবিষ্কার আজও চিকিৎসাক্ষেত্রে রক্ত সঞ্চালনের একমাত্র নির্ধায়ক। এই ব্লাড গ্রুপিং পদ্ধতিতে তিনি রক্তকে চারটি গ্রুপে বিভক্ত করেন। কীভাবে বিভক্ত করা হয়েছে সেই ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা উল্লেখ করেন তিনি। সেই সাথে শত বছর ধরে চলে আসা প্রশ্ন, মানুষে-মানুষে রক্ত সঞ্চালনে কেন কিছু মারা যাচ্ছে, কিছু বেঁচে থাকছে- এই প্রশ্নটিরও জবাব প্রদান করেন। রক্তের গ্রুপিং সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝতে হলে “রক্তের গ্রুপিং ও রক্ত সঞ্চালন: কী, কেন, কীভাবে‘ এই আর্টিকেলটি পড়ে দেখতে পারেন।
১৯০৭ সালে হেকটোয়েন নামক এক চিকিৎসক প্রস্তাব রাখেন, রক্ত সঞ্চালনের পূর্বে দাতা ও গ্রহীতার রক্ত ক্রস ম্যাচিং করে দেখা যেতে পারে। যদি রক্ত জমাট বেঁধে যায়, তবে এই রক্ত সঞ্চালনে রোগীকে বাঁচানো যাবে না। আর যদি জমাট না বাঁধে, তবে রক্ত সঞ্চালন চলতে পারে। নিউ ইয়র্কের চিকিৎসক রুবেন ওটেনবার্গ তখন প্রথমবারের মতো ক্রস ম্যাচিও ও ব্লাড গ্রুপিং পদ্ধতিকে ব্যবহার করে রক্ত সঞ্চালন সম্পন্ন করেন সফলতার সঙ্গে। যদিও সফলরূপে রক্ত সঞ্চালন করা সম্ভব হচ্ছে, তবে রক্তকে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না, সরাসরি একজনের থেকে অপরজনে সঞ্চালন করতে হচ্ছে। রক্ত বাতাসের সংস্পর্শে এলেই জমাট বেঁধে যায়। সরাসরি সঞ্চালনের ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণ রক্তও সঞ্চালন সম্ভব হচ্ছে না। এ সকল সমস্যার সমাধান করতে পারে একটি অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট, তৎকালীন সময়ে তখনও এই অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট আবিষ্কৃত হয়নি। পরবর্তীতে অনেক অ্যান্টিকোয়াগুলেন্ট আবিষ্কৃত হয়, তন্মধ্যে সোডিয়াম সাইট্রেট বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত।
১৯০৮ সালে এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন ফরাসী ভাস্কুলার সার্জন অ্যালেক্সিস ক্যারেল। ক্যারেলের সমাধানটি বুঝতে হলে আপনাকে বুঝতে হবে ‘অ্যানাস্টোমোসিস’ এর সম্পর্কে। আমাদের শরীরের বেশ কিছু স্থান রয়েছে যেখানে এই অ্যানাস্টোমোসিস দেখা যায়। আর্টারী (ধমনী) আর ভেইন (শিরা) কে বলা হয় ব্লাড ভেসেল, যার মধ্য দিয়ে রক্ত সারা দেহে সঞ্চালিত হয়। শরীরের প্রায় সবখানে দেখা যায় যে, যেকোনো দুটি ভেসেল একে অপরের সাথে যোগাযোগ করছে। এটাই হলো অ্যানাস্টোমোসিস। অ্যানাস্টোমোসিস শরীরের জন্য অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। এই অ্যানাস্টোমোসিস আর্টারী-আর্টারী, ভেইন-ভেইন কিংবা আর্টারী-ভেইনও হতে পারে। শরীরের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এমন এক বা একাধিক অ্যানাস্টোমোসিস রয়েছে, যার দরুন একটি ভেসেল যদি কাজ করতে অক্ষম হয়ে পড়ে, অপর ভেসেলটি অক্ষম হয়ে পড়া ভেসেলের কাজটুকু করে দিতে পারে।
মানুষের হাতে দুটি আর্টারী রয়েছে- রেডিয়াল আর্টারী ও আলনার আর্টারী। যদি কোনো কারণে আপনার দুটো আর্টারীর একটি ছিড়ে যায়, তাহলে অপর আর্টারী আপনার হাতে রক্ত প্রবাহ সচল রাখবে। দুটো আর্টারীর মাঝে অ্যানাস্টোমোসিস রয়েছে কিনা খুব সহজেই সেটা ঘরে বসে আপনি পরীক্ষা করতে পারবেন, পরীক্ষাটির নাম হলো ‘অ্যালান টেস্ট’। যদি কোনো কারণে আপনার হাতে সার্জারী প্রয়োজন হয় তবে চিকিৎসক প্রথমেই অ্যালান টেস্টের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে নেবেন অ্যানাস্টোমোসিস কাজ করছে কিনা।
অ্যালেক্সিস ক্যারেল ভাবলেন, অধিক পরিমাণে রক্ত সঞ্চালনের জন্য কোনো পাইপ কিংবা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করে সরাসরি আর্টারী-ভেইন অ্যানাস্টোমোসিস করে দিলে কেমন হয়। তিনি তার একজন কলিগের নবজাতক শিশুর রক্তস্বল্পতা নিরাময়ে এই পদ্ধতিটি প্রয়োগ করলেন। কলিগের বাম হাতের রেডিয়াল আর্টারীর সাথে নবজাতকের পায়ের গ্রেট সাফিনাস ভেইন যুক্ত করে অ্যানাস্টোমোসিস তৈরি করলেন। নবজাতকের শরীরে এভাবে সরাসরি রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষাটি সফল হলো অবশেষে। সার্জনদের নিকট এই পদ্ধতিতে বিপুলভাবে গৃহীত হলো। ১৯১২ সালে এই পদ্ধতির আবিষ্কারের জন্য অ্যালেক্সিস ক্যারেলকে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হলো।
জেমস ব্লান্ডেল, কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার আর অ্যালেক্সিস ক্যারেল, রক্ত সঞ্চালনের জন্য মোটামুটি কার্যকর একটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এরপর এ পদ্ধতিকে দিনে দিনে পরিবর্ধন-পরিমার্জন করা হয়েছে। Rh Factor তখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার ও আলেক্স্যান্ডার উইনার ১৯৩৭ সালে এই Rh Factor আবিষ্কারের পর রক্ত সঞ্চালন হয়ে উঠে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি পদ্ধতি। এরপর আর কোনো মানুষকে রক্ত সঞ্চালনজনিত জটিলতায় মারা যেতে হয়নি।