শত বছরের গবেষণার পরেও মানবদেহের রহস্য ভেদ করার এখনো বুঝি অনেক বাকি। তাইতো জ্ঞানপিপাসুদের কাছে নতুনভাবে ধরা দিয়ে চলেছে মানবদেহের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম কোনো অংশ, কখনো আবার চোখে পড়ছে নতুন কোনো সংবহন পথ। সেইসাথে শারীরতত্ত্বের ভাষাও বুঝি ক্রমাগত ভারি হয়ে চলেছে। গত এক দশকে এমন অনেক আবিষ্কার বরাবরের মতোই আমাদের অবাক করেছে। চলুন জেনে নিই এমনই কয়েকটি অংশের কথা।
ফ্যাবেলা কি তবে ফিরে এসেছে?
সম্প্রতি পেপসির একটি বিজ্ঞাপনে সালমান খানকে জিজ্ঞাসা করতে দেখা যায়,“মানুষের দেহে কয়টি হাড় আছে?” সে বিজ্ঞাপনের বদৌলতে হোক কিংবা জীববিজ্ঞান বইয়ের পাতা থেকেই হোক, আমরা সবাই মোটামুটি জানি, প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দেহে হাড়ের সংখ্যা ২০৬। কিন্তু কেমন হবে, যদি এ সংখ্যা বেড়ে যায়?
বলছিলাম ‘ফ্যাবেলা’ নামক ছোট্ট একটি হাড়ের কথা। পায়ের হাড্ডি ‘ফিবুলা’র সাথে আবার একে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন! শিমের বীজসদৃশ এই ফ্যাবেলার অবস্থান হাঁটুর পেছনের দিকের টেন্ডনের মাঝে। বলতে পারেন, প্যাটেলার ঠিক বিপরীতেই, কিন্তু আকৃতিতে প্যাটেলার তুলনায় বেশ অনেকখানিই ছোট।
এবার চলুন, একটু পুরনো পৃথিবীতে ফিরে যাই। তখনকার যুগের বানরের হাঁটুতে দেখা পাওয়া যেত এই ফ্যাবেলার। ক্রমেই বানরের বংশগতি থেকে ‘গ্রেট এপ’ বা শিম্পাঞ্জির বংশগতির বিবর্তনের ধারায় এবং পরবর্তীকালে মানুষের দেহেও এটি ক্রমান্বয়ে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের একদল গবেষক বিগত দেড়শো বছর ধরে ২৭টি ভিন্ন ভিন্ন দেশে সংঘটিত হাঁটু সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা থেকে ২১ হাজারেরও বেশি গবেষণার ফলাফল সংগ্রহ করেন। গবেষণাগুলোর তথ্য নেওয়া হয়েছিল এক্স-রে, এমআরআই বা সরাসরি ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে। তারা এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, ১৯১৮ সালে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ১১ শতাংশ মানুষের দেহে ফ্যাবেলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আর ২০১৮ সালে এ পরিসংখ্যান ৩৯ শতাংশে এসে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, ফ্যাবেলা থাকা কি আদৌ জরুরী? অনেকের মতে, মানবদেহে এর আসলে তেমন কোনো কাজ নেই। অনেকে আবার বলেন, যেহেতু ক্রমান্বয়ে মানুষ পূর্বের চেয়ে বেশি ভারী হচ্ছে, তাই হাঁটুর উপর দেহের চাপও বেড়েই চলেছে। তাই ফ্যাবেলা অনেকক্ষেত্রেই হাঁটার বেলায় বাড়তি যান্ত্রিক সুবিধা দিতে পারে। কেউ কেউ আবার বলেন, ফ্যাবেলার অবস্থানের ভিন্নতা অস্টিও-আর্থ্রাইটিস কিংবা হাঁটুর সার্জারিতে বাড়তি অসুবিধার কারণ হতে পারে।
কে জানে ভবিষ্যতে কেউ যখন মানব কঙ্কাল আঁকবে, তাকে হয়তো পেন্সিলের বাড়তি দু’টি দাগ যোগ করতেও হতে পারে!
