শরীরের কোনো অংশ পুড়ে গেলে মাখন লাগিয়ে দিন, সাপে কাটলে ডাক্তার আসার আগে ক্ষতস্থানে মুখ লাগিয়ে বিষ বের করে নিন, জঙ্গলে হারিয়ে গেলে মসজাতীয় উদ্ভিদ দেখে দিক নির্ণয় করা যায়, এরকম আরো অনেক বেঁচে থাকার জন্য করণীয় প্রচলিত রয়েছে, যেগুলো আমরা ধ্রুব সত্য হিসেবেই মানি। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই রয়েছে এরকম অনেক শ্রুতিকথা, যেগুলো মানুষ বিশ্বাস করে এবং ধারণা করে যে এসব জানা থাকলে যেকোনো পরিস্থিতি থেকেই বেঁচে ফেরা সম্ভব। অথচ, এই ধারণাগুলোর অধিকাংশই এমন যে, সেগুলো আপনাকে বাঁচাবে তো না-ই, বরং মেরে ফেলার সম্ভাবনাই বেশি! আপনি নিজেও নিশ্চয়ই এরকম অনেক তথ্য জেনে থাকবেন। সেগুলো তাহলে একবার মিলিয়ে নিন।
সাপের বিষ চুষে বের করা
এই ধারণাটি অধিকাংশের মনে বদ্ধমূল হয়েছে সম্ভবত বাংলা চলচ্চিত্রের কল্যাণে। নায়িকাকে সাপে কাটলে তৎক্ষণাৎ নায়ক ক্ষতস্থানে মুখ লাগিয়ে সব বিষ বের করে নিচ্ছেন, আর নায়িকা সুস্থ হয়ে উঠছেন। সিনেমায় এটা সম্ভব হলেও বাস্তবে অসম্ভবের পর্যায়ে। শুধু তা-ই নয়, জীবন বাঁচাতে গিয়ে উল্টো আপনিও বিষে নীল হতে পারেন! কেননা, কাউকে সাপে কাটার সাথে সাথে সাপের বিষ ঐ ব্যক্তির রক্তপ্রবাহে চালিত হয়। আপনি যা করতে পারেন, তা হলো- ক্ষতস্থানটি যথাসম্ভব শক্ত করে বেঁধে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া। মুখ লাগালে বরং সে স্থানে বাড়তি কিছু ব্যাকটেরিয়া ছড়াবে। আর কিছু বিষ মুখে চলে আসলে এবং লালার সাথে ঘটনাক্রমে পাকস্থলীতে পৌঁছলে সাপের কামড় না খেয়েও আপনি হতে পারেন ভুক্তভোগী! উল্লেখ্য, সামান্য পরিমাণ সাপের বিষ পাকস্থলীতে হজম হয়ে যায়। তথাপি, অন্ননালীতে কোনোরূপ ক্ষত থাকলেই হিতে বিপরীত হতে পারে।
ভালুকের আক্রমণে মৃতের ভান
ভালুক এবং দুই বন্ধুর গল্প কে না পড়েছে? আর সে গল্পের কল্যাণে আমরা সবাই মোটামুটি নিশ্চিত যে, অপ্রত্যাশিত ভালুকের আক্রমণে কিছু না করে মৃতের শুয়ে থাকতে হবে, তাহলেই বিপদ কেটে যাবে। আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে, আপনি এতদিন ভুল জেনে এসেছেন! যদি কোনো ভালুক আক্রমণ করে, তাহলে পালানোর সামান্যতম উপায় থাকলে প্রথম করণীয় পালিয়ে বাঁচা। অন্যথায়, ভালুক এবং তার আক্রমণের ধরনের উপর নির্ভর করবে আপনার করণীয়।
