ধরুন, কালিভরা একটি দোয়াত হঠাৎ করে আপনার অসাবধানতার ফলে ধাক্কা লেগে উপুড় হয়ে পড়ে গেলো সাদা ফুলস্কেপ কাগজের উপর। দেখতে দেখতে দোয়াতের কালো কালি কাগজের সফেদ জমিন লেপ্টে দিলো তার অদ্ভুত কালিমায়। এখন আপনি সেই কাগজখানা নিজের হাতে তুলে নিলেন। দেখা গেলো, লক্ষ্যহীনভাবে ছড়িয়ে যাওয়া কালি সেই সাদা কাগজের বুকে অস্পষ্ট আলপনা এঁকে দিয়েছে। এই কালির দাগকে ইংরেজিতে ‘ইঙ্কব্লট’ (Inkblot) বলা হয়।
এখন আপনাকে প্রশ্ন করা হলো, “কাগজের বুকে সেই অস্পষ্ট আলপনা দেখে সেটিকে আপনার কিসের ছবি হিসেবে মনে হচ্ছে?” প্রশ্ন শুনে আপনি ভালো করে পুনরায় কাগজটি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করতে থাকলেন। একসময় মনে হলো, এলোমেলো ছড়িয়ে পড়া কালির আলপনাটুকু দেখতে একটি পাখির মতো মনে হচ্ছে। আপনি কাগজটি নিয়ে আরেকজনকে দেখালেন। কিন্তু সে আপনার সাথে একমত হলো না। তিনি জোর গলায় বললেন, “এটা কোনোভাবেই পাখি হতে পারে না। এটা তো একটি বন্দুকের ছবি।” এরপর আপনি আরেকজনকে আলপনাটি দেখালেন। সে-ও আপনার সাথে একমত না হয়ে বললো, আলপনাটি দেখতে একটি কুকুরের মতো লাগছে। এভাবে ব্যক্তিভেদে উত্তর ভিন্ন হতে থাকে। এবার আপনি প্রশ্ন করে বসলেন, “আপনাদের মধ্যে কার উত্তর সঠিক?”
আসলে এই প্রশ্নগুলোর কোনো সঠিক উত্তর নেই। বরং ব্যক্তিভেদে এর উত্তর ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক। আর আপনার উত্তর থেকে মনোবিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করবেন আপনার মানসিক অবস্থা। এতক্ষণ ধরে যে অদ্ভুত পরীক্ষার কথা বললাম, সেটির নাম রোরশাক ইঙ্কব্লট পরীক্ষা। আবিষ্কারক হারম্যান রোরশাকের সাথে মিলিয়ে নাম রাখা এই মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষাটি পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় পরীক্ষা হিসেবে বিবেচিত হয়।
হারম্যান রোরশাক
মনোবিজ্ঞানী হারমান রোরশাক ১৮৮৪ সালের ৮ নভেম্বর সুইজারল্যাণ্ডের জুরিখে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একদম ছোট থেকে ছিলেন খেলাপাগল মানুষ। বিশেষ করে কার্ড খেলার প্রতি ছিল তার অদম্য ঝোঁক। তিনি যখন কিশোর ছিলেন, তখন বাজারে ব্লটো নামক কার্ড পাওয়া যেত যেখানে কালি দিয়ে নকশা করে এলোমেলো ছবি আঁকা থাকতো এবং সেগুলো দেখে কবিতা রচনা করতে হতো। তিনি নিজেও কালি দিয়ে এসব ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন। হয়তো ছোটবেলার ব্লটোপ্রীতি তার পরবর্তী জীবনে ইঙ্কব্লট পরীক্ষা আবিষ্কার করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
রোরশাক বড় হয়ে মনোবিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তখন থেকে তিনি মানব মনস্তত্ত্বের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করা শুরু করেন। ১৯১১ সালে ইউজিন ব্লুলার কর্তৃক ‘সিজোফ্রেনিয়া’ শব্দের প্রচলন হয়। রোরশাক এই নতুন রোগ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, স্কিৎজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত রোগীরা সাধারণ মানুষ থেকে কিছুটা আলাদাভাবে চিন্তাভাবনা করে। যেকোনো ঘটনা এবং দৃশ্যের প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া হয় কিছুটা ভিন্ন। তাই তিনি চিন্তা করলেন, যদি ব্লটোর মতো কিছু কার্ড দেখিয়ে রোগীর প্রতিক্রিয়া জানা যায়, সেক্ষেত্রে রোগীর মানসিক অবস্থা বোঝা সহজতর হবে।
