আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল’স (UAVs), যাকে আমরা ড্রোন হিসেবেই সবচেয়ে বেশি জানি। ১৯৮০ সালের পর থেকেই বাণিজ্যিকভাবে ড্রোনের ব্যবহার হয়ে আসছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে এর ডিজাইন এবং ব্যবহারের পরিধিও বদলে যাচ্ছে। ড্রোনকে আরও মানুষের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলে, নানাবিধ ব্যবহারের জন্য বড় পরিসরে চিন্তা ভাবনা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তেমনই একটি ক্ষেত্র হচ্ছে কৃষিখাত।
সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে ড্রোনের ব্যবহারের আর্থিক বাজারমূল্য প্রায় ১২৭ বিলিয়ন ডলার, যার একটি বৃহৎ অংশ হচ্ছে কৃষিখাত। ধারণামতে, ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর জনসংখ্যা গিয়ে পৌঁছাবে ৯ বিলিয়নে। এই বিশাল সংখ্যক জনসংখ্যার জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন হারও বাড়াতে হবে। বর্তমানে যে পরিমাণ শস্য পৃথিবীব্যাপী উৎপাদিত হয়, তাতে জনসংখ্যা বাড়ার কারণে রিজার্ভ রাখা সম্ভব হবে না। বরং আমাদের ভাবতে হবে এমন এক বিকল্প ব্যবস্থার, যার মাধ্যমে সময় অপরিবর্তিত রেখেই প্রায় দ্বিগুণ খাদ্যশস্য উৎপাদন করা যায়।
উৎপাদন ব্যবস্থা নিয়ে যখন কথা বলছি, তখন আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়েও ভাবতে হবে আমাদের। কারণ ততদিনে পৃথিবীর জলবায়ুতে বিশাল একটি পরিবর্তন দেখা দেবে। আমাদেরকে সেটার সঙ্গে মানানসই কৃষি ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, সেই সাথে ভবিষ্যতের জন্য যাতে আরও বেশি খাদ্য মজুদ রাখা যায় তারও ব্যবস্থা করতে হবে। তাই ড্রোনের ব্যবহারকেই একমাত্র উপায় দেখছেন বিজ্ঞানীরা। কৃষিখাতের উপযোগী করে গড়ে তুলে শস্য উৎপাদনবান্ধব হিসেবে আরও বৃহৎ পরিসরে এর পরিচিতি ঘটানোর দিকেই এখন সবার নজর।
শস্য উৎপাদনের সাথে জড়িত সবগুলো ধাপেই কিন্তু ড্রোনের ব্যবহার রয়েছে। বীজ রোপণ, পরিচর্যা, রোগ-জীবাণু দমন এবং প্রতিনিয়ত তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে এটা আমাদের জন্য কাজ করতে পারবে। কৃষির বেশ কয়েকটি ধাপে ড্রোনের ব্যবহার নিয়েই আজকের লেখাটি।
১. মাটি ও জমির তথ্য সংগ্রহ
নির্দিষ্ট শস্য উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের মাটির প্রয়োজন হয়। কোনো একটি এলাকার মাটি কোন ধরনের শস্য উৎপাদনের উপযোগী সেটা আগে থেকেই জেনে নিতে হয়। কারণ সব মাটিতে সব শস্য জন্মায় না। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মাটির উপাদানেও প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। আজ যে মাটিতে ধান জন্মাচ্ছে, আগামী কয়েকবছর পর হয়তো একই জমিতে একই পরিমাণ ধানের উৎপাদন না-ও হতে পারে। এমন পরস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য মাটি পরীক্ষা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মাটির উপাদানের পরিবর্তন ড্রোনের মাধ্যমেই বুঝতে পারা যাবে, যদি এই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়।
মাটির আর্দ্রতা নির্ণয়, বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতি যাচাই, জমির পরিমাণ অনুসারে শস্য রোপনের ডিজাইনও ড্রোন করতে পারবে। অনেক সময় বড় আকারের জমিতে শস্য রোপণের সময় প্রচুর জায়গার অপচয় হয়, কিন্তু ড্রোনের মাধ্যমে আগে থেকেই যদি কোথায়, কীভাবে, কী পরিমাণ রোপণ করা হবে সেটা হিসেব করে নেওয়া যায়, তবে জায়গার অপচয় কমানো সম্ভব।
