বিজ্ঞানী সফদর আলীর মহা মহা আবিষ্কার বইটি হয়তো অনেকেই পড়েছেন। সেখানে মূল-চরিত্র আবিষ্কার করে- জ্বলন্ত কয়লার ওপর হেঁটে যাওয়া, অথবা গায়ের নিচে ইস্পাতের সুতীক্ষ্ণ বিছানা বিছিয়ে বুকের ওপরে ইট ভাঙা- এ সবই বৈজ্ঞানিক উপায়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। যে-কেউ সেই উপায় ব্যবহারের মাধ্যমে করে দেখাতে পারে এরকম অভাবনীয় ঘটনা! আদতে তারা এই অসম্ভব কাজগুলো করে না, বিজ্ঞানের কিছু কৌশল আছে এদের পেছনে। সাধারণত কৌশল ছাড়া এ ধরনের কাজ মানুষ পারেও না।
তবে এবার যদি বলি, সত্যিই আছে এমন অনেক মানুষ, যারা কোনো ধরনের উপায় বা পদ্ধতি ব্যবহার না করেই সত্যি সত্যি হেঁটে যেতে পারে জ্বলন্ত কয়লা মারিয়ে? আছে এমন অনেকে, যারা কিনা হাঁটতে পারে পা ফালা-ফালা করে দেওয়া তীক্ষ্ণ ধার কাচের ওপর দিয়ে? বিশ্বাস হবে?
নাহ, এই কাজ করতে জাদু-মন্তরের দরকার হয় না তাদের। হয়তো শুনে বা পড়ে মনে হবে এমন কাজ নিঃসন্দেহে বীরোচিত। না জানি কত লম্বা সময় ধরে, কত কষ্ট করে অর্জন করতে হয়েছে এই যোগ্যতা!
কষ্ট, ব্যথা বা যন্ত্রণা যখন শারীরিকভাবে অনুভূত হয়, তখন বুঝে নিতে হবে, দেহ চাইছে আপনাকে কিছু একটা বলতে। সে বোঝাতে চাইছে- সামনে আছে বড় ধরনের কোনো বিপদ। বলতে পারেন, শারীরিক যন্ত্রণা আসলে এক ধরনের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা। বড় ধরনের কোনো সমস্যা হবার আগেই যেন প্রতিকুল পরিবেশ থেকে আমরা সরে আসতে পারি সেজন্যই জন্ম এই ব্যথা।
বললে কি বিশ্বাস করবেন, প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় চৌদ্দ বিলিয়ন মানুষ ব্যবহার করে ব্যথা কমাবার ওষুধ? প্রতি বছর প্রতি দশজন প্রাপ্ত-বয়স্ক মানুষের মাঝে নিদেনপক্ষে একজন ‘ক্রমাগত ব্যথা’ বা ক্রনিক পেইন-এর রোগী হিসেবে স্বীকৃতি পান? সাধারণত এ ধরনের রোগীকে ভুগতে হয় এক থেকে সাত বছর।
সে যাই হোক, মন্দভাগ্য নিয়ে জন্মানো এমন অনেক মানুষ আছেন, যাদের দেহে বিশেষ এই আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থাটি নেই; জন্মগতভাবেই নেই। বিশেষ এই রোগটির নাম- কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়া, অথবা জন্মগতভাবে ব্যথা অনুভব না করার রোগ।
শুনে মনে হতে পারে, এ আর মন্দ কী? বরঞ্চ ভালো। বিশ্বায়নের এই যুগে, এমন কাউকে বোধহয় খুঁজে পাওয়া যাবে না যে ‘সুপারহিরো’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়। মানুষের মাঝে থেকে যারা বিশেষ, যাদেরকে আমরা ডাকি ‘অতিমানব’ বলে। এদের কেউ উড়তে পারে, কেউ দৌড়াতে পারে আলোর গতিতে, কেউ বা পারে পরিচয় দিতে অসাধারণ শারীরিক ক্ষমতার। ব্যথা অনুভব করতে না পারার ক্ষমতাটাকে কি সেই কাতারে ফেলা যায় না?
