‘পলিয়ানা’ আর ‘প্যারানয়া’ শব্দ দুটি পরস্পর বিপরীতার্থক। যেসব ব্যক্তি অতিমাত্রায় আশাবাদী, তাদেরকে বলা হয় পলিয়ানা। আশেপাশে যা-ই ঘটুক না কেন, এর মাঝে ইতিবাচক কিছু না কিছু খুঁজে নেয়া হলো তাদের স্বভাব। অন্যদিকে এর উল্টো পিঠে অবস্থান করে প্যারানয়া। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সবকিছুতেই নেতিবাচক কোনো কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পায়। এই নেতিবাচকতার মাত্রা বেশি হলে কেউ কেউ মানসিকভাবে অসুস্থও হয়ে যায়। প্যারানয়েড কোনো ব্যক্তির নেতিবাচকতা কেমন, তার সামান্য পরিচয় দিয়ে বাংলা ব্লগ-ফেসবুক জগতে ভাইরাল হওয়া একটি উদাহরণ তুলে ধরছি-
যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এক সৈনিক পালিয়ে চলে আসলো। সবাই বলতে লাগলো- শেষ পর্যন্ত তুমি তাহলে ভয়ে কাপুরুষের মতো পালিয়ে চলে এলে?
সৈনিকের উত্তর: ঠিক তা নয়, আমার যুক্তি শুনলেই তোমরা তা বুঝতে পারবে। যুদ্ধক্ষেত্রে দু’ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। যুদ্ধে আমি শত্রুকে মারব, নয়তো শত্রু আমাকে মারবে। আমি শত্রুকে মারলে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু শত্রু আমাকে মারলে, আবারও দু’ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। আমি হয় আহত হবো, নতুবা নিহত হবো। আহত হলে সমস্যা নেই। কিন্তু নিহত হলে দু’ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। ওরা হয়তো আমাকে জ্বালিয়ে দেবে, নয়তো কবর দেবে। জ্বালিয়ে দিলে সমস্যা নেই। কিন্তু কবর দিলে আবারও দু’ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। হয় আমার কবরের উপর বড় বড় গাছ জন্মাবে, নয়তো ঘাস জন্মাবে। ঘাস জন্মালে সমস্যা নেই। কিন্তু বড় গাছ জন্মালে দু’ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। গাছের কাঠ দিয়ে হয় ফার্নিচার তৈরি হবে, নতুবা কাগজ তৈরি হবে। ফার্নিচার তৈরি হলে সমস্যা নেই। কিন্তু কাগজ তৈরি হলে আবারও দু’ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে। ভালো কাগজ হলে তা দিয়ে সংবাদপত্র ছাপা হবে, কিন্তু বাজে কাগজ হলে তা দিয়ে টয়লেট পেপার তৈরি হবে। তখন লোকজন বাথরুমে তাদের বটম সাফ করার জন্য আমাকে ব্যবহার করবে। যা আমি একজন সৈনিক হয়ে কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। তাই আমি যুদ্ধ করতে আগ্রহী নই। কারো পায়ুর জন্য আমি আমার আয়ু বিসর্জন দিতে রাজি নই।
ভালো ঘটনা কিংবা মন্দ ঘটনা কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে ঘটে না। আগাম জানিয়ে শুনিয়ে ঘটে না কিংবা পরিকল্পনা করে ঘটে না। ঘটনার পেছনে কোনো কারণ থাকতে পারে, কিন্তু ঘটনার আগাম কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। কারণ এই বিশ্বের কোনো চেতনা বা বুদ্ধিমত্তা নেই। কোনো আবেগ নেই, কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। খারাপ ঘটনা ঘটিয়ে কাউকে শিক্ষা দেবারও দরকার নেই, আবার ভালো ঘটনা ঘটিয়ে কারো উপকার করারও কোনো দরকার নেই। অশুভ ঘটনা ঘটে কারণ ঘটনা ঘটে। অশুভ ঘটনাও মূলত একপ্রকার ঘটনা। আমাদের নিজেদের পরিস্থিতি অনুসারে এই ঘটনা কখনো শুভ হয়, আবার কখনো অশুভ হয়।
