আইনস্টাইনের ‘স্পেশাল রিলেটিভিটি থিওরি’ প্রকাশের আগে ধরে নেওয়া হয়েছিল সময় এই মহাবিশ্বের একটি ধ্রুব বৈশিষ্ট্য। আইনস্টাইন দেখালেন, ‘সময় ধ্রুব’, ধারণাটি একটি বিভ্রম। অন্য মাত্রার (Dimension) মতো সময়ও আপেক্ষিক। কিন্তু এই আপেক্ষিকতা অনুভব করার মতো প্রযুক্তি বা সামর্থ্য কোনোটাই আমাদের নেই। এই কারণে সময়ের বেঁধে দেওয়া একটি নির্দিষ্ট গতিতে প্রতিনিয়ত ভবিষ্যতের দিকে হেঁটে চলেছি আমরা। আইনস্টাইন প্রমাণ করলেন, এই গতিকে বহুগুণে বৃদ্ধি করা যাবে যদি আমরা আলোর কাছাকাছি বেগ অর্জন করতে পারি। অর্থাৎ, তখন সময়ের বেঁধে দেওয়া গন্ডির মধ্যে আর মাথানিচু করে আমাদের চলতে হবে না। অনেক কম সময়েই কয়েক শতাব্দী পরের ভবিষ্যতে পৌঁছানো যাবে।
সহজাতভাবেই আরেকটি প্রশ্ন চলে আসে: তাহলে কি অতীতেও ভ্রমণ করা সম্ভব? জেনারেল রিলেটিভিটির সমীকরণগুলো থেকে অনেকগুলো সমাধান পাওয়া যায় যেগুলো অতীত-ভ্রমণ সমর্থন করে। কিন্তু এই সমাধানগুলো কি শুধুই গাণিতিক নাকি আমাদের মহাবিশ্বের জন্যে প্রযোজ্য তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। তবে অতীত-ভ্রমণ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও আমাদের তো সে ব্যাপারে চিন্তা করতে কোনো বাঁধা নেই। এই চিন্তাগুলো থেকেই জন্ম নিয়েছে অনেকগুলো থট এক্সপেরিমেন্ট, অনেকগুলো প্যারাডক্স। লেখকদের কাল্পনিক দুনিয়ার সৌজন্যে উপন্যাস, সিনেমাগুতে প্রতিনিয়ত এই প্যারাডক্সগুলো দেখা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে নেটফ্লিক্সের তুমুল আলোচিত টিভিসিরিজ ‘ডার্ক’ তো কোয়ান্টাম মাল্টিভার্স ও টাইম ট্র্যাভেল প্যারাডক্সকে একত্রিত করে জটিল কাহিনী তৈরি করেছে।
টাইম ট্র্যাভেল প্যারাডক্স কী? সহজ ভাষায় বললে, সময় এবং সময় পরিভ্রমণের সাথে সংযুক্ত অসংগতি। এই প্যারাডক্সগুলোকে মোটা দাগে তিনভাগে ভাগ করা যায়। এগুলো হচ্ছে: বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স, কনসিস্টেন্সি প্যারাডক্স ও নিউকম্ব’স প্যারাডক্স।
বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স
বুটস্ট্র্যাপ প্যারাডক্স তৈরি হয় যখন কয়েকটি ঘটনা চক্রাকারে ঘটতে থাকে কিন্তু তাদের আসল উৎপত্তি বুঝা যায় না। যেমন: ঘটনা ‘ক’য়ের কারণে ‘খ’ ঘটে, ‘খ’য়ের কারণে ‘গ’ ঘটে, আবার ‘গ’য়ের কারণে ‘ক’ ঘটে। এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ চক্রটি কোন ঘটনার মাধ্যমে শুরু হয়েছে তা বের করা যায় না। এ কারণে এই প্যারাডক্সকে ‘কজাল লুপ’ও (Causal Loop) বলা হয়।
‘ডার্ক’ সিরিজে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ থেকে একজন ব্যক্তি এসে বিজ্ঞানী ট্যানহাউসকে একটি বই দিয়ে যায়। পরে তিনি ঐ বইয়ের অনুকরণে একটি বই লিখেন। সেই বইটিই প্রকাশ হওয়ার পরে অতীতে নিয়ে আবার ট্যানহাউসকে দেওয়া হয়। এভাবে একটি কজাল লুপ চলতে থাকে। বইটির প্রকৃত লেখক কে প্রশ্ন করলে, তার উত্তর একটি প্যারাডক্সের জন্ম দেয়। দেখা যায়, বইটি কখনো ট্যানহাউসের মৌলিক ছিল না। কিন্তু, অন্য কাউকেও বইটি লেখার কৃতিত্ব দেওয়া যাচ্ছে না।
