সমষ্টিগতভাবে মানবজাতি হিসেবে আমাদের সবারই নিজেদের চিন্তা করার সামর্থ্য ও যৌক্তিক ভাবনার ব্যাপারে ভুল ধারণা রয়েছে। সত্যিকার অর্থে, আমাদের চিন্তাভাবনা ও সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া অনেকগুলো পক্ষপাত দ্বারা প্রভাবিত। এগুলোকে ‘কগনিটিভ বায়াস’ (cognitive bias) বলা হয়। এগুলো অবচেতন মনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার শর্টকাট হিসেবে কাজ করে। বিবর্তনের সাথে সাথে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একটি পর্যায়ক্রমিক ধারায় এই শর্টকাটগুলো আমরা আয়ত্ত করেছি। তবে পরিস্থিতি ভেদে এই শর্টকাটগুলোই ভুল সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করে। উদাহরণ হিসেবে বিপদকালীন সময়, জটিল অথবা সম্পূর্ণ নতুন কোনো পরিস্থিতির কথা বলা যায়। এরকম মূহুর্তগুলোতে আমরা কগনিটিভ বায়াসগুলো লক্ষ্য না করেই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি যা একইসাথে অযৌক্তিক এবং অকার্যকর হয়ে ওঠে। এরকম কিছু বায়াস নিয়ে আলোচনা করা যাক যেগুলো একইসাথে আমাদের চিন্তা, অনুভূতি ও আচরণে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।
কনফার্মেশন বায়াস
মানুষ সেই তথ্যগুলোর প্রতিই বেশি মনোযোগ দেয় যেগুলো তার বিশ্বাসের সাথে মেলে। এটাকে কনফার্মেশন বায়াস (confirmation bias) বলে। এরকম বায়াসের ফলে যে তথ্যগুলো নিজের মতামতের অনুকূল হয়, মানুষ সেগুলোকেই বেশি সমর্থন দেয়। বিতর্কিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে এরকম বায়াস নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় বাঁধা হয়ে উঠতে পারে। অপরপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি জানা ও সবগুলো তথ্য যৌক্তিকভাবে বিশ্লেষণের পরিবর্তে মানুষ সেগুলোই বারবার খুঁজে যেগুলো তার বিশ্বাসকে সমর্থন করে। কিন্তু তার বিশ্বাস সবসময়েই সত্য হবে, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। উদাহরণ দেওয়া যাক:
অনেকেই বিশ্বাস করে থাকে, বাঁ-হাতি লোকেরা ডান-হাতি লোকদের তুলনায় বেশি প্রতিভাবান হয়ে থাকে। যখনই তাদের সাথে এমন কারো পরিচয় হয়, যে একইসাথে বাঁ-হাতি ও সৃজনশীল, এটাকে তাদের সেই বিশ্বাসের একটি প্রমাণ হিসেবে মনে গেঁথে নেয়। কিন্তু ডান-হাতি প্রতিভাবান কারো সাথে পরিচয় হলে তা যে তাদের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে কাজ করে, সে ব্যাপারে মনোযোগ থাকে না। এভাবে এই বায়াসটি আমাদের তথ্য গ্রহণ ও তা বিশ্লেষণের ব্যাপারে প্রভাব রাখে।
হিন্ডসাইট বায়াস
কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আমাদের তা অনেকবেশি অনুমানযোগ্য মনে হয়। কিন্তু, তা ঘটার সম্ভাব্যতা অনেক সময়েই কম থাকতে পারে। অর্থাৎ, একটি ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে আমাদের মনে হয়, ‘এটা আমি আগে থেকেই জানতাম’। এই ঘটনাটি হিন্ডসাইট বায়াস (hindsight bias) হিসেবে পরিচিত। একটি বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্ট দিয়ে উদাহরণ দেওয়া যাক।
১৯৯৩ সালে ডরোথি ডিট্রিচ ও ম্যাথু অলসন নামের দুইজন গবেষক তাদের ছাত্রদেরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্টের মনোনীত ক্ল্যারেন্স থমাসকে আমেরিকান সিনেট কতটুকু সমর্থন দেবে। ভোটের আগে ছাত্রদের ৫৮ শতাংশ অনুমান করেছিল যে, ক্ল্যারেন্স সিনেটের ভোট পাবেন। ক্ল্যারেন্স নির্বাচিত হওয়ার পরে আবার জিজ্ঞেস করা হলে দেখা গেল, এবার ৭৮ শতাংশ ছাত্র বলছে তারা ভোটের ফলাফল এরকমই অনুমান করেছিল।
অ্যাংকরিং বায়াস
আমরা কোনো তথ্যের প্রথম অংশ দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত হই। যেমন, কোনো ব্যাপারে সমঝোতা তৈরির ক্ষেত্রে প্রথম যে প্রস্তাবনাটি উত্থাপন করা হয়, অবচেতনভাবে তার উপর নির্ভর করেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই ব্যাপারটিকে অ্যাংকরিং বায়াস (anchoring bias) বলা হয়। গবেষকরা এরকম ঘটনার কথাও উল্লেখ করেছেন, যেখানে অংশগ্রহণকারীরা যদি যথেচ্ছ কোনো প্রস্তাবনাও দেয় তা ভিন্ন কোনো ঘটনার ক্ষেত্রেও কারো চিন্তায় প্রভাব ফেলে। এমনকি রোগীর প্রতি একজন ডাক্তারের প্রাথমিক যে ধারণা তৈরি হয়, তা রোগ নির্ধারণে ভূমিকা রাখতে পারে। একই কারণে মানুষ নিজ অভিজ্ঞতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অন্যের জীবনের ঘটনাগুলো মূল্যায়ন করতে চায়। এরকম আরো অনেক গভীর ব্যাপারে এই বায়াসটি প্রভাব ফেলে।
মিসইনফরমেশন ইফেক্ট
কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার আগে ও পরের ঘটনাগুলো আমাদের স্মৃতিতে প্রভাব ফেলে। ফলে, এমনও হতে পারে সত্যিকারভাবে ঘটেনি এমন কোনো ব্যাপার ঘটেছে বলে আমাদের ভ্রম হয়। এটাকে মিসইনফরমেশন ইফেক্ট (misinformation effect) বলে। আমরা মনে করি, কোনো নির্দিষ্ট ঘটনার ক্ষেত্রে আমাদের স্মৃতি একেবারে পরিষ্কারভাবে কাজ করে। কিন্তু গবেষকরা বলেছেন, আমাদের স্মৃতি সূক্ষ্ম কোনো প্রভাবের প্রতিও সংবেদনশীল।
একটি বিখ্যাত এক্সপেরিমেন্টে অনেকজনকে একটি গাড়ি দূর্ঘটনার একটি ভিডিও দেখানো হয়। এরপরে তাদেরকে দুইটি প্রশ্ন করা হয়, যেগুলোর মধ্যে সামান্য পার্থক্য রয়েছে: গাড়ি দুইটি কত দ্রুত যাচ্ছিল যখন একে অপরকে আঘাত করে? এবং গাড়ি দুইটি কত দ্রুত যাচ্ছিল যখন একে অপরকে ভেঙ্গেচুড়ে দিয়েছিল?