এই সহজ ব্যাপারটি অনেককে বোঝানো যায় না। তারা মনে করে, আমার কপালটাই পোড়া, সব অশুভ ঘটনা আমার বেলাতেই ঘটে। ভূমিকম্প বা এ ধরনের কোনো নেতিবাচক দুর্যোগ ঘটলে অনেকে মনে করে, দেশটা পাপে ভরে গেছে, এখন ভূমিকম্পের আকারে গজব আসবে না তো কী আসবে? দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার পেছনে যে যে উপাদান দায়ী, সেগুলোর কিছুই মানুষের চিন্তাভাবনা বুঝতে পারে না। এই উপাদানগুলোকে শুধু নীরস পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম-নীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়।
এবার এই পর্যন্ত এসে একটু থামছি। শুনতে অন্যরকম মনে হলেও, একদিক থেকে তাদের ধারণা সত্য। বিশ্বের সকল খারাপ জিনিস তাদের সামনে এসে জোটে- এই কথাটিকে একদম ফেলে দেয়া যায় না। ক্ষেত্রবিশেষে সডের সূত্র সঠিক। সডের সূত্র বলছে ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়েই, সে ছিল গাছের আড়েই’। এমন একটা সময়ে কোনো একটা ঝামেলা পাকিয়ে বসবে যা চূড়ান্ত সীমার যন্ত্রণাদায়ক। সিনেমার শুটিংয়ের সময় আশেপাশের শব্দ (নয়েজ) থাকলে মূল সিনেমার আমেজ নষ্ট করে দেয়। সডের সূত্র অনেকটা ঠাট্টা করেই বলছে, এমন এক সময়ে প্যাঁচাল বাঁধবে, যখন একদমই নীরবতা দরকার। তখন একটি বাচ্চা হয়তো দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠবে কিংবা উপর দিয়ে উড়োজাহাজ উড়ে যাবে কিংবা উদাস হয়ে কেউ বাঁশি বাজাবে। এই কাজগুলো তারা শুটিংয়ের দরকারের সময়েই যেন করবে আপাতদৃষ্টিতে।
প্রাণিজগতের দিকে খেয়াল করলে পলিয়ানা বা অতি নেতিবাচকতার ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। খরগোশের দিকে যদি লক্ষ্য করা হয়, তাহলে দেখা যাবে একটি শেয়াল সবসময় তাকে শিকার করতে ওৎ পেতে আছে। মিঠাপানির পুকুরে ছোট একটি মাছের দিকে যদি লক্ষ্য করা হয়, তাহলে দেখা যাবে বড় একটি মাছ তাকে খেয়ে ফেলার জন্য ঘুরছে। যদি একটি মশার দিকে নজর দেয়া হয়, তাহলে দেখা যাবে একটি টিকটিকি তাকে ধরার জন্য তক্কে তক্কে আছে। নিজেদের দিকেই খেয়াল করে দেখি, শত শত ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া আমাদেরকে আক্রমণ করার জন্য বসে আছে।
ভাইরাস বা শেয়াল বা বড় মাছ ইত্যাদি সকলেই তাদের শিকারের জন্য খারাপ। শিকারি প্রাণীর অস্তিত্ব যেখানে আছে, শিকার প্রাণীর জন্য তা সবসময়ই পোড়া কপাল। এই হিসেবে দেখলে দেখা যাবে, চারপাশের সবকিছুই বিপদ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বসে আছে। যেন জগতের সকল অশুভ ঘটনা ঐ প্রাণীটির জন্য নির্ধারিত।
জীববিজ্ঞানে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ নামে একটি টার্ম আছে। এটিকে অন্যভাবে বলা হয় ‘টিকে থাকার লড়াই’। প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে, প্রতিটি জীবন্ত প্রাণীর শিকারি শত্রু আছে। ঐ শিকারি প্রাণীগুলো নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য শিকার করছে। যদি শিকার করতে না পারতো, তাহলে তাদের অস্তিত্বই থাকতো না পৃথিবীতে।