২. রোপণ
জমি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহের পর বীজ রোপণেও ড্রোনের ব্যবহার রয়েছে। চীন এবং জাপানে ইতোমধ্যে বিশেষ ড্রোনের ব্যবহার রয়েছে, যেগুলো মাটির একটু উপর থেকে বীজ রোপণ করতে পারে। সহজেই নিয়ন্ত্রণযোগ্য ড্রোনের মাধ্যমে বড় আকারের জমিতে অল্প সময়ের ভেতরই বীজ রোপণ করা সম্ভব হবে, যেখানে বর্তমানে প্রচুর সময় এবং লোকবলের প্রয়োজন হচ্ছে। বর্তমানে বীজ রোপণের প্যাটার্ন ঠিক রেখে ড্রোনগুলো ৭০ শতাংশের বেশি বীজ নির্ভূল জায়গায় রোপণ করতে সক্ষম।
তাই ভবিষ্যতে আমাদেরকে এই ভুলের পরিমাণ আরও কমিয়ে মোট উৎপাদন হার আরও বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে। তবেই শস্য উৎপাদনে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে সময় ও লোকবল সাশ্রয় হয়েছে বলে ধরা যাবে।
৩. পর্যবেক্ষণ এবং স্প্রে
কোনো শস্য উৎপাদনে একটা বড় সময়জুড়ে শস্যগুলোকে প্রতিনিয়ত পর্যবেক্ষণ করতে হয়। কারণ কাঙ্ক্ষিত উৎপাদন ব্যবস্থাকে ব্যহত হয়ে যেতে পারে, যদি জমিতে বিভিন্ন পোকার আক্রমণ ঘটে এবং শস্য সেগুলোর মাধ্যমে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে যেসব প্রযুক্তি এবং কৃষি যন্ত্র ব্যবহৃত হয় সেগুলো মূলত বড় পরিসরে পর্যবেক্ষণের জন্য যথেষ্ট নয়।
আমাদের মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতে আমাদেরকে আরও বেশি পরিমাণে শস্য উৎপাদন করতে হবে। কিন্তু এখন যেসব যন্ত্রের ব্যবহার রয়েছে, সেগুলো পরিবর্তিত পরিবেশ এবং বৃহৎ পরিসরের জন্য মানানসই নয়। তাছাড়া একটি বড় অঞ্চলে শস্য উৎপাদন করতে গেলে প্রায়ই সবগুলো শস্য পর্যবেক্ষণ করে সেগুলোকে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ফসলের ফলন একেবারই কমে যায়, যে পরিমাণ ফসল আক্রমণ থেকে বেঁচে যায় সেগুলোর মানও কমে যায়।
যার সমাধান লুকিয়ে আছে ড্রোনের ব্যবহারের ভেতর। ইমেজিং প্রযুক্তির ব্যবহার ঘটিয়ে শস্যের নির্দিষ্ট কোনো অংশে যদি পোকার আক্রমণ ঘটে সেটা বের করা যায়। ড্রোনে ব্যবহৃত ক্যামেরার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সহজেই কোনো নির্দিষ্ট পোকার আক্রমণ ঘটেছে কি না, কোন অংশে কী পরিমাণ শস্য আক্রমণের শিকার সেটা জানা যায়।
মজার ব্যাপার হলো, এখন আমাদেরকে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে, যে কাজটা ড্রোন অনায়াসেই করতে পারে! তাকে কেবল সেভাবে নির্দেশনা দিতে হবে কোথায়, কী পরিমাণ কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।
এর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি লাভ রয়েছে। জমিতে আগে যে পরিমাণ শ্রম, সময় এবং অর্থ খরচ করে কীটনাশক দেয়া যেত, ড্রোন ব্যবহারের ফলে সেটা প্রায় ৭০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব! তাছাড়া কীটনাশক প্রয়োগে যেসব ভুল-ভ্রান্তি সাধারণত হয়ে থাকে, সেগুলোও কমে যাবে প্রাপ্ত তথ্যের সঠিক যাচাইয়ের কারণে। পোকার আক্রমণ ছাড়াও জমিতে বিভিন্ন প্রাণী ও পাখি ফসলের ক্ষতি করতে পারে। সেন্সর ব্যবহারের মাধ্যমে এরকম অযাচিত অতিথিদের তাড়িয়ে দিতেও ব্যবহার হতে পারে ড্রোন!