ডুয়া’স লেয়ার
চোখ যে মনের কথা বলে! আর চোখের কথা অনেকাংশেই বলে কর্নিয়া। কারণ আপনার চোখের ফোকাসিং ক্ষমতার ৬৫-৭৫ শতাংশই বলা চলে কর্ণিয়ার হাতে। ভুলক্রমে চোখে আঙুলের খোঁচা খেলে আপনি মূলত আপনার কর্ণিয়াকে আঘাত করেছেন। পুরো কর্ণিয়ার পুরুত্ব ৫৫০ মাইক্রনের মতো এবং এর আগপর্যন্ত কর্ণিয়াতে পাঁচটি স্তরের দেখা মিলেছে।
মূলত ‘বিগ বাবল টেকনিক’ নামক এক পদ্ধতিতে চোখের বিভিন্ন সার্জারির সময় এই স্তরগুলোকে আলাদা করা গেছে। এই পদ্ধতিতে কর্নিয়ার যেকোনো দু’টি স্তরের মাঝে অল্প অল্প করে বাতাসের ছোট বুদবুদ পাম্প করে স্তরগুলোকে আলাদা করা হয়।
২০১৩ সালে নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হারমিন্ডার ডুয়া ও তার দল মরণোত্তর দান করে যাওয়া ৩১টি চোখের ওপর বিগ বাবল পদ্ধতিতে সিম্যুলেশন ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি চালান। এ সময় আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত অনেক ছোট ছোট বুদবুদ পাম্প করা হয় এবং অনায়াসেই নতুন এই ডুয়া’স লেয়ারের অস্তিত্বের প্রমাণ মেলে। পরবর্তী সময়ে ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে এর গঠন পর্যালোচনা করা হয়। কোলাজেন দ্বারা তৈরি এ স্তরের পুরুত্ব প্রায় ১৫ মাইক্রনের মতো এবং অন্য স্তরগুলোর চেয়ে এটি বেশ শক্ত এবং মজবুত।
কর্নিয়াল হাইড্রপ্স, প্রি-ডিসেমে’স ডিসট্রফি সহ কর্নিয়ার বিভিন্ন রোগের কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসায় এ স্তর নতুন নতুন গবেষণার দরজা খুলে দিয়েছে। একইসাথে এই স্তরটির কাঠিন্য কর্নিয়ার ট্রান্সপ্ল্যান্ট কিংবা সার্জারিকে যে আগের চেয়ে সহজতর করে তুলেছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
ব্রেইনের ড্রেন
লসিকাতন্ত্রের কথা যদি শুনে থাকেন, তবে এ-ও নিশ্চয়ই মনে আছে যে, একে তুলনা করা হয় মানবদেহের ড্রেন বা তরল নিষ্কাশন প্রণালীর সঙ্গে। সহজ করে বলতে গেলে, আমাদের টিস্যুগুলো থেকে উৎপন্ন বাড়তি যে তরল বা বর্জ্য সরাসরি রক্ত সংবহনতন্ত্রে ঢুকতে পারে না, তা লসিকাতন্ত্রের মাধ্যমে পুনরায় সংবহনে অংশ নেয়। অন্যদিকে রোগ প্রতিরোধে অংশ নেওয়া সৈন্যরাও আবার এই লসিকাতন্ত্রের মধ্য দিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এ তো গেলো সাধারণ কথা। কিন্তু মস্তিষ্কে এই লসিকার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে বিজ্ঞানীদের বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আগে ধারণা করা হতো, মস্তিষ্কের তরল বা বর্জ্য সরাসরি সেরেব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইডের মধ্য দিয়ে গিয়ে রক্ত সংবহনে মিশে যেত। কিন্তু তবুও অনেকের মনেই ক্ষীণ সন্দেহ ছিল যে, মস্তিষ্কেও হয়তো থাকতে পারে লসিকার সূক্ষ্ম কোনো গঠন। ২০১৫ সালে দুটি পৃথক গবেষণায় ইঁদুরের মস্তিষ্কের ‘ডুরা ম্যাটার’ অংশে লসিকার প্রমাণ মেলে। এতে বিজ্ঞানীদের সন্দেহ ক্রমেই আরো প্রবল হতে থাকে। বলে রাখা ভালো, মস্তিষ্কের প্রচলিত ইমেজিং কৌশলগুলোতে রক্ত সংবহনতন্ত্র ও লসিকা আলাদাভাবে ধরা পড়ত না, এদের একই রকম মনে হতো।
