প্রকৃতিতে সমস্ত নির্জীব প্রাণিদের সাথে বিবেচনায় মৌমাছিদের জীবনব্যবস্থা অনেকটাই উন্নত। তাদের জীবনচক্রে রয়েছে সুষ্ঠু সমাজতন্ত্র, রাজতন্ত্র, নির্দিষ্ট আচার-ব্যবহার, বাচনভঙ্গি, গোত্রভেদ। এই রাজতন্ত্রে প্রজা মৌমাছিদের বিদ্রোহও সংঘটিত হতে দেখা যায়। পরস্পরের সাথে যোগাযোগের জন্য রয়েছে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের এক মাধ্যম। তবে সবথেকে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, মৌমাছিদের কলোনীতে অবস্থানরত একমাত্র উর্বর মৌমাছি; একটি রানী মৌমাছি, এটি তার উত্তরসূরীদের গোত্র নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ডিম পাড়ার পূর্বেই রানী মৌমাছিটি নিয়ন্ত্রণ করে যে, ডিম ফুটে একটি পূর্ণাঙ্গ মৌমাছি কোন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত হবে। পরোক্ষভাবে কর্মী মৌমাছিদেরও খানিক ভূমিকা রয়েছে এতে। কারণ, সকল গোত্রের মাঝে সুষ্ঠু অনুপাত বজায় রাখার দায়িত্বটা কেবলমাত্র কর্মী মৌমাছিদের।
মৌমাছিদের মাঝে রয়েছে নির্ধারিত জাতভেদ। কিছু মৌমাছি জন্মসূত্রেই রানী মৌমাছি, কিছু রয়েছে ড্রোন আর কিছু হলো কর্মী মৌমাছি। তাদের সবার পূর্ণতা প্রাপ্তির সময়সীমাও ভিন্ন; ড্রোনদের জন্য বরাদ্দ ২৪ দিন, কর্মীদের ২১ দিন আর রানী মৌমাছিটির জন্য ১৬ দিন।
সকল পতঙ্গ অর্থাৎ পোকা-মাকড় শ্রেণির প্রাণিদের মতো মৌমাছির জীবদ্দশাতেও রয়েছে চারটি পর্যায় বা ধাপ। এই চারটি ধাপ পেরিয়েই একটি মৌমাছি পূর্ণাঙ্গতা পেয়ে থাকে। ডিম, লার্ভা, পিউপা আর পূর্ণাঙ্গ মৌমাছি।
একটি মৌমাছির জীবনচক্র শুরু হয় তার ডিম দিয়ে। ডিমগুলো দেখতে একটি ছোট আকৃতির চালের দানার মতো। একমাত্র রানী মৌমাছিই একটি মৌ-কলোনীতে ডিম পাড়তে সক্ষম। সেই ডিম সময়ের সাথে বেড়ে উঠে একসময় পূর্ণাঙ্গ মৌমাছিতে রূপ নেয়।
রানী মৌমাছি তার মৌচাকের প্রতিটি খোপের ভেতর একটি করে ডিম পাড়ে, এই খোপের ভেতর ডিমগুলো বেড়ে ওঠে। এখানেও রয়েছে আরো রহস্য, ডিম ধারণের উপযুক্ত করে খোপটিকে প্রস্তুত করার দায়িত্বে রয়েছে সকল কাজের কাজী কর্মী মৌমাছিরা। খোপটিতে যদি বিন্দু পরিমাণ ময়লা থাকে, সেখানে রানী মৌমাছি ডিম পাড়বে না। অর্থাৎ, রানী মৌমাছিটি নিজের ইচ্ছামতো খোপ বাছাই করে ডিম পেড়ে থাকে।
রানী মৌমাছিটি অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের খোপগুলোতে নিষিক্ত ডিম এবং অপেক্ষাকৃত বড় আকারের খোপগুলোতে অনিষিক্ত ডিম পাড়ে। নিষিক্ত ডিমগুলো থেকে লার্ভা বেরিয়ে বড় হয়ে কর্মী মৌমাছি হবে এবং অনিষিক্ত ডিমগুলো থেকে লার্ভা বেরিয়ে বড় হয়ে হবে ড্রোন অর্থাৎ পুরুষ মৌমাছি। ডিমকে নিষিক্ত করার জন্য রানী মৌমাছি মৌচাকে থাকা পূর্ণাঙ্গ ড্রোনদের সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। কর্মী মৌমাছিরা লিঙ্গ বিচারে স্ত্রীলিঙ্গ, কিন্তু এরা বন্ধ্যা প্রকৃতির, ডিম পাড়তে অক্ষম।