ফসল বেড়ে ওঠার সময় থেকে সংগ্রহের আগপর্যন্ত মাটির পরিবর্তনের দিকে নজর রাখতে হয়। বর্তমানে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে সহজেই মাটির অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা যায়। কিন্তু এর কিছু নেতিবাচক দিক রয়েছে। এই পদ্ধতিতে প্রতিদিন কেবল একবার মাটির ছবি পাওয়া সম্ভব, সেই সাথে প্রচুর খরচও গুনতে হয়। কিন্তু ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে দিনের যেকোনো সময়েই মাটির ছবি সংগ্রহ করা সম্ভব যতবার ইচ্ছে, সেই সাথে নিজস্ব ড্রোনের কারণে কেবল চার্জিং খরচ ছাড়া আর কোনো খরচই নেই!
৪. সেচ ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা
মাটিতে পানির উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য আদিমকাল থেকেই সেচ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সঠিক পরিমাণ পানি যেমন শস্যের গুণগত মান রক্ষা করে, তেমনি অতিরিক্ত পানিও ফসলের জন্য ভালো ফল বয়ে আনে না। তাই প্রয়োজন হচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থার, যার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সঠিক স্থানে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সেচ দিয়ে ফসলের বৃদ্ধি নিশ্চিত করা যাবে।
আর এই কাজটি করবে ড্রোন। ড্রোনে ব্যবহৃত থার্মাল প্রযুক্তি ফসলি জমির সবদিক থেকে মাটির তাপমাত্রার তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম। যেসব তথ্য বিশ্লেষণ করে কোনো স্থানের মাটিতে পানির ঘাটতি থাকলে সেটা জানা যাবে, সেই সাথে পানির উপস্থিতির ভিত্তিতে শস্যগুলো সঠিক পরিমাণে পানি গ্রহণ করছে কি না সেটাও বুঝতে পারা যাবে। এতে করে পরবর্তী সময়গুলোতে পানির অপচয় রোধ হবে অনেকাংশে, অতিরিক্ত পানি গ্রহণের কারণে ফসলেরও ক্ষতি হবে না আর।
দৃশ্যমান আলো এবং ইনফ্রারেড প্রযুক্তির কল্যাণে আলাদাভাবে প্রতিটি গাছ ও শস্যে ব্যাকটেরিয়া কিংবা ফাঙ্গাস আক্রমণের উপস্থিতি জানা যাবে। তখন কৃষক চাইলে নিজেই আলাদাভাবে সেই নির্দিষ্ট শস্যের দিকে নজর দিতে পারেন কিংবা ড্রোনকেই দায়িত্ব দিতে পারেন! এতে ফসলের বৃদ্ধির সময়টা জুড়ে পুরোপুরি আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে এবং কৃষকও কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।
ভাবতে হবে আরও দূরে
আমাদের পরবর্তী সময়গুলো যেহেতু আরও কঠিন, এমন পরিস্থিতিকে সামাল দিতে হলে আমাদের প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের কাজের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে সময়, লোকবল এবং প্রকৃতি নিজে। তাই উৎপাদন ব্যবস্থাকে সচল রেখে মানবজাতির খাদ্যের চাহিদা মেটাতে হলে আমাদের আরেকবার ভাবতে হবে, পরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া এখন থেকে আর সম্ভব নয়।
অপরিকল্পিতভাবে এগোনোর চিন্তা থাকলে সেটা ভবিষ্যতে মানুষের খাদ্য সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। খাদ্যের সংকট তুমুল আকার ধারণ করার আগেই আমাদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো ছাড়া আমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই। কারণ আমরা ইতোমধ্যে প্রকৃতির যথেষ্ট ক্ষতি সাধন করেছি, সেটা হয়তো পুরোপুরি পুষিয়ে দেয়া সম্ভব নয়, কিন্তু আসন্ন জলবায়ু পরিবর্তনের বৃহৎ ক্ষতি থেকে অনেকাংশেই পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব।
বাংলাদেশ যেহেতু কৃষিনির্ভর দেশ, তাই আমাদেরকে ভাবতে হবে আরও বেশি। কারণ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমরা ইতোমধ্যে টের পেতে শুরু করেছি। জনসংখ্যা অনুপাতে আমাদের উৎপাদন ব্যবস্থাও সন্তোষজনক নয়। তাই ভবিষ্যতের পথে হাঁটতে গেলে আমাদেরকে পরিকল্পিত কৃষিব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কৃষির জন্য বাজেট বাড়াতে হবে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকদেরও প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহী করে তুলতে হবে, কারণ তারাই মূল কাণ্ডারি। ভবিষ্যতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হলে তাই আমাদেরকে আরেকবার ভাবতে হবে।