এক সপ্তাহ পরে প্রশ্ন করলে দেখা গেল, যাদেরকে দ্বিতীয় প্রশ্নটি করা হয়েছিল তারা ভিডিওতে ভাঙা কাঁচ দেখতে পেয়েছিল বলে জানায়। কিন্তু ভিডিওতে কোনো কাঁচ দেখানো হয়নি। এভাবে শব্দের সামান্য তারতম্য স্মৃতির উপরে প্রভাব ফেলে। লোকে যা দেখেনি, তা দেখেছে বলে ভ্রম তৈরি হয়।
অ্যাক্টর অবজার্ভার বায়াস
আমরা নিজেকে এবং অন্যকে কীভাবে যাচাই করি তা অনেকগুলো বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। কোনো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, কেউ দর্শকের ভূমিকায় ছিল নাকি নিজেই কাজটি করেছিল তা এরকম যাচাইয়ে বড় একটি প্রভাব রাখে। যদি কাজটি আমরা নিজে করি, তখন বাইরের প্রভাবকে বড় করে দেখার মনোভাব দেখা যায় আমাদের মধ্যে। এটাকে অ্যাক্টর অবজার্ভার বায়াস (actor observer bias) বলে।
কেউ দাবি করতেই পারে যে, সে পরীক্ষায় খারাপ করেছে কারণ পরীক্ষক অনেক কঠিন প্রশ্ন করেছেন। কিন্তু একই পরিস্থিতিতে যদি অন্য কারো ক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয় প্রথম ব্যক্তি পরীক্ষায় খারাপ করার পেছনে তার ব্যক্তিগত যোগ্যতাকেই সামনে তুলে ধরবে। আমরা ভাবি, একজন কলিগ বাজে প্রেজেন্টেশন দিয়েছে কারণ সে অযোগ্য এবং অলস। কিন্তু, তার বাজে প্রেজেন্টেশনের পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকতে পারে, হয়তো সে পুরোপুরি দায়ী নয়। আবার, কেউ পরীক্ষায় খারাপ করেছে শুনে আমরা ধরে নিই, তার মেধা ও শ্রমের ঘাটতি রয়েছে। কিন্তু, তার ক্ষেত্রেও পরীক্ষক কঠিন প্রশ্ন করেছে এমন সম্ভাবনা আমরা মাথায় রাখি না।
অ্যাভেইল্যাবিলিটি হিউরিস্টিক
কয়েকটি চুরির ঘটনা শোনার পরে আমরা অনেকসময়েই অবচেতনভাবে বিশ্বাস করে ফেলি যে, এরকম চুরির ঘটনাগুলো হয়তো সাধারণ। একটি নির্দিষ্ট মূহুর্তে যতগুলো উদাহরণ আমাদের সামনে আসে, তার সাপেক্ষে ঐ ঘটনার সম্ভাব্যতা হিসাব করে ফেলাকে অ্যাভেইল্যাবিলিটি হিউরিস্টিক (availability heuristic) বলে। কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ে অবচেতন মনে এটা একটা শর্টকাট প্রক্রিয়া হিসেবে কাজ করে। এরকম চিন্তার উপরে নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিলে বেশিরভাগ সময়েই ভুল করার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কারণ, একটি নির্দিষ্ট মূহুর্তে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে যথেষ্ট তথ্য স্মৃতিতে নাও আসতে পারে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।
কেউ যদি ধূমপানের ফলে মৃত্যুবরণ করা কাউকে ব্যক্তিগতভাবে না চিনে থাকে, তার ধূমপানের স্বাস্থ্যঝুঁকিকে অবমূল্যায়ন করার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে, কেউ যদি ক্যান্সার আক্রান্ত অনেকজনকে চিনে থাকে, সে এই স্বাস্থ্যঝুঁকিকে পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি মূল্যায়ন করবে।
অপটিমিজম বায়াস
অ্যাভেল্যাবিলিটি হিউরিস্টিক থেকে উৎপন্ন একটি বায়াস হচ্ছে অপটিমিজম বায়াস (optimism bias)। আমরা নিজেদের ব্যাপারে অনেক বেশি আশাবাদী থাকি যা অনেক সময়েই বাস্তবতা বিবর্জিত। সামনে সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে, এমন একটি অন্ধ বিশ্বাস আমাদের অনেকের মধ্যেই কাজ করে। কিন্তু, দূর্ভাগ্যও আমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে পারে এমন ধারণাকে আমরা অবমূল্যায়ন করি।
আমরা অবচেতনভাবে ধরে নিই যে, ডিভোর্স, চাকরি হারানো, অসুস্থতা, মৃত্যুর মতো ঘটনাগুলো অন্যদের সাথেই ঘটবে শুধু। এর ফলে আমরা অনেক ধরনের অযৌক্তিক কাজ করি। যেমন: ধূমপান, বাজে খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ কিংবা গাড়ির সিটবেল্ট না বাঁধা। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, গবেষণায় দেখা গেছে অপটিমিজম বায়াস হ্রাস করা অনেক কষ্টকর। অবশ্য, এর ফলেই মানুষ ভবিষ্যতের জন্যে প্রত্যাশা খুঁজে পায়, কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলতে পারে।
এভাবে, কগনিটিভ বায়াস অনেক সময় আমাদের উপকারও করে থাকে।