মৌচাক তৈরির সময়েই কর্মী মৌমাছিরা এই খোপের আকার কেমন হবে, তা নির্ধারিত করে ফেলে। কর্মী মৌমাছির দায়িত্ব যেহেতু অনেক, সেসব দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে নিবারণ করতেও অধিক সংখ্যক কর্মী মৌমাছির প্রয়োজন হয়। কর্মী মৌমাছি এবং ড্রোনসংখ্যার মাঝে নির্দিষ্ট অনুপাত বজায় রাখার কাজটি করে থাকে কর্মীরাই।
ডিম পাড়ার তিনদিনের মাঝে ডিম ফেটে বেরিয়ে আসে লার্ভা। লার্ভাগুলো খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে, এই সময়ে তাদের ত্বক মোট পাঁচবার মোচিত হয়। এত দ্রুত বেড়ে উঠতে গিয়ে খাদ্য গ্রহণের পরিমাণও বেড়ে যায়।
একটি রানী মৌমাছির জীবনের প্রায় পুরোটা সময়ই কাটে ড্রোনদের মাধ্যমে ডিমকে নিষিক্ত করে এবং মৌচাকে ডিম পাড়ে। দৈনিক প্রায় ২০০০টির মতো ডিম পাড়তে সক্ষম একটি রানী মৌমাছি। ডিম পাড়ার পূর্বেই এটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, কোনগুলোকে নিষিক্ত করবে আর কোনগুলোকে অনিষিক্তই রেখে দেবে।
মৌচাকের ছোট ছোট খোপের ভেতর একটা সময়ে ডিম ফুটে বেরিয়ে আসে লার্ভা। লার্ভা হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর তিনদিন পর্যন্ত তিন গোত্রের সব লার্ভাকেই রাজকীয় জেলি খাওয়ানো হয়। সাধারণত কর্মী ও ড্রোনদের জন্য মৌচাকে বরাদ্দ খাবার হলো মৌরুটি, কিন্তু লার্ভা অবস্থায় প্রথম তিনদিন সবাই রাজকীয় জেলি পেয়ে দ্রুত বেড়ে ওঠে। এই তিনদিন পার হবার পর লার্ভাদেরকে রাজকীয় জেলি খাওয়ানো বন্ধ করা হয়, মৌচাকে অবস্থানকারী কর্মীরা তখন কেবল মাত্র যে লার্ভাটি রানী মৌমাছিতে পরিণত হবে, তার জন্য রাজকীয় জেলির ব্যবস্থা করে।
আপাতদৃষ্টিতে এটি মনে হয়ে থাকতে পারে যে, এই রাজকীয় জেলি খাওয়ানোর ফলেই একটি লার্ভা, রানী মৌমাছি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। ব্যাপারটি তা নয়, জেলিতে এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থের উপস্থিতি রয়েছে, যার কারণে, রানী মৌমাছিটির সর্বপ্রকার হুকুম তামিল করা কর্মী স্বভাব অবদমিত থাকে, সবাইকে হুকুম করে মৌচাক পরিচালনা করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। লার্ভার বয়স তিনদিন পার হবার পরও যদি তাকে রাজকীয় জেলি খাওয়ানো হয়, তবে ধরে নিতে হবে যে এটি একসময় রানী হিসেবেই মৌচাকে আত্মপ্রকাশ করবে।
লার্ভা পর্যায় শেষে একটি মৌমাছি তার জীবনচক্রের তৃতীয় পর্যায়ে প্রবেশ করে; পিউপা। পিউপা অবস্থায় মৌমাছির মোটামুটি একটি আকৃতি তৈরি হয়, অবয়ব দেখে বোঝা যায়, পূর্ণাঙ্গ মৌমাছিটি কেমন হবে। কিন্তু পিউপা দশায় পা রাখার পূর্বেই, মৌচাকের সব কর্মী মৌমাছি লার্ভাদের সবগুলো খোপে মোমের তৈরি স্বচ্ছ একটি আবরণে ঢেকে দেয়, যাতে পূর্ণাঙ্গ হবার আগ পর্যন্ত সেখান থেকে না বেরোতে পারে।
পিউপা দশাতেই চোখ, ডানা, পা, গায়ের লোম সবকিছু তৈরি হতে শুরু করে। পিউপা দশায় শুরু হওয়া দেহগঠন যখন পূর্ণতা পায়, একটি মৌমাছির অঙ্গগুলো ভালোমতো সুগঠিত হয়ে উঠে, তখন এই পূর্ণাঙ্গ মৌমাছিটি তার খোপের উপর লাগানো মোমের আবরণটি ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। খোপ খালি হয়ে গেলেই কর্মী মৌমাছিরা খোপটিকে পরিষ্কার করতে নামে।
