![](https://assets.roar.media/assets/SU1N0fIzTbcEJwT3_bbc.jpg?w=1200)
কল্পনা করুন তো, আপনার জীবদ্দশায় একইসাথে আইনস্টাইনকে দেখছেন আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্ম দিয়ে চিরায়ত বিজ্ঞানকে বদলে দিতে, আর সিগমুন্ড ফ্রয়েডকে দেখছেন নতুন নতুন চিন্তা দিয়ে মনোবিজ্ঞানের পত্তন করতে! হ্যাঁ, এ দু’টো ব্যাপার অনেকটা সমান্তরালভাবেই ঘটেছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে, আর তাই বিংশ শতাব্দীর শুরুটা ছিল পশ্চিমা বিজ্ঞানের জন্য এক বৈপ্লবিক সময়। আর এই বৈপ্লবিক সময়কেই তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন আরেক দার্শনিক, আইনস্টাইন আর ফ্রয়েডের বিজ্ঞানপদ্ধতিকে এনেছিলেন দর্শনের দৃষ্টির নিচে। তার ধারণাগুলো, বিশেষ করে ‘সিউডো-সায়েন্স’ এর ধারণা, একবিংশ শতাব্দীতে এসেও রয়েছে ভয়ংকরভাবে প্রাসঙ্গিক।
এই দার্শনিকের নাম কার্ল পপার। ফ্রয়েডের মাতৃভূমি অস্ট্রিয়াতে জন্ম তার। তবে তিনি ক্যারিয়ার গড়ে তুলেছিলেন ইংল্যান্ডে, আইনস্টাইন ফ্রয়েডসহ সেসময়ের সকল বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে। তাদের বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে বুঝতে গিয়ে কার্ল পপার খেয়াল করেছিলেন, সকল বৈজ্ঞানিক অর্জন আসলে সমান নয়। সেখান থেকে তিনি পার্থক্য দাঁড় করিয়েছিলেন প্রকৃত বিজ্ঞান এবং অসম্পূর্ণ বিজ্ঞানের মাঝে, এ দু’টোর নাম দিয়েছিলেন- ‘সায়েন্স’ এবং ‘সিউডো-সায়েন্স’। আর তা করতে গিয়েই তিনি আমাদের জ্ঞানার্জনের প্রকৃতি সম্পর্কে শিখিয়েছিলেন অনেক কিছু, দেখিয়েছিলেন কীভাবে আমরা আমাদের ধারণাগুলোকে, তত্ত্বগুলোকে পরীক্ষা করতে পারি, চ্যালেঞ্জ করতে পারি- আর নিয়ে যেতে পারি সত্যের কাছাকাছি।
![](https://assets.roar.media/assets/fc8TtVEvZlry0UD6_science-vs-pseudoscience.jpg)
ইতিহাসের প্রায় একই সময়ে উদ্ভূত হয়ে, ফ্রয়েড এবং আইনস্টাইন দু’জনই পৃথিবী সম্পর্কে, আমাদের জগত সম্পর্কে বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ফ্রয়েডের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল ব্যক্তিকে নিয়ে, তিনি বলেছিলেন প্রতিটি মানুষের শৈশবই তার ভবিষ্যতের ব্যক্তিত্বকে গড়ে তুলবে। আর আইনস্টাইনের ক্ষেত্র ছিল বস্তুজগত, তার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আলোর প্রকৃতিকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল, যা প্রমাণ হতো ১৯১৯ সালের একটি সূর্যগ্রহণের মাধ্যমে।
আর ঠিক সেসময়েই ১৯০২ সালে জন্ম নেয়া কার্ল পপার এই ভবিষ্যদ্বাণীগুলোকে প্রবল আকর্ষণ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন। অনেক অল্প বয়স থেকেই তিনি ফ্রয়েডের সাইকোঅ্যানালিটিক্সের তত্ত্বগুলো নিয়ে পড়তে লাগলেন, আইনস্টাইনের মহাবিশ্ব নিয়ে দেয়া লেকচারগুলোতে ছিল তার নিয়মিত উপস্থিতি। আর তখনই তার চোখে পড়লো, এই শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদদের চিন্তার ধরনটা আসলে বেশ আলাদা।
![](https://assets.roar.media/assets/HaGEshAWaovfadKL_thumb-1920-503059.jpg)
উদাহরণস্বরূপ, পপার দেখলেন ফ্রয়েড অতীত দিয়ে বর্তমানকে ব্যাখ্যা করেন। এ কারণে তিনি যেকোনো তথ্যকেই নিয়ে নিজের তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। যেকোনো মানুষের ‘ইন্টিমেসি ইস্যু’কে ছোটবেলায় বেশি আদর পাওয়া, বা আদর না পাওয়া দু’টো ব্যাপার দিয়েই ব্যাখ্যা করা যায়। নারীর আচরণকে মনমতো ব্যাখ্যা করা যায় তার কল্পিত ধারনা ‘পিনাস এনভি’র দ্বারা।
অর্থাৎ তিনি দেখলেন, ফ্রয়েডের তত্ত্বগুলোর জন্য প্রামাণিক তথ্য ছড়িয়ে আছে সবখানে!
