প্রবন্ধের শুরুতে আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা করবো। কিন্তু এই পরীক্ষার পুরোটা হবে আমাদের কল্পনার জগতে। এই চিন্তন পরীক্ষার জন্য আমাদের প্রয়োজন সুন্দর একটি ঘর এবং মেরি নামক একটি মেয়েকে। মেরি তার জন্মের পর থেকে এই ঘরের ভেতর বসবাস করছে। এখানে মেরির বেড়ে উঠার জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠছে মেরি। কিন্তু এত পূর্ণতার পরও আমাদের কল্পনার ঘরে একটি জিনিসের অভাব থাকবে। আর তা হচ্ছে রঙ।
মেরির বাসস্থানের পুরোটা হবে বিবর্ণ। এক কথায় বলতে গেলে, সাদা কালো জগতের মাঝে মেরি বাস করছে। যার ফলে মেরি কখনোই রঙের অভিজ্ঞতা লাভ করেনি। মেরি যখন কিছুটা বড় হয়ে লেখাপড়া শুরু করলো, তখন তাকে শুধু একটি বিষয়ে পড়ানোর অনুমতি প্রদান করা হলো। সাদা কালো বই এবং শিক্ষা উপকরণের মাধ্যমে মেরিকে স্নায়ুবিজ্ঞানের উপর শিক্ষা প্রদান করা হলো। এর মাধ্যমে সে বিভিন্ন রঙ সম্পর্কে জানতে পারলো। কোন রঙ কীভাবে কাজ করে এবং এর খুঁটিনাটি সকল জ্ঞান বিষয়ে অর্জন করলো।
আমরা ধরে নিচ্ছি, মেরি তার শিক্ষাজীবন শেষে রঙ নিয়ে সমস্ত তথ্য জেনে ফেলেছে। রঙ নিয়ে জানার নতুন কোনো তথ্য বাকি নেই। সে এখন একজন রঙ বিশারদ। কিন্তু সে কখনো কোনো রঙিন বস্তু দেখেনি। এমন করে বেশ কেটে যাচ্ছিলো মেরির দিন। কিন্তু একদিন মেরির জীবনে বেশ বড় একটি ঘটনা ঘটে গেলো। মেরি এই এক ঘরে ভেতর বন্দী জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলো। তাই সে একদিন সেখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। যেই ভাবা সেই কাজ। মেরি সাহস করে ঘরের দরজা ভেঙে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
মেরির অভিষেক ঘটলো রঙিন দুনিয়ায়। যা সে এর আগে কখনো দেখেনি। আমরা ধরে নিচ্ছি, নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মেরি সবার আগে যা দেখলো তা হলো একটি লাল আপেল। এখন প্রশ্ন হলো, লাল আপেলটি দেখে কি মেরি নতুন কিছু শিখেছে?
দার্শনিকদের বেশ চিন্তায় ফেলে দিলো এই চিন্তন পরীক্ষা। চিন্তায় ফেলে দিলেন ফ্রাঙ্ক জ্যাকসন নামক এক অধ্যাপক। ১৯৮২ সালে দ্য ফিলোসফিকার কোয়াটার্লি নামক এক জার্নালে তিনি Knowledge Argument নামক শিরোনামে এই বিখ্যাত চিন্তন পরীক্ষা তুলে ধরেন। মনস্তাত্ত্বিক দর্শনের জগতে মেরির বিবর্ণ কক্ষের এই চিন্তন পরীক্ষাটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে আলোচিত পরীক্ষা হিসেবে অন্যতম।
মেরির যুক্তি তর্কে লিপ্ত হওয়ার পূর্বে আমাদের ফিজিক্যাল (ভৌত) এবং অ্যান্টি-ফিজিক্যাল (অভৌত) জ্ঞান সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ধারণা থাকতে হবে। মেরির চিন্তন পরীক্ষাটি অ্যান্টি-ফিজিক্যাল পরীক্ষা হিসেবে স্বীকৃত। এখানে দার্শনিক জ্যাকসন একজন মেরির সৃষ্টি করেছেন, যার রঙ সম্পর্কে সম্ভাব্য সকল ভৌত জ্ঞান অর্জন করা শেষ। বিশদভাবে বললে, ভৌত জ্ঞান হচ্ছে এমন জ্ঞান, যা প্রকাশ করতে বিশেষ কোনো মনস্তাত্ত্বিক শব্দের ব্যবহার প্রয়োজন হবে না।