অবশেষে ২০১৮ সালে একদল গবেষক নতুন একটি ‘স্টেইনিং’ কৌশল এবং বিশেষ এমআরআই কৌশলের সাহায্যে পাঁচজন মানুষ ও তিনটি বানরের মস্তিষ্কে লসিকার অস্তিত্ব প্রমাণ করতে সক্ষম হন। প্রমাণ আরো জোরদার করতে মৃত মানুষ ও বানরের মস্তিষ্কের ব্যবচ্ছেদ করে পরীক্ষা চালানো হয়। সেখানে এমন কিছু কোষ এবং প্রোটিনের দেখা মেলে, যা লসিকা ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
মস্তিষ্কে লসিকাতন্ত্রের অস্তিত্ব মেলার পর বিজ্ঞানীদের অবশ্যই শরীরের অন্যান্য অংশের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। আশার কথা, হয়তো মিলতেও পারে আলঝেইমার বা এ জাতীয় স্নায়বিক রোগতত্ত্বের নতুন কোনো সমীকরণ কিংবা সমাধান।
ইন্টারস্টিশিয়াম
জীববিজ্ঞান সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা থাকলে অনেকেই হয়তো শুনে থাকবেন ইন্টারস্টিশিয়াল ফ্লুইডের কথা। আমরা সবাই জানি, মানবদেহের মোটামুটি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ হলো পানি। এ পানির দুই-তৃতীয়াংশ থাকে কোষগুলোর ভেতরে আর এক-তৃতীয়াংশ থাকে কোষের বাইরের ফাঁকা অংশে, একেই মূলত বলা হয় ইন্টারস্টিশিয়াল ফ্লুইড বা আন্তঃকোষীয় তরল। তাহলে এই ‘ইন্টারস্টিশিয়াল ফ্লুইড’ আর ‘ইন্টারস্টিশিয়াম’ কি একই ধারণারই দুটো ভিন্ন নাম? যদি তা-ই হয়, তাহলে ইন্টারস্টিশিয়ামকে ‘অঙ্গ’ বলা হচ্ছে কেন? আমরা তো জানি, অঙ্গ হতে হলে অনেকগুলো টিস্যুর সমষ্টিকে একই কাজ করতে হয়, কিন্তু এ তো শুধু তরল! সংশয় এড়াতে, চলুন ধারণাগুলো পরিষ্কারভাবে জেনে নিই।
২০১৫ সালের দিকে নিউ ইয়র্কের মাউন্ট সিনাই-বেথ ইসরায়েল মেডিকেল সেন্টারের দুজন ডাক্তার এক রোগীর পিত্তনালীতে ক্যান্সারের লক্ষণ আছে কিনা- তা পরীক্ষা করছিলেন। এক্ষেত্রে তারা যে প্রযুক্তিটি ব্যবহার করছিলেন, তার নাম ‘প্রোব বেজড কনফোকাল লেজার এন্ডোমাইক্রোস্কপি’। একটু কঠিন শোনাচ্ছে নিশ্চয়ই? এটি মূলত এমন একটি প্রোব, যাতে ক্যামেরা, লেজার লাইট এবং সেন্সর যুক্ত থাকে, যা গলার ভেতর দিয়ে নির্ধারিত অঙ্গে প্রবেশ করালে তার ছবি তুলে আনতে পারে। অর্থাৎ, এর মাধ্যমে দেহের ভেতরে জীবন্ত টিস্যু বা কোষের একটি আণুবীক্ষণিক ছবি আপনি সরাসরি দেখতে পারবেন।
এ পরীক্ষার সময়ই তারা দেখতে পান, পিত্তনালীর চারপাশে তরলে পরিপূর্ণ কুঠুরির মতো এমন কিছু খালি জায়গা ছড়িয়ে রয়েছে, যেগুলো আবার একে অপরের সাথে সংযুক্ত। বলা যেতে পারে, ইন্টারস্টিশিয়াল ফ্লুইডকে ধারণ করে রেখেছে কোলাজেন-ইলাস্টিন বা এ জাতীয় কানেকটিভ টিস্যু দিয়ে তৈরি একটি গঠন, অনেকটা অলি-গলিতে ঢুকে ছড়িয়ে পড়া একটি রাজপথের মতো, যেখানে শুধু তরলের যাতায়াত।
পূর্বে যে ধারণা ছিল, তরল শুধুমাত্র এমনিতেই কোষের মাঝের খালি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকে, তা আসলে এমন নয়। তরল আছে ঠিকই, তবে তা টিস্যু দ্বারা তৈরী একটি গঠনের ভেতর। তাহলে তো একে অঙ্গ বলা যেতেই পারে। তখন এর নাম দেওয়া হলো ‘ইন্টারস্টিশিয়াম’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সূক্ষ্ম এই গঠনটি এতদিন ধরে কীভাবে বিজ্ঞানীদের নজর এড়িয়ে গেল?