![](https://assets.roar.media/assets/sZANV2ezTfaGVIIP_freud.jpg)
অথচ আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণীর প্রকৃতি কিন্তু ঠিক এরকম ছিল না। তিনি অতীত দিয়ে বর্তমানকে ব্যাখ্যা করতেন না, বর্তমান দিয়ে ব্যাখ্যা করতেন সম্ভাব্য ভবিষ্যতকে। পপার দেখলেন, আইনস্টাইনের এই পদ্ধতি আসলে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। যদি ভবিষ্যত আইনস্টাইনের ভবিষ্যদ্বাণীর সাথে না মেলে, আইনস্টাইনের তত্ত্ব ঠিক তখনই ভুল প্রমাণ হয়ে যাবে। যদি ১৯১৯ সালের সূর্যগ্রহণের ঘটনাটি অন্যভাবে হতো, তবে কিন্তু সেখানেই ভুল প্রমাণ হয়ে যেত আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা!
অথচ ফ্রয়েড কিন্তু চাইলেই অতীতকে একটু অন্যভাবে দেখে, কিছু তথ্য নিয়ে কিছু তত্ত্ব উপেক্ষা করে, দাঁড় করিয়ে রাখতে পারতেন তার তত্ত্বকে, সেটা করতে তার একটুও বেগ পেতে হতো না।
আর তখনই পপার বুঝে ফেললেন, আইনস্টাইন আর ফ্রয়েডের বিজ্ঞানের মাঝে মূল পার্থক্যটা কোনখানে। সেখান থেকেই বললেন, আইনস্টাইনের বিজ্ঞান হচ্ছে সায়েন্স, আর ফ্রয়েডেরটা সিউডো-সায়েন্স।
তবে এখানে একটা কথা বলে নেয়া ভালো। বর্তমানে মনোবিজ্ঞান আসলে মূলধারার বিজ্ঞান কিনা, তা নিয়ে অনেক যুক্তিতর্ক হয় সত্য, কিন্তু মনোবিজ্ঞানকে সিউডো-সায়েন্স কিন্তু কেউই এখন বলেন না। কিন্তু আজ থেকে একশ বছর আগে মনোবিজ্ঞান অনেক পিছিয়ে ছিল, সেইসাথে পিছিয়ে ছিল বিজ্ঞানের সংজ্ঞাও। ফ্রয়েড মনোবিজ্ঞানের ভিত গড়ে দিয়েছেন সত্যিই, কিন্তু তার তত্ত্বের বেশিরভাগই এখন গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে বুদ্ধিজীবীদের মহলে। তাই পপারের টানা উপসংহারগুলোকে তখনকার ছাঁচেই দেখতে হবে, বর্তমানের চশমা দিয়ে নয়।
বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চিরাচরিত যে ধারণা, তার শুরু হয়েছে প্রাচীন গ্রিসে। এই ধারণা বলে যে, বৈজ্ঞানিক চোখে পৃথিবীর কোনো ঘটনাকে পর্যবেক্ষণ করতে হলে, সে ঘটনাকে দেখতে হবে কোনো পূর্বকল্পিত ধারণা বা মতবাদ ছাড়া। দেখব, যা দেখছি তা উপলব্ধির চেষ্টা করব, তারপর সে অনুযায়ী আমরা তৈরি করব সেই ঘটনাটিকে ব্যাখ্যা করবার নিজস্ব অনুকল্প। যেমন একটি কাক দেখলাম, দেখলাম সেই কাকটির রঙ কালো। তারপর আরো কয়েকটি কাক দেখলাম, দেখলাম সবগুলোই কালো। এভাবে দেখতে দেখতে আমরা একসময় সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাব, যে কাকের রঙ কালো।
ফ্রয়েডও এই কাজটাই করছিলেন। তবে কাক আর কাকের রঙের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন না করে, তিনি করছিলেন মানুষের জীবনের ঘটনা আর তার আচরণগুলোর মধ্যে।
কিন্তু পপার বললেন, গ্রিকদের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রধান যে শর্ত- কোনো পূর্বকল্পিত ধারণা বা মতবাদ নিয়ে কোনোকিছুর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ করা যাবে না, এটা আসলে মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা আসলে যা দেখতে চাই, তা-ই দেখি। কোনোকিছু পর্যবেক্ষণ করার মূল কারণই থাকে আমাদের সে বস্তুটি সম্পর্কে নিজস্ব ধারণার সত্যতা নিশ্চিত করা। কাকের রঙের মত সোজাসাপ্টা ব্যাপারে হয়তো নিজস্ব ধারণা প্রভাব ফেলে না, কিন্ত প্রকৃতির বা মানুষের আচরণের কার্যকারণ বের করার ক্ষেত্রে এ ব্যাপারটি প্রভাব ফেলতে পারে বিস্তর।
তাহলে এ ব্যাপারটি ফ্রয়েড সম্পর্কে আমাদের কী জানান দেয়?