অনেক জায়গায় ‘সেলফ ফুলফিলিং প্রোফেসি’কেও কজাল লুপের অন্তর্ভুক্ত ধরা হয়। সেলফ ফুলফিলিং প্রোফেসি এমন ধরনের ঘটনা যেখানে কোনো ব্যক্তির ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয় শুধুমাত্র সে তা বিশ্বাস করার কারণে। এখানে ব্যক্তির কাজকর্মও এই বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। একটি সহজ ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমাদের বিশ্বাসগুলো আমাদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করে এবং সে অনুযায়ী ফলাফলও সেই বিশ্বাস অনুযায়ী বিভিন্ন হয়।
সিনেমাতে ‘প্রিডেস্টিনেশন প্যারাডক্স’ নামে আরেকটি প্যারাডক্স দেখা যায়। এটাও আসলে কজাল লুপের আরেকটি রুপ। ধরা যাক, এক ব্যক্তি অতীতের কোনো ঘটনা পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে টাইম ট্র্যাভেল করে সেখানে গেল। পরে দেখা গেল, সে ব্যক্তিটিই ঐ ঘটনার জন্যে দায়ী। অর্থাৎ, তার অতীত ভ্রমণের কারণেই ঘটনাটি ঘটেছে। প্রথম ঘটনাটি ঘটার ফলে ব্যক্তিটি টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতে গেল এবং শেষে ঘটনাটির কারণ হয়ে দাঁড়াল। এভাবে একটি লুপ তৈরি হয় এবং লুপটি ভাঙা যায় না, যেন তা ভাগ্যে লেখা রয়েছে।
কনসিস্টেন্সি প্যারাডক্স
ধরা যাক, আপনি অতীতে গিয়ে এমন কাউকে হত্যা করলেন যে আজকে জীবিত রয়েছে। কিন্তু অতীতে লোকটি মারা গেলে আজকে জীবিত রয়েছে কীভাবে? তাহলে নিশ্চয়ই লোকটিকে অতীতে গিয়ে হত্যা করা অসম্ভব। হত্যা করতে গিয়ে হয়তো এজন্যে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি হবেন আপনি। আবার এমনও হতে পারে এই সীমাবদ্ধতাগুলো পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের ফলেই তৈরি হয়েছে। এভাবে একবার দেখা যাচ্ছে, তাকে অতীতে মেরে ফেলা সম্ভব। আবার অন্যভাবে চিন্তা করলে দেখা যাচ্ছে যে, তা অসম্ভব। এভাবে একটি প্যারাডক্সের উৎপত্তি হয়েছে। অতীতে গিয়ে কিছু পরিবর্তন করলে এরকম যে অসংগতি তৈরি হয় তাকে কনসিস্টেন্সি প্যারাডক্স বলে।
এই প্যারাডক্সের অনেকরকম সংস্করণ রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে ‘গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স’। কোনো ব্যক্তি যদি অতীতে গিয়ে তার দাদাকে হত্যা করে যখন তার বাবা জন্মায়নি, তাহলে কী হবে? তার বাবা যদি তখনো না জন্মে থাকে তাহলে ভবিষ্যতে সে ব্যক্তিও জন্মায়নি। তাহলে ব্যক্তিটি টাইম ট্র্যাভেল করে অতীতেও যায়নি এবং তার দাদাকে খুনও করেনি। এভাবে প্যারাডক্সটি তৈরি হয়।
গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের মতো আরেকটি প্যারাডক্স রয়েছে যার নাম ‘হিটলার’স মার্ডার প্যারাডক্স’। এক্ষেত্রে চিন্তা করা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের সময়ে গিয়ে কেউ যদি হিটলারকে খুন করে তাহলে কী হবে? লক্ষ্য করুন, হিটলারকে যদি হত্যা করা হয় তাহলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই সংঘটিত হবেনা। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতের কারো হিটলারকে খুন করার কোনো কারণ নেই। অর্থাৎ, গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের মতো এটিও একইভাবে আবর্তিত হচ্ছে। আরেকটি ব্যাপার লক্ষণীয়, হিটলার যদি খুন হয় তাহলে পুরো পৃথিবীর ইতিহাস একেবারে অন্যরকম হবে। অনেকগুলো ঘটনা ঘটতে দেখা যাবে না বা সেগুলো সম্পূর্ণ অন্যভাবে ঘটবে। সে পৃথিবী এখনকার তুলনায় ভালো কি খারাপ আমরা জানি না। অতীতের যেকোনো ঐতিহাসিক ঘটনা পরিবর্তন করতে চাওয়া ‘হিটলার’স মার্ডার প্যারাডক্স’ এর অন্তর্ভুক্ত।