তিনি বেশ কয়েকজন রোগীকে ব্লটো খেলতে দেন এবং তাদের উত্তর লিপিবদ্ধ করেন। রোগীদের উত্তরপত্রে এক নজর পরখ করে তিনি বুঝতে পারলেন, একটি নির্দিষ্ট নমুনায় যদি কিছু ব্লট তৈরি করা যায়, সেক্ষেত্রে খুব সহজে যেকোনো ব্যক্তির মানসিক অবস্থা পরীক্ষা করা যাবে। এমনকি কারো মানসিক ব্যাধি থাকলে, সেটিও আগে থেকে নির্ণয় করা যাবে।
ইঙ্কব্লটে ছড়াছড়ি
বিখ্যাত পরিচালক জ্যাক স্নাইডারের ‘ওয়াচম্যান’ সিনেমাটি যারা দেখেছেন, তাদের কাছে রোরশাক নামটি অপরিচিত নয়। রোজনামচা লিখে বেড়ানো এই সুপারহিরোর মুখ থাকতো বাদামি মুখোশে ঢাকা। আর সেই মুখোশের উপর কালো কালির মুখায়ব সর্বক্ষণ কচু পাতার উপর নাচতে থাকা পানির ফোঁটার মতো নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতো। ফলে রোরশাকের মুখোশ কিছুক্ষণ পর পর ভিন্ন নকশা অঙ্কন করতো। বিজ্ঞানী হারম্যান রোরশাকের সেই ইঙ্কব্লটের চিত্রগুলো কিন্তু সেই সুপারহিরো রোরশাকের মুখোশের মতোই এলোমেলো।
মাত্র ১০টি ছবির সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ পরীক্ষা তৈরি করা হলেও এটি বিনির্মাণে বিজ্ঞানী রোরশাক রাত-দিন নিরলস পরিশ্রম করেছেন। প্রায় ৪০০টি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপর বিস্তর গবেষণার মাধ্যমে এটি তৈরি করা হয়েছিলো। মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহে প্রায় ৩০০ মানসিক রোগীর উপর পরীক্ষাটি চালানো হয়েছিলো। সবশেষে নিজের গবেষণার ফলাফলে কয়েকশত পাতার ভেতর বন্দি করে তিনি রচনা করেন ‘সাইকোডায়াগনস্টিক’ নামক একটি বই। ১৯২১ সালে প্রকাশিত এই বইয়ে ১০টি অদ্ভুত ছবির মাধ্যমে তিনি তার বহুল আলোচিত পরীক্ষার মোড়ক উন্মোচন করেন। বইতে তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, তিনি রোরশাক পরীক্ষার মাধ্যমে কোনো মানসিক রোগী স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত কি না, সেটি নির্ণয় করতে পারবেন। এছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে এই পরীক্ষা প্রয়োগ করা অনুচিত হবে।
পরীক্ষা পদ্ধতি
রোরশাক পরীক্ষাকর্তা অবশ্যই একজন দক্ষ মনোবিজ্ঞানী হবেন। এই পরীক্ষা ইচ্ছে করলে যে কেউ নিতে পারবেন, সেটি ভুল ধারণা। পরীক্ষার সময় পরীক্ষক এমনভাবে অবস্থান করবেন যেন পরীক্ষার্থী তার চেহারা না দেখতে পায়। পরীক্ষার সময় পরীক্ষার্থীর প্রতিটি প্রতিক্রিয়া, কথা, বাচনভঙ্গি সবকিছুই লিপিবদ্ধ করতে হয়। পরীক্ষার্থীকে নির্দিষ্ট সময় পর পর একে একে দশটি ছবি দেখানো হবে। ইঙ্কব্লটে নকশা করা প্রতিটি ছবির প্রথমার্ধ অপর অর্ধেক অংশের অনুরূপ। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে প্রধানত কালো রঙের কালি ব্যবহার করা হয়। তবে কিছু কিছু ছবির ক্ষেত্রে লাল, সবুজ কিংবা নীল রঙের ব্যবহারও দেখা গিয়েছে।
ছবিগুলো দেখে তার কী মনে হয়েছে বা কী অনুভব করছে সেটি নিয়ে কিছু কথা বলতে হবে। একটি ছবি দেখে রোগী ইচ্ছে করলে একাধিক উত্তর দিতে পারবেন। পরীক্ষক প্রয়োজনবোধ করলে রোগীকে অতিরিক্ত প্রশ্ন করতে পারবেন। ফলাফল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পরীক্ষক রোগী কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, কতটুকু সময় নিছে, রঙিন ছবির ক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়ায় ভিন্নতা রয়েছে কি না, পরীক্ষার সাথে অপ্রাসঙ্গিক কী মন্তব্য করছে, কোনো ব্যতিক্রমী মতামত দিচ্ছে কি না ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে থাকেন। রোরশাক তার বইয়ে নির্দিষ্ট মানবণ্টন প্রদান করেছেন, যেটি অনুসরণ করে পরীক্ষক চূড়ান্ত ফলাফল তৈরি করে থাকেন। তার এই পরীক্ষা এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যুদ্ধাপরাধী বিচারের সময় নাৎসি কর্মকর্তাদের এই পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। সূর্যোদয়ের দেশ জাপানে বেশ বড় পরিসরে রোরশাক পরীক্ষার ব্যবহার শুরু হয়। এমনকি শিশুদের বিদ্যালয়ে ভর্তির পূর্বে রোরশাক পরীক্ষার ফলাফল জমা দেওয়ার নিয়ম চালু হয়েছিলো।