পপার বললেন, ফ্রয়েডের কার্যপদ্ধতি আসলে নিজস্ব ধারণাকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এই পদ্ধতি দিয়ে আসলে যেকোনোকিছুই প্রমাণ করে দেয়া যায়।
এটাই ছিল সায়েন্স আর সিউডোসায়েন্সকে আলাদা করায় পপারের মূল চাবিকাঠি। সায়েন্স কোনোকিছুকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে, আর সিউডোসায়েন্স সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা করে। এ ধারণার উপর ভিত্তি করে জ্ঞান এবং বিজ্ঞানের সম্পর্কে কিছু স্পষ্ট উপসংহারে টেনেছেন, যেগুলো পরবর্তী বিজ্ঞানীদের চিন্তাধারায় বিস্তর প্রভাব ফেলেছে।
প্রথমত তিনি বলেছেন, যেকোনো তত্ত্বকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য তথ্য উপাত্ত বের করা বেশ সহজ।
যেমন আগে গ্রামের মানুষেরা কলেরা হলে বলত ‘ওলা বিবি’ নামক কোনো অশুভ ডাইনীর আক্রমণ এটি। এই ওলাবিবির সত্যতা প্রমাণের উপাত্ত সবখানেই ছড়িয়ে আছে, চাইলেই বলা যায় অশুভ ডাইনী ঘর থেকে ঘরে গিয়ে খারাপ জাদু করছে। তারপর কলেরার সব বৈশিষ্ট্যকেই এ তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করে দেয়া যায়।
কিন্তু আমরা যদি এটাকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করি, এ তত্ত্ব তখন আর এক মিনিটও টিকবে না। অথচ কলেরা একটি ব্যাকটেরিয়া বাহিত রোগ- একথা ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা যতই করি, ব্যর্থ হব। তাই কোনোকিছুর সঠিকত্ব ততটাই গ্রহণযোগ্য হবে, যতটা একে ভুল প্রমাণ করা কঠিন হবে। সঠিক প্রমাণ করা কতটা সহজ, সেটা এখানে একদমই দেখার বিষয় নয়।
ব্যাপারটা অনেকটাই অদ্ভুত শোনায়। কারণ কে আবার নিজেকে ভুল প্রমাণ করতে চাইবে! কিন্তু পপার বললেন, যত বেশি আমরা নিজেরা ভুল প্রমাণিত হবো, ততই আমরা সত্যিকারের জ্ঞানের দিকে এগিয়ে যাব। নিজেদের ভুল প্রমাণ করাই আসলে সত্যিকারের বিজ্ঞানচর্চা।
আধুনিক বিজ্ঞান আসলে এ মানসিকতা দিয়েই আধুনিক হয়েছে। বর্তমানের কোয়ান্টাম ফিজিক্স বা এভোল্যুশনারি বায়োলজি এ চিন্তাপদ্ধতিরই ফসল। আইনস্টাইন নিউটনের ফিজিক্সকে ভুল প্রমাণ করতে গিয়েই জন্ম দিয়েছেন আপেক্ষিকতার। বিজ্ঞানের শক্তি সম্পর্কে চিরায়ত ধারণাকে ভুল প্রমাণ করতে গিয়েই জন্ম হয়েছে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের।
তাই দেখা যাচ্ছে, একটি তত্ত্বের সত্যিকারের সঠিকত্ব পরীক্ষা হচ্ছে একে ভুল প্রমাণ করবার পরীক্ষা। এ কারণে পপার বলেছিলেন, যে তত্ত্বকে কোনো পরীক্ষায় ফেলা যায় না, সে তত্ত্ব আসলে বৈজ্ঞানিক নয়।
![](https://assets.roar.media/assets/lQTIpsm9JpvfVTpl_Astrology-Wallpaper-Free-Download-620x451.jpg)
এ কারণে রাশিফল, হাত দেখা, ভাগ্য গণনা- সবই আসলে সিউডোসায়েন্সের চর্চা। আমরা যখন সপ্তাহের রাশিফলের সাথে জীবন মেলানোর চেষ্টা করে সিউডোসায়েন্সের চর্চা করছি, তখনই যদি আমরা তা না করে এই রাশিফলগুলোকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করি- তখন আমরা দেখব এ রাশিফলগুলো সত্যিকার অর্থেই ভুল। কোনো অশরীরী বা অতিপ্রাকৃত ব্যাপারেও আমাদের একই পথে আগানো উচিৎ, আগেই বিশ্বাস না করে করা উচিত অবিশ্বাসের চেষ্টা। তখনই দেখা যাবে এই অশরীরীর আসলে কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এভাবে আমাদের জীবনপদ্ধতি হবে আরেকটু বেশি বিজ্ঞানসম্মত, আমরা থাকতে পারব সত্যের আরেকটু কাছাকাছি।
ফিচার ইমেজ- bbc.co.uk