নাহ, যায় না। কারণ একদম পরিষ্কার। এই বিরল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা জন্মগতভাবেই অসুস্থ। সেই ছোট্ট বয়সে, যখন কথা বলার ক্ষমতাও হয়নি, তখন থেকেই। ভাবতে পারেন, যে শিশুটি এই রোগে ভোগে, এমন কাজ করলে তার অবস্থা কী হবে? তার জিহ্বা, মুখ পুড়ে যাবে, কিন্তু তার বাবা-মা জানতেও পারবে না।
প্রকৃতপক্ষে হয়ও তাই। ব্যথার কোনো অনুভূতি না থাকায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই রোগের রোগীরা প্রাপ্তবয়সে পা দিতে পারে না। রোগটা বিরল। এমন বিরলত্বের কারণটাও বিরল। এই রোগের আক্রান্ত হতে হলে বাবা-মা উভয়কে হতে হবে এর জন্য দায়ী ত্রুটিপূর্ণ জীনের বাহক। যেহেতু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরা প্রাপ্তবয়সে উপনীতই হন না, তাই সন্তান জন্মদানের সম্ভাবনাও থাকে না। আর তাই আমরাও খুব একটা বেশি দেখতে পাই না এমন রোগী।
মেডিক্যাল কমিউনিটির কেস রিপোর্ট অনুসারে, এদের অধিকাংশের জিহ্বার একটা অংশ থাকে না। দাঁত ওঠার সময় কামড়ে রোগীই তা ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। এছাড়াও আছে হাত-পা ভাঙা, আগুনে বা গরম তরলের কারণে দেহের নানা অংশ পুড়ে যাওয়া, পর্যাপ্ত পরিমাণে অশ্রু তৈরি না হওয়া এবং এর কারণে চোখের কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, শরীরের ওজনবাহী বড় বড় অস্থি-সংযোগসমূহ ক্ষয়ে যাওয়া ইত্যাদি মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী সমস্যা।
বাবা এবং মা, উভয়েই যদি ত্রুটিপূর্ণ জীনের বাহক না হন, তাহলে সন্তানের কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা নেই। ঠিক কোন জীনটার সমস্যার কারণে এই রোগের বহিঃপ্রকাশ হয় তা নিশ্চিত করে জানা না গেলেও, ধারণা করা হয় যে SCN9A, NTRK1 এবং PRDM12-CIP: বাবা এবং মা, উভয়ের এই জীনগুলোতে বা এগুলোর কোনো একটিতে ত্রুটি থাকলে তাদের চার সন্তানের মাঝে একটি জন্ম নেয় রোগাক্রান্ত হয়ে। দুই জন হয় এর বাহক এবং একজন সম্পূর্ণ স্বাভাবিক।
সম্ভবত কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মাঝে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে অ্যাশলিন ব্লকার। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক সাংবাদিকের জবানীতে তার একটি দিনের ক্ষুদ্র একটু সময়ের বর্ণনা তুলে ধরছি-
ব্যথার প্রতি অ-সংবেদী মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে রান্নাঘরে, রামেন নুডলস রান্না করার কাজে ব্যস্ত। গরম পানি ঢেলে চামচ নিয়ে নাড়ছে নুডলস, এমন সময় চামচখানা হাত ফসকে পড়ে গেল গরম পানিতে। পরেরদিন স্কুলে যেতে হবে, টিভিটা আবার বসার ঘরে। ওখানেই কাউচে বসে কাপড় ভাঁজ করছেন তার মা। কোনো কিছু না ভেবে, যেন অবচেতন মনেই অ্যাশলিন ব্লকার চামচ তোলার জন্য হাত ডুবিয়ে দিল উত্তপ্ত পানিতে!
কী করেছে তা বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে হাত বের করে আনল, তারপর ওভেনের আলোতে পরখ করল কিছুক্ষণ; অতঃপর কয়েক পা হেঁটে চলে এল সিঙ্কের কাছে। ফোস্কা পড়া জায়গাটায় ঠাণ্ডা পানি ঢেলে মাকে ডেকে বলল, ‘গরম পানিতে আঙুল ডুবিয়ে ফেলছি!’ ওর মা, সঙ্গে সঙ্গে কাপড় ভাঁজ করা ফেলে ছুটে এলেন মেয়ের কাছে। ‘হায়, খোদা!’ আঁতকে উঠলেন তিনি। তেরো বছর পরও, আজও একই ভয় কাজ করে তার মনে। এরপর দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলেন বরফ, মেয়ের হাতে আলতো করে লাগিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর হাতের অবস্থা দেখে তারপর শান্ত হলো মায়ের মন, নাহ। খুব একটা পোড়েনি!
ছোট বাচ্চারা কথা বলতে পারে না; তাই বলা যায় যে তাদের অনুভূতি প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে কান্না। অথচ কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়ায় আক্রান্ত বাচ্চা যেহেতু ব্যথাই বোধ করতে পারে না, তাই সে প্রতিকূল কোনো পরিস্থিতিতে পড়লেও তা জানান দিতে পারে না বাবা-মাকে।
পেটে ব্যথা? আগে তার নিজের তো বুঝতে হবে যে সে ব্যথা পাচ্ছে, তারপর না জানাবে চিৎকার করে! দাঁতে যন্ত্রণা? সেক্ষেত্রেও খাটে একই কথা। এ জন্য দেখা যায়- এই রোগের আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী মারা যায় এমন সব কারণে, যার চিকিৎসা খুবই সহজ। আফসোসেস কথা, কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়ায় আক্রান্ত অধিকাংশ রোগী বয়েস দুই বছর হবার আগেই মারা যায়।
সন্দেহ নেই, চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে অভাবনীয়। প্রতিদিন আবিষ্কার হচ্ছে নতুন নতুন রোগের চিকিৎসা, ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যসেবা বাড়িয়ে দিচ্ছে আমাদের গড় আয়ু এবং জীবনযাত্রার মান। তাই বিরল হলেও আমরা আশা করতেই পারি যে কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়া মোকাবেলা করার মোক্ষম একটা অস্ত্র নিশ্চয়ই আছে তার কাছে।
তবে আফসোসের কথা হলো- আজও আমরা আবিষ্কার করতে পারিনি সেই অস্ত্র, আজও কনজেনিটাল অ্যানালজেসিয়ার চিকিৎসা রয়ে গিয়েছে আমাদের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ভবিষ্যতে হয়তো কোনো একদিন সেই আবিষ্কারটি আমরা করতে পারবো।