বিজ্ঞানীরা যখন একটি টিস্যু নিয়ে গবেষণা করেন, তখন মূলত নির্ধারিত অঙ্গ থেকে ব্যবচ্ছেদ করে টিস্যুর পাতলা একটি অংশ আলাদা করে নেন। এরপর তরল ও অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় অংশ ফেলে দিয়ে স্লাইডে নিয়ে মাইক্রোস্কোপের নিচে গবেষণা করা হয়। এ ধাপেই নষ্ট হয়ে যেত কোলাজেন-ইলাস্টিনের সূক্ষ্ম গঠনগুলো। যদি কিছু রয়েও যেত, বিজ্ঞানীরা একে ‘আর্টিফ্যাক্ট’ বা ভুল কিছু বলেই ধরে নিতেন।
পরবর্তী সময়ে সেই গবেষক দলটি আরো ১২ জন মানুষের ওপর গবেষণা করে পিত্তনালীর পাশে একই গঠন দেখতে পান। ক্রমেই ধরা পড়ে যে, এ গঠন মোটামুটি পুরো শরীর জুড়েই ছড়িয়ে আছে। আমাদের ত্বকের নিচে, পরিপাক নালী, ফুসফুস, মূত্রপ্রণালী ইত্যাদি অঙ্গের পাশে, ধমনী-শিরা, অনেক মাংসপেশির চারপাশ জুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে আছে এই ইন্টারস্টিশিয়াম, যা মূলত ‘শক অ্যাবসরবার’ বা আঘাত-প্রশমক হিসেবে কাজ করে।
ক্যান্সার কীভাবে পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে, তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে ইন্টারস্টিশিয়াম থেকে। একটু আগেই কথা বলছিলাম লসিকা নিয়ে। ইন্টারস্টিশিয়ামের তরলগুলো আমাদের শরীরের লসিকানালীর সাথে গিয়ে মেশে। তাই ক্যান্সার কোষগুলো কোনোক্রমে যদি ইন্টারস্টিশিয়ামে ঢুকে যায়, তাহলে সেখান থেকে লসিকানালীর মাধ্যমে সহজেই দেহের অন্য কোনো অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে।
কোনো কোনো বিজ্ঞানী কিন্তু আবার এই আণুবীক্ষণিক গঠনকে ‘অঙ্গ’ আখ্যা দিতে নারাজ। তাদের মতে, সেক্ষেত্রে তো উদরীয় গহ্বর, প্লুরাল স্পেস (ফুসফুসের বাইরের এবং ভেতরের আবরণের মধ্যবর্তী অংশ)- এগুলোকেও আলাদা অঙ্গ বলা উচিত। সে যা-ই হোক, নতুন এই গঠনটি যে ভবিষ্যতে ক্যান্সার কিংবা এ জাতীয় রোগের গতিপ্রকৃতি নির্ণয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এ তো গেলো হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি অংশের কথা। ভ্রূণের গঠনে সরীসৃপের ন্যায় মাংশপেশীর মতো অংশ, হাড়ের নতুন রক্তনালীর জালিকা, দেহে নতুন মাইক্রোবায়োম ব্যাক্টেরিয়ার আবিষ্কার- সম্প্রতি নজরে আসা এমন অজস্র উদাহরণ আমাদের বলতে বাধ্য করে, মানবদেহ বড় আজব এক যন্ত্র!