এ বছরের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কার নিয়ে কথা বলার আগে পদার্থবিদ্যায় আমরা ফিজিক্যাল সিস্টেম বলতে কী বুঝি সেটা একটু পরিষ্কার হওয়া দরকার। সহজ ভাষায় ফিজিক্যাল সিস্টেম হলো সে জিনিস যেটাকে আমরা পদার্থবিদ্যার সূত্রাবলী দিয়ে বিশ্লেষণ করতে পারি। যেমন একটা পরমাণুর ভেতরে ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন আছে- এগুলো মিলে এটা একটা ফিজিক্যাল সিস্টেম। আবার একটা পুকুরে পানি, মাছ ও অন্যান্য জিনিস আছে- এসব মিলে পুকুরটাও একটা ফিজিক্যাল সিস্টেম। ফিজিক্যাল সিস্টেমের আশেপাশে যা থাকে তাকে বলা হয় এনভায়রনমেন্ট। ফিজিক্যাল সিস্টেম কখনো কখনো অল্প কয়েকটা উপাদান বা কম্পোনেন্ট দ্বারা প্রভাবিত হয় আবার কখনো কখনো অনেকগুলো কম্পোনেন্টের উপর নির্ভর করে এর বৈশিষ্ট্য। অনেকগুলো কম্পোনেন্ট নির্ভর সিস্টেমগুলোকে জটিল বা কমপ্লেক্স ফিজিক্যাল সিস্টেম বলা যেতে পারে।
এ বছরের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে মূলত কমপ্লেক্স ফিজিক্যাল সিস্টেম ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী গবেষণার জন্য (For groundbreaking contributions to our understanding of complex physical systems)। যে দুটি কমপ্লেক্স সিস্টেম নিয়ে কাজ করার জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে তার একটি হলো পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বা জলবায়ু আর অন্যটি হলো একটি বিশেষ ধরনের যৌগের বিশেষ অবস্থার (স্পিন গ্লাস) গঠনশৈলী বা গতিপ্রকৃতি।
জাপানি বায়ুমণ্ডলীয় পদার্থবিদ স্যুকুরো মানাবে ও জার্মান সমুদ্রবিদ ক্লস হ্যাসেলমান নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন পৃথিবীর জলবায়ুর গতিপ্রকৃতি এবং তা মানুষের কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হয় কিনা তা নিয়ে গবেষণার জন্য। মানাবে আর হ্যাসেলমানের কাজ থেকে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে জলবায়ুর পরিবর্তন অবশ্যই সত্য এবং এতে শুধু প্রাকৃতিক কারণ আছে তা-ই নয়, আমাদেরও কর্মকাণ্ডেরও অনেক দায় আছে।
পৃথিবীতে প্রাণ প্রাচুর্যের অন্যতম কারণ এর বায়ুমণ্ডল। বায়ুমণ্ডলের গ্রিন হাউজ ইফেক্টের প্রভাবে সূর্য থেকে ভূ-পৃষ্ঠের শোষিত তাপ পৃথিবীর বাইরে চলে যায় না। ফলে পৃথিবী উষ্ণ থাকে। কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইডের অধিক উপস্থিতি এই উষ্ণ রাখার প্রক্রিয়াটিকে স্বাভাবিকতার বাইরে নিয়ে যেতে সক্ষম। এই ব্যাপারটা প্রথম পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ১৯০১ সালের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সাভান্তে আরহেনিয়াস। তিনি পৃথিবীতে বরফ যুগ বা আইস এইজ কেন ঘটেছিল তা নিয়ে কাজ করছিলেন। তিনি এখানে কার্বন ডাই-অক্সাইডের একটা যোগসূত্র খুঁজে পান। তিনি দেখাতে সক্ষম হন যে, তার সময়ে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের যে পরিমাণ ছিল তার পরিমাণ যদি কখনো অর্ধেকে নেমে যায় তাহলে আবার বরফ যুগ শুরু হবে। আবার কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যদি দ্বিগুণ হয়ে যায় তাহলে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ৫-৬ ডিগ্রি বেড়ে যেতে পারে।
স্যুকুরো মানাবে আরহেনিয়াসের মতোই কার্বন ডাই-অক্সাইডের জলবায়ুতে প্রভাব কেমন রাখতে পারে তা নিয়ে কাজ করেছেন। তবে তাদের কাজের ধরন ছিল ভিন্ন। আরহেনিয়াসের সময় কম্পিউটার ছিল না, সেজন্য তিনি সোলার রেডিয়েশন বা সৌর বিকিরণের শোষণ ও পরে আবার পৃথিবী থেকে শোষিত তাপের নির্গমনের পরিমাণ থেকে তার ফলাফলটাকে প্রকাশ করেছিলেন। আর মানাবে তার গবেষণার মাধ্যমে একটি মডেল প্রস্তাব করেন। এ মডেলে স্থান পায় সংবহন পদ্ধতিতে ভূপৃষ্ঠের নিকট থেকে উপরের দিকে উঠা উষ্ণ বাতাস ও তার সাথে বহন করা জলীয় বাষ্পের সুপ্ততাপ। যত উষ্ণ বাতাস তত বেশি জলীয় বাষ্প।