ভৌত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষ আসল বস্তু সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞান লাভ করতে পারবে। ভৌতবিশারদদের মতে, মেরি তার ভৌত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে রঙের সম্পূর্ণ ধারণা লাভ করতে সক্ষম হবে। তাই সে যদি কখনো লাল রঙের আপেল না দেখেও থাকে, তবু তার লাল আপেল চিনতে কোনো কষ্ট হবে না। এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে যারা যুক্তি প্রদান করেন, তাদের অ্যান্টি-ফিজিক্যালিস্ট বলা হয়ে থাকে। যদি ভৌত জ্ঞান বিবর্ণ মেরির চোখকে রঙ চেনাতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে ধরা হয়ে থাকে, ভৌত জ্ঞান অন্যান্য মানসিক চেতনা এবং অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হবে না।
এখন পাঠকমনে প্রশ্ন আসতেই পারে, অধ্যাপক জ্যাকসনের এই বিখ্যাত পরীক্ষার পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য কী? তিনি মূলত ফিজিক্যালিস্ট বা ভৌতবিশারদ দর্শনতত্ত্বকে আঘাত করার জন্য এই পরীক্ষাটি করেছিলেন। ভৌতবিশারদদের মতে, মানুষের চেতনা মূলত তার মস্তিষ্কের প্রতিচ্ছবি। পৃথিবীর সমস্ত অনুভূতি এবং মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাকে ভৌত জ্ঞানের মাধ্যমে বর্ণনা করা হয়। দার্শনিক জগতে ফিজিক্যালিজমের এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে বহু বিখ্যাত দার্শনিক স্বতন্ত্র তত্ত্ব প্রদান করেছিলেন।
বিখ্যাত দার্শনিক রেনে দেকার্তের মতে, মানুষের দেহ থেকে তার মন সম্পূর্ণ আলাদা। দেকার্তের নিকট এই দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কিন্তু ভৌতবিশারদগণ এই তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই জ্যাকসন তার চিন্তন পরীক্ষা শেষে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন ভৌতবিশারদদের প্রতি। যার উত্তরের উপর নির্ভর করছে কারা সঠিক। ভৌতবিশারদদের মতে, ভৌত বিজ্ঞান মেরিকে সবকিছু শিক্ষা দিতে সক্ষম। তাই মেরি যখন তার লাল আপেলকে দেখবে, সে কিছুই শিখবে না। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে তা অস্বাভাবিক ঠেকছে। কারণ নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে মেরি অবশ্যই নতুন কিছু শিখবে। আর তা সত্য হলে প্রমাণিত হচ্ছে, সকল জ্ঞানই ভৌত নয়। ভৌত পৃথিবীর বাইরেও একটি জগত আছে মানুষের মনে। ভৌত জ্ঞানের এই সীমাবদ্ধতাকে কোয়ালিয়া (Qualia) হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই বিষয়ে অধ্যাপক জ্যাকসন বলেন,
স্বাভাবিকভাবে আমরা বুঝতে পারি, মেরি অবশ্যই নতুন কিছু শিখবে। আর যদি আপনি একথা মেনে নেন, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা মেনে নিচ্ছি যে, মেরির পূর্বজ্ঞান অসম্পূর্ণ ছিল। কিন্তু তাকে সমস্ত ভৌত জ্ঞান প্রদান করা হয়েছিল। এর মানে ভৌত জ্ঞানের বাইরেও আরো অনেক কিছু রয়েছে। ভৌতবিশারদদের তত্ত্ব সম্পূর্ণ ভুল।