মাঝে মাঝে তারা শিকার ধরতে এমন কিছু কৌশল ব্যবহার করে যে, দেখে মনে হয় এগুলো খুব বুদ্ধিদীপ্ত ও পরিকল্পিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মাকড়সার জালের কথা। ক্ষুদ্র পোকা শিকারের জন্য তাদের জাল খুবই চমৎকার একটি ফাঁদ। অ্যান্টলায়ন (Antlion) নামে একটি প্রাণী আছে, এরা বালির বুকে চোঙের মতো গর্ত করে রাখে। গর্তের পাশে নিজের শরীর বালির ভেতর ঢুকিয়ে বসে অপেক্ষা করতে থাকে। কোনো শিকার এর ভেতর পড়ে গেলে আর উঠতে পারে না। কারণ গর্তটি এমনভাবে করা যে, নামার সময় ঠিকই নামা যায়, কিন্তু বেয়ে উপরে উঠা যায় না। বার বার উল্টে পড়ে যায়। এই সুযোগে অ্যান্টলায়ন এসে তার শিকার ধরে ফেলে।
কেউই বলবে না যে, মাকড়সা কিংবা অ্যান্টলায়ন খুব বুদ্ধিমান প্রাণী। কিন্তু তারা যেভাবে জাল বানিয়ে ফাঁদ পাতে কিংবা গর্ত করে ফাঁদ পাতে, তা দেখলে মনে হবে এই কাজগুলো আসলেই অনেক বুদ্ধিদীপ্ত। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তারা এমনভাবে বিকশিত হয়েছে যে, তাদের এই বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের কাছে বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে হয়। একই দৃষ্টিকোণ থেকে সিংহকেও বুদ্ধিদীপ্ত বলে মনে হবে। তাদের দেহ এমনভাবে তৈরি যে, হরিণ বা জেব্রাকে ধরার জন্য তা একদম উপযোগী।
শিকারি প্রাণীরা তাদের শিকারের সবদিক থেকে দুর্ভাগ্য তৈরি করছে- এটা খুব সহজে নজরে পড়ে। কিন্তু ভালো করে দেখলে দেখা যাবে, শিকার প্রাণীরাও শিকারি প্রাণীদের অস্তিত্ব শেষ করে দিতে চেষ্টা করে যাচ্ছে নিজেদের অজান্তেই। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে শিকাররাও শিকারীদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনছে। শিকারি প্রাণী তাদেরকে ধরার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে। অন্যদিকে শিকার প্রাণীও তাদের থাবা থেকে বাঁচতে প্রাণপণ চেষ্টা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বেঁচে যায়। যখনই তারা বেঁচে যায়, তখন শিকারী প্রাণীর কষ্টের সবটাই মাটি হয়ে যায়। তারা নিজেরা বাঁচার জন্য পালিয়েছে, কিন্তু পরোক্ষভাবে শিকারি প্রাণীর জন্য দুর্ভাগ্যও বয়ে এনেছে। এভাবে বারবার চেষ্টা করে যদি শিকারি প্রাণীটি বারবারই ব্যর্থ হয়, তাহলে সে ক্ষুধায় মারা যাবে। তার বেঁচে থাকার জন্য খাবার (শিকার) খুবই প্রয়োজনীয়।
একবার ভেবে দেখলেই হয়, মানুষ যদি কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদকে হত্যা করতে না পারে, তাহলে সে কীভাবে বেঁচে থাকবে? উদ্ভিদ ও প্রাণীরা যদি বিদ্রোহ ঘোষণা করে, তাহলে পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
একই কথা প্রযোজ্য ক্ষুদ্র জীবাণুদের ক্ষেত্রেও। ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি বাদ দিয়ে স্বজাতিদের বেলাতেও এই কথা প্রযোজ্য। একই প্রজাতির প্রাণী একে অন্যের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে আনে। প্রাণীজগতে বিদ্যমান নিয়মটাই এমন, যে প্রজাতি অন্য প্রজাতির সাথে প্রতিযোগিতা করে জয়ী হতে পারবে, প্রকৃতিতে সে তত সফলভাবে টিকে থাকতে পারবে। এই দিক থেকে এক অর্থে সডের সূত্রকে সঠিক বলা যায়। চারপাশের সবকিছুতেই দুর্ভাগ্য আর ক্ষতির সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে। তবে এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে এর সাথে গুলিয়ে ফেললে হবে না। এরা আমাদের প্রতিযোগী নয়। এরা আমাদের সাথে লড়াই করে টিকে থাকে না।
এবার হরিণের স্থলে কেউ একজনকে বসিয়ে চিন্তন পরীক্ষা করি। কেউ যদি হরিণ হয় এবং দেখে তার পারপাশে সুন্দর সুন্দর উঁচু উঁচু সবুজ ঘাস। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য, কোনো সন্দেহ নেই। বাতাস বইছে। ঘাসের পাতায় লেগে শো শো করছে। আরো চমৎকার। এতে চিন্তিত বা শংকিত হবার কিছু নেই। ঘাস বা বাতাস তার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। কিন্তু এটি যদি সত্যিকার হরিণ হয়, তাহলে এখানে বেশ ভয় আছে। ঘাস লম্বা, তাই এখানে সহজেই লুকিয়ে ওৎ পেতে থাকতে পারে কোনো চিতা বাঘ। হরিণের মাংসের স্বাদ খুবই ভালো। হরিণকে এমন অবস্থায় পেলে ছেড়ে দিতে চাইবে না কোনো বাঘই।
চিতা বাঘের কাছে হরিণের মাংস সুস্বাদু বলে তারা ও তাদের পূর্বপুরুষ এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যেন নিপুণভাবে সহজে তাদের শিকার করতে পারে। তাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষের মাঝে যারা ভালো শিকার করতে পেরেছে, তারা টিকে থাকতে পেরেছে। যারা শিকারে তুলনামূলকভাবে কম দক্ষ ছিল, তারা বিবর্তনের ছাঁকনিতে আটকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কারণ তারা শিকার ধরতে পারেনি বলে ক্ষুধায় ভুগেছে, অল্প বয়সে মারা গেছে, সন্তান-সন্ততি তুলনামূলকভাবে কম উৎপাদন করতে পেরেছে। যারা বেশি শিকার করেছে, তারা বেশি শক্তি পেয়েছে, মোটাতাজা হয়েছে, নারী সদস্যের সাথে বেশি মিলিত হয়েছে, বেশি সন্তান সন্ততি উৎপাদন করেছে। এই ‘বেশি’রাই পরবর্তীতে পৃথিবীতে রাজত্ব করে বেড়িয়েছে।
প্রাণিজগতের প্রত্যেকটি কোনায় কোনায় ছড়িয়ে আছে অশুভ কালো ছায়া, পরতে পরতে দুর্ভাগ্য। যে সকল প্রাণী অন্য প্রাণীদের ক্ষতি করতে পারেনি তথা দুর্ভাগ্য বয়ে আনতে পারেনি, তারা ছাঁকনিতে আটকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যারা টিকে আছে তারা অন্য শিকার প্রাণীদের বেশি বেশি ক্ষতি করতে পারে বলেই টিকে আছে। তাই বলা যায়, নেতিবাচকতায় ক্ষেত্রবিশেষে সডের সূত্র পুরোপুরি সঠিক।
আমাদের পূর্বপুরুষও একসময় এরকম বনে-জঙ্গলে ছিল। তারাও এ ধরনের শিকারির ভয়ে ভয় পেয়েছে। যাযাবর হিসেবে বনে বনে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং বাঘ, সিংহ, বিষধর সাপ, কুমির ইত্যাদি সকলের ভয়েই সর্বোচ্চ সতর্ক থেকেছে। বংশ পরম্পরায় সেই ভয় আজকের আধুনিক মানুষের মাঝেও প্রবাহিত হয়ে চলেছে। এর জন্যই হয়তো কেউ কেউ বলে থাকে, জগতের সবকিছুই আমার বিরুদ্ধে। আমার পোড়া কপাল, যেখানে যাই সেখানেই অশুভ ঘটনা। যখন এর মাত্রা বেশি হয়ে যায়, প্রতিটা সময়ে প্রতিটা ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্য আর নেতিবাচকতা খুঁজে পায়, তখন তাকে আমরা বলি ‘প্যারানয়েড’ বা অতি নেতিবাচক।
ফিচার ছবি: চেইন ইমেজ