একটি মৌচাকে মৌমাছিদের জীবনব্যবস্থাকে একটি মনুষ্য রাজতন্ত্রের সাথে তুলনা করা যায়। এখানে প্রয়োজন অনুসারে প্রজাদের বিদ্রোহও সংঘটিত হয়। একাধিক রানী যদি মৌচাকে বড় হতে থাকে, তবে সবার আগে যেটি পূর্ণাঙ্গ হবে, সেটি অন্যগুলোকে মেরে ফেলে নিজে রানী হবার আশায়।
রানীর যদি জীবনসংশয়ের ভয় থাকে, কর্মী মৌমাছিরা নিজেদের জীবন বিলিয়ে হলেও তাকে রক্ষা করবে। এর উদাহরণ মেলে শীতকালে, রানীর যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য তাকে কর্মীরা ঘিরে ধরে একটা উষ্ণ আবরণের মতো তৈরি করে রাখে। একটি মৌচাকে রানী মৌমাছি হলো প্রজননযন্ত্র, কেননা এটিই একমাত্র ডিম পাড়তে সক্ষম উর্বর মৌমাছি। সাধারণত একটি রানী মৌমাছি সাত বছরের মতো বাঁচতে পারে, তবে কর্মীরা যদি প্রয়োজন মনে করে, রানীকে মেরে নতুন রানী নিয়োগ দিতে পারে। রানী মৌমাছি যদি ডিম পাড়তে অক্ষম হয়, কিংবা ডিম পাড়ার পরিমাণ কমে আসে, সবকিছু বিবেচনাতে রেখেই কর্মীরা রানীকে প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।
কর্মী মৌমাছিদের জীবনকাল নির্ভর করে তাদের কাজের উপর। বছরের কোন সময়ে তাদের জন্ম হয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে কাজ নির্ধারিত হয়। যেমন শীতের শুরুতে যদি কোনো কর্মীর জন্ম হয়, তার দায়িত্ব হবে ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে রানীকে রক্ষা করা। এরা শীতের সময়টুকুকে পার করে প্রায় পাঁচমাসের মতো বেঁচে থাকতে সক্ষম। গ্রীষ্মকালের মৌমাছিদের আয়ু সবথেকে কম, প্রখর রৌদ্রতাপে কাজ করতে হয় তাদেরকে, ফলে আয়ু হয় ৬ সপ্তাহের মতো।
একটি মৌচাকে ড্রোনদের কাজ কেবল একটি, রানী মৌমাছি যেমন মৌচাকের প্রজননযন্ত্র, তেমনি ভাবে, ড্রোনদের কাজ হলো যৌনকর্মের মাধ্যমে রানীর ডিমকে নিষিক্ত করা। ড্রোনদের মস্তিষ্ক জুড়ে এই একটিই চিন্তা থাকে, কীভাবে রানীর সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়া যায়। যদি কোনো ড্রোন, রানী মৌমাছির সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হয়, রানী থেকে আলাদা হবার সঙ্গে সঙ্গে সেটির মৃত্যু অনিবার্য। এমনিতে যৌনকর্ম ব্যতীত একটি ড্রোন স্বাভাবিক অবস্থায় ৫-৭ সপ্তাহের মতো বাঁচে।
আমাদের দেশে মৌমাছি পালনের চিত্র খুব কম, তেমন একটা দেখা যায় না। ব্যক্তিগত শখে কিংবা ব্যবসার উদ্দেশ্যে মৌমাছি পালন খুব উপকার বয়ে আনতে পারে। ঝুঁকি আছে কিছু, আবার ভালো দিকগুলোও কম নয়। সবথেকে বড় উপকারটি হলো মধুতে, মধু স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী, কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে খুচরো বাজারগুলো নকল মধুর দখলে। আর আসল মধুর আশায় এক দল জীবের বাসস্থান কেড়ে নেয়া হয়, এটিও মেনে নেয়া যায় না, তার চেয়ে বরং মৌমাছি চাষ করাটাই উপযুক্ত। মৌমাছিরাও নিজেদের জীবনধারণের সুযোগ পাবে, আর আমরাও আমাদের প্রয়োজনীয় উপকারী আসল মধু পেয়ে যাবো।