কালো রঙের ভালুকের সামনে মৃতের মতো শুয়ে পড়লে সেটি আপনার শরীরের উপর শিবের মতো তাণ্ডব নৃত্য করে চলে যাবে! অন্যদিকে, বাদামী বা ছাইরঙের ভালুক সাধারণ সরাসরি আক্রমণ করে না। বরং, এরা নিজেদের বা সন্তানের নিরাপত্তা ঝুঁকি মনে করলে তর্জন-গর্জন করে আপনাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইবে। সেক্ষেত্রে ভদ্রভাবে পিছু হটাই করণীয়। কিন্তু, ভাগ্য বেশি খারাপ হলে ভালুকটি আক্রমণ করেও বসতে পারে। তখন পেটের দিক দিয়ে শুয়ে পড়ে হাত দিয়ে কাঁধ ঢেকে রাখতে হবে (ভালুক সাধারণত কাঁধে আঁচড় কাটে)।
মরুভূমিতে ক্যাকটাসই বন্ধু
মরুভূমিতে কোনোক্রমে পথ হারালে সবচেয়ে বড় ভয় হলো জলতৃষ্ণা। বিশাল মরুভূমিতে অনাহারের আগে তৃষ্ণাতেই মানুষ মারা যায়। এক্ষেত্রে অনেকেই ক্যাকটাসকে বিপদের সঙ্গী ভাবেন। মরুভূমির একধরনের পিপাকৃতির ক্যাকটাসে জমা থাকে স্বচ্ছ পানি। এ পানি পান করে যদি দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকার চিন্তা করেন, তাহলে বিপদ আরো বাড়বে বৈ কমবে না। কেননা গবেষকগণ বলেছেন, সিংহভাগ ক্যাকটাসের পানিই কিছুটা বিষাক্ত, যা পান করলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে, বমি হয়। ফলে, তীব্র পানি এবং খাদ্য সংকটের মাঝে বমি করে শরীরের মূল্যবান তরল ফেলে দেওয়া মৃত্যুকে আরেকটু কাছে ডেকে আনারই অনুরূপ!
মস দিয়ে দিক নির্ণয়
জঙ্গলে হারিয়ে গেলে দিক নির্ণয়ের জন্য মস উদ্ভিদ দিক নির্ণয়ে সহায়তা করতে পারে বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। লোককথা অনুযায়ী, মস উদ্ভিদ কোনো বড় বৃক্ষের দক্ষিণ দিকে জন্মে। আর স্বাভাবিকভাবে দক্ষিণ দিক নির্ণয় করতে পারলে সব দিকই নির্ণয় করতে পারবেন। কিন্তু, এই তথ্যটির কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। উদ্ভিদবিদগণ বলেছেন, মস উদ্ভিদ বৃক্ষের যেকোনো দিকেই জন্মাতে পারে।
চেরাস্রোতে কূলের সমান্তরালে সাঁতরানো
সমুদ্রে সাঁতার কাটতে গিয়ে চেরাস্রোতে পড়ে গেলে কূলের সমান্তরালে সাঁতার কাটাকেই সর্বোত্তম পন্থা ভাবা হতো। কিন্তু, সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে ভিন্ন তথ্য। সমান্তরালে সাঁতার কাটা যদিও অনেক ক্ষেত্রে কার্যকর, তথাপি স্রোতের কোণ যদি কূলের সাথে ৯০°’র চেয়ে কম হয়, তাহলে আপনি কোনোদিনই আর কিনারায় পৌঁছতে পারবেন না, বরং স্রোত আপনাকে নিয়ে যাবে মাঝ দরিয়ায়। এক্ষেত্রে গবেষকদের উপদেশ, কূলের কথা না ভেবে প্রথমে স্রোতের কোণ আন্দাজ করতে হবে, তারপর সেই কোণের সাথে উল্লম্বভাবে সাঁতার কাটতে হবে।
শার্কের নাকে ঘুষি দিন