স্যুকুরো মানাবের মডেলটি ছিল সরল প্রকৃতির, একমাত্রিক। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত এই মডেলে তিনি বিভিন্ন গ্রিনহাউজ গ্যাসের বিভিন্ন পরিমাণ (কনসেন্ট্রেশন)-এর জন্য পৃথিবীর তাপমাত্রার পরিবর্তন কেমন হবে তা দেখাতে সক্ষম হন। তিনি দেখান, বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন আর অক্সিজেনের পরিমাণ পরিবর্তনে পৃথিবীর তাপমাত্রার বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন হয় না কিন্তু কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধির সাথে পৃথিবীর তাপমাত্রা হ্রাস-বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব বিদ্যমান। তার মডেলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণের তারতম্য ঘটিয়ে এই সিদ্ধান্তে আসেন যে, কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়বে অন্তত দুই ডিগ্রি।
১৯৮০ সালের দিকে এক বিশেষ মডেলের প্রস্তাবের মাধ্যমে ক্লস হ্যাসেলমান দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুর পরিবর্তন কেমন হবে তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি মূলত কাজ করতেন সমুদ্র ও জলোচ্ছ্বাস নিয়ে। পরে তিনি জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও কাজ শুরু করেন। তার মডেলে পরিবেশের কোনো একটি উপাদানের সামান্য পরিবর্তন দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ুকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা গুরুত্বের সাথে উপস্থাপন করেন। যেমন আমাদের বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তন কীভাবে আমাদের সমুদ্রগুলোকে প্রভাবিত করবে সেটা তিনি দেখাতে সক্ষম হন। তার কাজের অন্যতম অনুপ্রেরণা ছিল আইনস্টাইনের দেওয়া ব্রাউনিয়ান মোশন।
মডেল প্রস্তাবের পর তিনি কাজ শুরু করেন জলবায়ু পরিবর্তনে মানবসৃষ্ট কোনো কারণ আছে কিনা তা যাচাইয়ে। আর সেটি করেন এ মডেল দিয়েই। তিনি দেখতে পান, কোনো ঘটনা যেমন আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত বা সৌর বিকিরণের তারতম্য থেকে সৃষ্ট প্রাকৃতিক পরিবর্তন একটা সুস্পষ্ট ছাপ বা চিহ্ন রেখে যায়। তেমনই মানুষের কর্মকাণ্ডের দ্বারা যদি কোনো পরিবর্তন আসে তাহলে সেটারও একটা চিহ্ন বা প্রমাণ রয়ে যাবে। সেটাই খুঁজে পাবার বিভিন্ন পদ্ধতির সূচনা করেছেন, পরবর্তীতে নানা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে যেগুলোর সত্যতা পাওয়া গেছে।
তার কাজ থেকে এটা প্রমাণ করা গেছে যে মানুষেরও জলবায়ু পরিবর্তনে হাত আছে। নিচের ছবিটা খেয়াল করুন। শুধুমাত্র প্রাকৃতিক কারণ বিবেচনা করলে পৃথিবীর তাপমাত্রার পরিবর্তন হতো একরকম। কিন্তু প্রাকৃতিক ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণ দুটোই ধরলে তাপমাত্রার পরিবর্তন যা হয় সেটা আমাদের পর্যবেক্ষণ করা তথ্যকে সমর্থন করে। অর্থাৎ মানুষ জলবায়ু পরিবর্তনে তার দায় এড়াতে পারে না।
এবার ইতালিয়ান তত্ত্বীয় পদার্থবিদ জর্জো প্যারিসির কথায় আসি। তিনি নোবেল পেয়েছেন বায়ুমণ্ডলের মতোই জটিল সিস্টেমের গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদানের কারণে। তবে তার কাজের জগতটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মতো বিশাল নয়। তার জগতটা একেবারে আণুবীক্ষণিক। যে কাজের জন্য তিনি নোবেল পেয়েছেন সেটা বেশ জটিল একটি বিষয়। আমরা জানি সব চুম্বকেই ম্যাগনেটিক স্পিনের দিক একই হবে, কিন্তু স্পিন গ্লাস অবস্থায় ব্যাপারটা এরকম হয় না। স্পিন গ্লাসের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ সিস্টেম জন্ম নেয়, যাকে বলা হয় ফ্রাসটেটেড সিস্টেম।
এই সিস্টেমে সবগুলো স্পিন একই অভিমুখে থাকে না। এই বিষয়টাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন বিজ্ঞানীরা। একটি পদ্ধতির নাম রেপ্লিকা ট্রিক। এই ট্রিক প্রথমদিকে অত বেশি কার্যকর ছিল না ফ্রাসট্রেটেড সিস্টেম ব্যাখ্যায়। প্যারিসি এই রেপ্লিকা ট্রিককে কাজে লাগিয়েই স্পিন গ্লাসের সিস্টেমের গ্রহণযোগ্য গাণিতিক সমাধান বের করার প্রক্রিয়ার সূচনা করেন। তার এই গবেষণাকর্ম পদার্থবিদ্যার পাশাপাশি বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখা যেমন জীববিজ্ঞান, নিউরোসায়েন্স, মেশিন লার্নিং ইত্যাদিকেও প্রভাবিত করেছে।
মানাবে এবং হ্যাসেলমানের নোবেল প্রাপ্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় এবং এটায় নোবেল যাওয়াটায় এই বিষয়টায় অন্তত কিছুদিনের জন্য হলেও অনেক কথা বার্তা হবে, আলোচনা হবে, হয়তো এটা আগে যত গুরুত্ব পেত তার চেয়ে বেশি হয়তো পাবে। আমরা আশা করতে পারে এটা এখন শিল্পোন্নত দেশগুলোর সরকার প্রধানদেরকেও ছুঁয়ে যাবে, তারা হয়তো ভাববেন আর কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।