দার্শনিকগণের ন্যায় কঠিন বর্ণনায় না গিয়ে আমরা সহজভাবে ঘটনাটি কল্পনা করতে পারি আরেকটি চিন্তন পরীক্ষার মাধ্যমে। মনে করি, আপনাকে পল নামক একজন ব্যক্তির মস্তিষ্কের সকল তথ্য এবং অনুভূতি সংক্রান্ত বিশ্লেষণ সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান করা হলো। কিন্তু আপনি পল সম্পর্কে যত বড় বিশেষজ্ঞই হন না কেন, আপনি কখনোই তার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সব জানতে পারবেন না। এমনকি আপনি পল হলে কেমন অনুভব করতেন, তাও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে না। এ যেন বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ,‘যার জ্বালা সেই জানে’-এর সমার্থক। কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন যে, এত যুক্তি প্রদানের পরও একদল ভৌতবিশারদ তাদের অবস্থান থেকে সরে আসতে অসম্মতি জানান।
সি এল হার্ডিন নামক এক দার্শনিক দাবি করেন, মেরি নতুন করে কিছুই শিখবে না। বরং লাল আপেল দেখে সে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠবে, “ওহ! তাহলে এটাই লাল রঙ!” এমনকি আমরা যদি মেরিকে লালের পরিবর্তে অন্য রঙের ফল কিংবা বস্তুর দ্বারা পরীক্ষা করি, প্রতিবারই সে রঙের নাম বলতে পারবে। আর যদি মেরি রঙ চিনতে ব্যর্থ হয়, সেক্ষেত্রে তার জ্ঞান কখনোই সম্পূর্ণ ছিল না। তবে হার্ডিনের নাছোড়বান্দা ব্যাখ্যা অনেকে হেসে উড়িয়ে দিলেও মেরির চিন্তন পরীক্ষার স্রষ্টা ফ্রাঙ্ক জ্যাকসন তখনো ক্ষান্ত হননি। তিনি আরো একটি উদাহরণের মাধ্যমে ভৌতবিশারদদের তত্ত্বকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করছিলেন।
আমাদের এবারের চিন্তন পরীক্ষার গিনিপিগ হচ্ছে ফ্রেড নামক এক ব্যক্তি। ধরে নিচ্ছি, ফ্রেড এমন একটি রঙ আবিষ্কার করলো যা এর আগে কেউ দেখেনি। এখন ফ্রেড তার সমস্ত ব্যাখ্যা এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে সবাইকে বোঝাতে লাগলেন তার নতুন আবিষ্কৃত রঙের কথা। জ্যাকসনের মতে, যতক্ষণ না মানুষ ফ্রেডের আবিষ্কৃত রঙকে নিজের চোখে দেখবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ সেই রঙকে সঠিকভাবে কল্পনা করতে পারবে না। এভাবে দার্শনিকদের যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির মাধ্যমে আজও টিকে আছে এই পরীক্ষাটি।
বর্তমানে এই দ্বৈরথের (Knowledge argument) ব্যাপ্তি তর্কের টেবিল ছাপিয়ে বহু ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। দার্শনিকগণ এই পরীক্ষাকে বিশ্লেষণ করে একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন।
তাদের মতে, ভৌত অবস্থাকে পুনঃর্নিমাণ করলেই মানসিক অবস্থার প্রতিরূপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে না। অর্থাৎ যদি বিজ্ঞানীগণ এমন একটি কম্পিউটার তৈরি করতে সক্ষম হন যা মানুষের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনের কাজকে অনুকরণ করতে পারে, তারপরও সেই কম্পিউটার সম্পূর্ণ মানুষের ন্যায় ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না। যদিও এখন পর্যন্ত মেরির পরীক্ষার প্রশ্নগুলোর সুনির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি, তবে এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মহাবিশ্বে এখনও অনেক অজানা বিষয় রয়েছে, যা আমাদের ভৌত জ্ঞান দিয়ে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করা কখনোই সম্ভব হবে না।
ফিচার ইমেজ: Pinterest