সমুদ্র গোসল করতে নেমে শার্কের আক্রমণে পড়লে এর নাক বরাবর ঘুষি দেয়াই প্রাথমিক করণীয় বলে একটি ধারণা প্রচলিত আছে। ধারণাটি, পুরোপুরি ভুল নয়, কেননা নাকের উপর একটি যুতসই ঘুষি পড়লে শার্ক পালাবে। কিন্তু সমস্যা হলো পানিতে হাবুডুবু অবস্থায় দ্রুতবেগে ধাবমান শার্কের ঠিক নাকে ঘুসি দিতে পারবেন তো? আর দিতে পারলেও পানির নীচে তাতে জোর কতটুকু থাকবে? উপরন্তু, শার্কের দেহের অগ্রভাগই হচ্ছে নাক, যা প্রতি মূহুর্তে স্থান পরিবর্তন করে। ফলে নাকে ঘুসি মারতে গিয়ে ব্যর্থ হবার সম্ভাবনাই বেশি। তার চেয়ে বরং হাতের কাছে কিছু থাকলে তা দিয়ে প্রাথমিকভাবে এর কামড় থেকে নিজেকে আড়াল করা উচিত। অতঃপর এর চোখ আর ফুলকায় এলোপাথাড়ি খামচে দিন। নাক থেরাপির চেয়ে চোখ থেরাপি কাজ করার সম্ভাবনা অনেক বেশি।
হাইপোথারমিয়ায় গরম পানি
মানুষের দেহের স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩৭° সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রা ১/২° সেলসিয়াস হ্রাস পেলেই মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়। দেহের তাপমাত্রা যখন ৩৫° সেলসিয়াস বা তার চেয়ে কমে যায় তখন তাকে হাইপোথারমিয়া বলে। হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেহের তাপমাত্রা দ্রুত কমতে থাকে এবং তাপমাত্রার হ্রাস ঠেকাতে না পারলে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়। এক্ষেত্রে মানুষ সাধারণত যা করে তা হলো আক্রান্ত ব্যক্তির হাত, পা, পিঠ দ্রুত ঘষে দেয়া কিংবা গরম পানি ঢালা। কিন্তু আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে দুটি প্রক্রিয়াই ভুল। হঠাৎ করে ঠাণ্ডা ত্বকে ঘর্ষণের মাধ্যমে তাপ উৎপন্ন করতে গেলে খুব বেশি উপকার তো হয়ই না, বরং ত্বকে ব্যাপক ক্ষতি হয়। অন্যদিকে গরম পানি ঢাললেও তাপমাত্রার দ্রুত পরিবর্তনে আক্রান্ত ব্যক্তি বরং নতুন করে ট্রমার শিকার হতে পারেন। ডাক্তারদের পরামর্শ হলো, রোগীর দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে ধীরে ধীরে। রোগীকে চাদর বা কম্বল দিয়ে ঢেকে দেয়া যেতে পারে, তার বগলে মাঝারি গরম পানি ভর্তি বোতল দেয়া যেতে পারে।
পাখির আধাখাওয়া ফল খাওয়া ভালো
এই শ্রুতিকথাটি বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে এবং মফস্বলে বেশ প্রচলিত। বিশেষ করে বরই আর আম যদি খানিকটা খাওয়া হয় (ধরে নেয়া হয় তা পাখি খেয়েছে), তাহলে বলা হয় সেটি অধিক পুষ্টিকর হয়ে গেছে! কোনো সন্দেহ নেই যে, এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। উপরন্তু, ফলটি পাখিতে খেয়েছে না কাঠবিড়াল, সেটিও নিশ্চিত করে জানা সম্ভব না। গবেষণা বলছে, কিছু কাঠবিড়াল আর পাখির খাওয়া ফল এতটা বিষাক্ত হতে পারে যে, তা খেলে মারা যাবারও সম্ভাবনা রয়েছে!
ভারী শীতের কাপড়ের নীচে তুলার সূতিবস্ত্র পরিধান
শীতকালে শীত নিবারণের জন্য আমরা সাধারণত সিন্থেটিক বা উলের কাপড় পরিধান করি। অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা, বহিরাংশের পোশাকের নীচে সূতি কাপড় পরিধানই শ্রেয়। এটি ভুল ধারণা এবং তীব্র ঠাণ্ডায় এটি হাইপোথারমিয়ার কারণ হতে পারে। সূতিবস্ত্র পরিধেয় হিসেবে অসাধারণ। কিন্তু এর পানি শোষণ ক্ষমতাও অনেক বেশি। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তুলার তন্তুগুলো নিজেদের ওজনের ২৭ গুণ অধিক পানি ধারণ করতে সক্ষম। ফলে শরীর ঘামারও প্রয়োজন হয় না, শরীরের স্বাভাবিক আর্দ্রতাই শুষে নিয়ে শীতল হয়ে ওঠে সূতিবস্ত্র। গরমকালে তা উপভোগ্য হলেও শীতকালে পরিবহন প্রক্রিয়ায় দেহ থেকে প্রচুর তাপ বের করে দেয়। অতএব অধিক শীতে প্রধান পরিধেয়র নীচেও সূতিবস্ত্র পরিধান করবার পূর্বে দ্বিতীয়বার ভাবুন।
উড়ন্ত পাখি দেখে পানির উৎস জানা যায়
জঙ্গলে কিংবা মরুভূমিতে হারিয়ে গেলে পাখি যেদিকে উড়ছে সেদিকে কখনোই যাবেন না। হ্যাঁ, এ কথা অনেকের কাছে যদি শুনেও থাকেন তাহলে আজই ভুলে যান। কেননা, পক্ষীবিদগণ বলেছেন, প্রায় কোনো পাখিই পানির উৎস ধরে আকাশে ওড়ে না। একপ্রকারের রাজহংসী আছে যেগুলো সান্ধ্যকালীন সময়ে কোনো নদী বা হাওরের দিকে উড়ে যায় গোসল করবার জন্য। কিন্তু তাদের এ অভ্যাসটিও নিয়মিত নয়। পাখি কোথায় যাবার জন্য আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে তা কখনোই নির্ধারণ করা সম্ভব নয়।
পানির তীব্র সংকটে প্রয়োজনে নিজের মূত্র পান
বেয়ার গ্রিলসের ‘ম্যান ভার্সাস ওয়ার্ল্ড’ অনুষ্ঠানটি দেখার পর অন্তত এটা সবাই বিশ্বাস করেন যে, তীব্র পানির সংকটে নিজের মূত্রও পান করা সম্ভব, কারণ এটি স্টেরাইল। অথচ পানির তৃষ্ণায় ক্লান্ত অবস্থায় এটি হতে পারে ভয়াবহ ভুল। কেননা, মূত্র এমনিতেই দেহের যাবতীয় দূষিত পদার্থ বহন করে। তার উপর পানির পিপাসায় ঘেমে-নেয়ে ডিহাইড্রেটেড একজন মানুষের মূত্র অধিক বিপদজনক। এটি পান করে বরং পেটের পীড়ায় অবস্থা আরো বেগতিক হতে পারে। উপরন্তু, আধুনিক অনেক গবেষণাই বলছে মূত্র স্টেরাইল নয়। তার চেয়ে বরং মূত্র দিয়ে যদি শরীরের পরিধেয় ভিজিয়ে রাখা যায়, তাহলে বরং দেহে কম তাপ শোষিত হবে এবং ঘাম কম হবে কিছু সময়ের জন্য।
তুষার খাওয়া যাবে পানির বিকল্প হিসেবে
ধরুন, আপনি যে স্থানে বসবাস করেন সেখানে তীব্র পানির সংকট দেখা দিল। আপনার এলাকায় যদি তুষারপাত হয়, তাহলে কি আপনি পানির সংকট তুষার দিয়ে মেটাবেন? অবশ্যই মেটাতে পারেন, তবে তুষার অবশ্যই গলে পানি হতে হবে। অন্যথায় তুষার খেলে বিপদ আছে। হলুদ তুষার তো এমনিতেই খেতে নিষেধ। শ্বেত তুষারের মাঝেও প্রচুর জমাট বাতাস থাকে। এই বাতাসের সর্বনিম্ন অনুপাত ৯:১! অর্থাৎ, প্রতি ৯টি বাতাসের অণুর বিপরীতে পানি থাকছে মাত্র ১ অণু! এতে পানির পিপাসা মেটানোর জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি তুষার খেতে হবে, যা হাইপোথারমিয়া তৈরি করবে।