‘অবৈজ্ঞানিক’ বিতর্ক
রোরশাক ১৯২১ সালে তার পরীক্ষার কথা পুরো পৃথিবীকে জানিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেললেন। তিনি তার বইয়ে বার বার সতর্ক করেছেন যে, এই পরীক্ষা শুধু পরীক্ষার্থীর স্কিৎজোফ্রেনিয়া আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নির্ণয় করা ছাড়া আর কোনো ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু কৌতূহলী মানুষ তার সতর্কবাণী অগ্রাহ্য করে ঢালাওভাবে মানুষের ব্যক্তিত্ব নির্ণয়ে ব্যবহার করতে থাকলেন। ঠিক তখন রোরশাক পরীক্ষার নানা অসঙ্গতি বিশেষজ্ঞদের নজরে আসতে থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেলো, রোরশাক পরীক্ষা বহুক্ষেত্রে ভুল ফলাফল প্রদান করছে। স্কিৎজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার রোগ নির্ণয়ে ব্যবহার করা এই পরীক্ষা বিভিন্ন মানসিক উপসর্গের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ফলাফল প্রদান করে। এর ফলে পুরো পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। অনেক পত্রিকায় এই পরীক্ষাকে ‘অবৈজ্ঞানিক’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।
পাঠকগণ প্রশ্ন করতে পারেন, এসব মন্তব্য এবং অপবাদ নিয়ে স্বয়ং রোরশাক কী ভাবছিলেন? দুর্ভাগ্যক্রমে, বিজ্ঞানী রোরশাক তার ইঙ্কব্লট পরীক্ষা আবিষ্কারের পরের বছর মৃত্যুবরণ করেন। তাই যখন ১৯৫০-৬০ সালের দিকে তার পরীক্ষা নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়, তখন তার অনুপস্থিতিতে এই পরীক্ষার সবধরনের অগ্রগতি বন্ধ হয়ে যায়।
শত শত সমালোচনা এবং বিতর্কের মুখে পড়ে রোরশাক পরীক্ষা কিন্তু একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। এখনও অনেক দেশে বিদ্যালয়, হাসপাতাল, এমনকি কোর্টে রোরশাক পরীক্ষা ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৯৯ সালে পৃথিবীর বহু নামকরা মনোবিজ্ঞানী রোরশাক পরীক্ষা বন্ধের জন্য আওয়াজ তুলেছেন। তাদের মতে, এই পরীক্ষার অবৈজ্ঞানিক ফলাফলের ভিত্তিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হবে না। এর ফলে বহু সাধারণ মানুষ বিপদের মুখে পড়তে পারে। আবার রোরশাক পরীক্ষার পক্ষেও আছেন অনেকে। তাদের মতে,
যদিও স্কিৎজোফ্রেনিয়া কিংবা বাইপোলার রোগ নির্ণয়ে কিছুটা ত্রুটি রয়েছে, কিন্তু একজন পরীক্ষার্থী মানসিক রোগী হয়ে থাকলে তার ফলাফলে সেই ছাপ পরিলক্ষিত হয়। তাছাড়া কয়েকটি গবেষণায় একজন ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার সাথে রোরশাক ফলাফলের সামঞ্জস্যতা প্রমাণিত হয়েছে।
রোরশাক ইঙ্কব্লট পরীক্ষা আসলেই একজন ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ মানসিক অবস্থা নির্ণয় করতে পারে কি না, সেটা আজও বিতর্কের বিষয়। বিতর্ক উপেক্ষা করে বহুক্ষেত্রে এখনও এই পরীক্ষা ব্যবহৃত হচ্ছে। ভয়ের ব্যাপার হচ্ছে, হয়তো এই পরীক্ষার বিতর্কিত ফলাফলের উপর নির্ভর করছে একজন সাধারণ মানুষের জীবন। একটি সিদ্ধান্তের ফলে যেখানে তার জীবনের চিত্র বদলে যেতে পারে, সেখানে একটি বিতর্কিত পরীক্ষা কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে সেটা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন।