পৃথিবী ছাড়াও কি অন্য কোনো গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব আছে? এটি বিজ্ঞানের এক অন্যতম অমীমাংসিত প্রশ্ন। আর এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষকরা দিনরাত গবেষণা করছেন। মহাকাশ সংস্থাগুলো বিনিয়োগ করছে কোটি কোটি টাকা । ভিনগ্রহের প্রাণী নিয়ে সাধারণ মানুষেরও জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। তাই এ ধরনের গবেষণায় কোনো অগ্রগতি হলেই তা বিজ্ঞানী মহলে ও আমজনতার মাঝে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
বর্তমানে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের জন্য অনেক শক্তিশালী রেডিও টেলিস্কোপ ব্যবহার করেন। তাদের অনুসন্ধানের পেছনে অন্যতম উদ্দেশ্য থাকে পৃথিবী-সদৃশ এবং জীবনের অস্তিত্ব রয়েছে এমন গ্রহ খুঁজে বের করা। এভাবে একটি গ্রহে কোনো জীব আছে কিনা তা সরাসরি নির্ণয় করা যায় না। বিজ্ঞানীরা যেটি করেন তা হলো, একটি গ্রহে জীবনের অনুকুল বৈশিষ্ট্য আছে কিনা তা খতিয়ে দেখেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলোকে বায়োসিগনেচার বলা হয়ে থাকে। গ্রহে পানির অস্তিত্ব, বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিমাণ, তাপমাত্রা, অক্সিজেন ও অন্যান্য গ্যাসের পরিমাণ ইত্যাদি বায়োসিগনেচারের মাঝে পড়ে।
কিছুদিন আগেই বিজ্ঞানীরা শুক্র গ্রহ পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে এমন একটি বায়োসিগনেচারের উপস্থিতি লক্ষ্য করেছেন। সূর্য থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা এ গ্রহটির মেঘে প্রচুর পরিমাণে ফসফিন গ্যাসের উপস্থিতি আবিষ্কৃত হয়েছে। এ ফসফিন আসলে খুবই বিষাক্ত একটি গ্যাস। তবে এর বিশেষ দিক হলো, এটি কোনো জৈবিক বিক্রিয়া ছাড়া তৈরি হয় না। পৃথিবীতে কিছু বিশেষ প্রকার ব্যাকটেরিয়া ফসফিন গ্যাস তৈরি করতে পারে। এছাড়া যেসব আণুবীক্ষণিক জীব অক্সিজেন বিহীন পরিবেশে বসবাস করে, সেগুলোও এ গ্যাস প্রস্তুত করতে সক্ষম। মানুষ রাসায়নিকভাবে ফসফিন গ্যাস প্রস্তুত করতে পারলেও শুক্র গ্রহের পরিবেশে এমন একটি গ্যাসের উপস্থিতি একটি আশ্চর্যজনক বিষয়। এ গ্রহের সার্বিক পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করলে সামান্য পরিমাণে ফসফিন তৈরি হলেও তা টিকে থাকার কথা নয়।
রাতের আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল তারা (শুকতারা) হিসেবে আমরা শুক্র গ্রহকে দেখতে পাই। একসময় এ গ্রহটিকে পৃথিবীর যমজ হিসেবে তুলনা করা হতো। আকৃতি ও মহাকর্ষ শক্তির দিক দিয়ে এটি পৃথিবীর কাছাকাছিই ছিল। কিন্তু সময় অতিবাহিত হওয়ার সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের ভুল ভাংতে থাকে। কয়েক বিলিয়ন বছর আগে এ শুক্র গ্রহেই পানির মতো তরলের সমুদ্র ছিল। সূর্যের অনেক কাছাকাছি হওয়ায় গ্রিনহাউস প্রক্রিয়া এ গ্রহের চেহারা বদলে দিয়েছে। কোটি কোটি বছর ধরে চলমান গ্রিনহাউস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ গ্রহ এখন যেন এক জ্বলন্ত নরক। পাথুরে এ গ্রহটির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বর্তমানে প্রায় ৯০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। বায়ুমণ্ডলীয় চাপ পৃথিবীর তুলনায় প্রায় ৯০ গুণ বেশি। এছাড়াও কার্বন ডাই-অক্সাইড ও সালফিউরিক এসিডে পরিপূর্ণ এমন একটি গ্রহে জীবের অস্তিত্ব আশা না করাটাই স্বাভাবিক।
উচ্চ তাপমাত্রা ও প্রতিকুল পরিবেশের কারণে পৃথিবীর কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও এ গ্রহটিতে তেমন কোনো অভিযান সম্পন্ন হয়নি। এ কারণে শুক্র গ্রহ বলতে গেলে মঙ্গল গ্রহের ছায়ায় পড়ে গিয়েছে। নাসাতেও শুক্র গ্রহে কোনো প্রকার রোভার অভিযানকে খুব একটা উৎসাহিত করা হতো না। তবে সম্প্রতি আমাদের প্রতিবেশী গ্রহটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের জগতে ভালোই মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এ গ্রহে ফসফিন গ্যাস আবিষ্কৃত হওয়ার পর নেচার সাময়িকীতে আবিষ্কারের গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণাপত্রের সহ-লেখক ছিলেন এমআইটির গবেষক ক্লারা সৌসা-সিলভা। এমন একটি আবিষ্কার নিয়ে তিনি নিজের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন।
আমি কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যাই। আমি ভাবছিলাম এখানে কোনো ভুল আছে। কিন্তু মনে মনে চাচ্ছিলাম যেন এই ফলাফলে কোনো ভুল না থাকে।
মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই এ গবেষণার ফলাফলের যথার্থতা নিয়ে আলোচনা করছেন। একই সাথে বায়োসিগনেচার পর্যবেক্ষণের অন্যান্য পদ্ধতি অনুসরণ করে ফসফিন গ্যাসের অস্তিত্ব পরীক্ষা করাও শুরু হয়ে গিয়েছে। যদি সত্যিই শুক্র গ্রহের মেঘে বিপুল পরিমাণে ফসফিন গ্যাস থেকে থাকে, তবে তা দুটি সম্ভাবনার দিক ইঙ্গিত করে। এক: কোনো ভিনগ্রহের রোগজীবাণু ফসফিন গ্যাস তৈরি করছে। অথবা, দুই: এমন কোনো বিশেষ রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এ গ্যাস প্রস্তুত হচ্ছে, যা আমাদের ধারণার বাইরে।
শুক্র গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা কিন্তু নতুন নয়। প্রায় ৬০ বছর ধরে এ গ্রহ নিয়ে গবেষণা চলছে। পূর্ববর্তী এসব গবেষণা থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া যায়। এই যেমন, শুক্র গ্রহের কিছু কিছু অংশে সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে শোষিত হয়। তখনই গবেষকরা ধারণা করতেন যে, এখানে কোনো বায়ুবাহিত অণুজীব থাকতে পারে। কিন্তু তাদের এ তত্ত্বকে দাঁড় করানোর মতো যান্ত্রিক সহায়তা তখন ছিল না।
নব্বইয়ের দশক থেকে এ গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণা করছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ডেভিড গ্রিনস্পুন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্ল্যানেটারি সায়েন্স ইন্সটিটিউটে কর্মরত আছেন। তিনি এ বিষয়ে কাজ করার সময় তার পথে অনেক বাধা তৈরি হয়েছিল। শুক্র গ্রহের মতো অম্লীয় পরিবেশে যে এমন রোগজীবাণুর অস্তিত্ব থাকতে পারে, তা অনেকেই মানতে চাইছিলেন না। তবে আমরা যদি আমাদের পৃথিবীর দিকেই তাকাই, তাহলে দেখবো, সমুদ্রের একেবারে গভীরে অক্সিজেন বিহীন পরিবেশে, আগ্নেয়গিরির পাদদেশেও প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গিয়েছে।
ফসফিন মূলত একটি বিষাক্ত গ্যাস। একটি ফসফরাস পরমাণু ও তিনটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে একটি ফসফিন অণু তৈরি করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে এ গ্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল। যুদ্ধে এ গ্যাসের কবলে পড়ে প্রাণ হারায় হাজার হাজার সৈন্য। এমন একটি গ্যাস প্রকৃতিতেও খুব সহজলভ্য নয়। অনেক শক্তিশালী ও অনুকূল রাসায়নিক পরিবেশ ছাড়া এ গ্যাস তৈরি করা সম্ভব না। বিজ্ঞানীরা শনি ও বৃহস্পতি গ্রহে এ গ্যাসের অস্তিত্বের ব্যাখা করতে পারেন। কারণ মহাকর্ষ শক্তি ও রাসায়নিক পরিবেশের প্রভাবে সেখানে ফসফিন তৈরি হওয়া সম্ভব। তবে শুক্র গ্রহের কথা বিবেচনা করলে বিজ্ঞানীরা কোনো উত্তর খুঁজে পাননি। অনেক অনুসন্ধান করেও এ আবিষ্কারের সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা ফসফিন গ্যাস তৈরির অন্য কোনো প্রাকৃতিক উৎস খুঁজে বের করতে পারেননি।
যারা শুক্র গ্রহের মেঘে ফসফিন গ্যাস আবিষ্কার করেছেন, তারা নিজেদের আবিষ্কার নিয়ে বেশ উৎফুল্ল হলেও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রদর্শন করেননি। অতীতের দিকে তাকালেই এ রকম ঘটনার অনেক উদাহরণ রয়েছে। বিশেষ করে ভিনগ্রহের প্রাণী সম্পর্কিত কোনো আবিষ্কারে অকাট্য প্রমাণ প্রদর্শনের একটা বোঝা থাকে। অনেক পুরনো তত্ত্ব ও আবিষ্কার এর আগে বিজ্ঞানীদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তেমন কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
বেশ কিছুদিন আগেই মঙ্গল গ্রহে মিথেন গ্যাসের অস্তিত্ব নিয়ে বেশ কানাঘুষা শুরু হয়েছিল। কিউরিওসিটি নামের জনপ্রিয় রোভারটি মঙ্গল গ্রহে মিথেনের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। মিথেন তৈরির কোনো প্রাকৃতিক উপায় না দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেছিলেন, এই মিথেন জৈবিক উপায়ে প্রস্তুত হতে পারে। কেবল এই একটি বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্যই নাসা এক্সোমার্স ট্রেস গ্যাস অরবিটার নামে একটি আলাদা অভিযান পরিচালনা করেছিল। তবে এ অভিযান থেকে কোনো আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি।
একইভাবে ফসফিন গ্যাসের আবিষ্কার শুক্র গ্রহকে নতুন করে আলোচনায় আনলেও এখানে আরো গবেষণার প্রয়োজন। কীভাবে এ ফসফিন তৈরি হচ্ছে তা নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা চালিয়ে গেলে হয়ত বিজ্ঞানীরা একটি যথাযথ উত্তর খুঁজে পাবেন।