কনসিস্টেন্সি প্যারাডক্সগুলোর একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, যতক্ষণ অতীত পরিবর্তনের চেষ্টা না করা হয় ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো প্যারাডক্স দেখা যায় না। তার কারণ অতীতে গিয়ে তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। এই অসম্ভাব্যতা বিভিন্নভাবে দেখা যেতে পারে। যেমন: গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সের ক্ষেত্রে এমন হতে পারে, দাদাকে খুন করার সময়ে কেউ একজন এসে তাকে বাঁধা দিল কিংবা তার হাত এমনভাবে কেঁপে উঠল যে তার দাদা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেল। এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটতে পারে। ২০০৫ সালের একটি গবেষণায় দুইজন বিজ্ঞানী দেখান যে, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কিছু মৌলিক বৈশিষ্ট্য সম্ভবত নিশ্চিত করে, আমরা কখনো অতীত পরিবর্তন করতে পারব না। খুব সম্ভবত এটাই কনসিস্টেন্সি প্যারাডক্সের সমাধান।
নিউকম্ব’স প্যারাডক্স
এই প্যারাডক্সকে অনেকে টাইম ট্র্যাভেল প্যারাডক্সের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে দেখেন না। এই প্যারাডক্সটি তৈরি করেছেন উইলিয়াম নিউকম্ব। সর্বপ্রথম ১৯৬৯ সালের একটি দর্শন নিবন্ধে এটার বিশ্লেষণ দেখা যায়।
ধরা যাক, দুইজন ব্যক্তি রয়েছে যাদের একজন নিখুঁতভাবে ভবিষ্যৎ বলতে পারে এবং তার ভবিষ্যদ্বাণী কখনোই ভুল হয়নি। আরেকজন ব্যক্তিকে ধরা হলো প্লেয়ার হিসেবে। তাদের সামনে দুইটি বাক্স রয়েছে। প্লেয়ারকে বলা হলো এখান থেকে যে কোনো বাক্স অথবা দুইটিই নির্বাচন করতে। নির্বাচনের আগে প্লেয়ারের যা জানা রয়েছে: প্রথম বাক্সটি স্বচ্ছ এবং ভেতরে এক হাজার ডলার দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় বাক্সটি অস্বচ্ছ এবং এর ভেতরে প্রথম ব্যক্তি ইতিমধ্যেই একটা নির্দিষ্ট অর্থ রেখে দিয়েছে। প্লেয়ার জানে না এই বাক্সে কত ডলার রয়েছে। তবে প্লেয়ার জানে যে, প্রথম ব্যক্তি যদি এটা ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, প্লেয়ার শুধুমাত্র দ্বিতীয় বাক্স নির্বাচন করবে তাহলে সেই বাক্সে এক মিলিয়ন ডলার রেখে দিয়েছে। আর ভবিষ্যদ্বাণী অন্যরকম হলে দ্বিতীয় বাক্সে কোনো অর্থই রাখা হয়নি। কিন্তু প্লেয়ারের জানা নেই প্রথম ব্যক্তির ভবিষ্যদ্বাণী কী।
এক্ষেত্রে দুইটি কৌশল নিয়ে আলোচনা হতে পারে। প্রথম ব্যক্তি যেহেতু নিখুঁতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, তাই প্লেয়ারের উচিত দ্বিতীয় বাক্স নির্বাচন করা। তাহলে সর্বাধিক অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত হবে। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে এটা সঠিক কৌশল।
অন্য কৌশলটি বলে, প্লেয়ারের উচিত সবসময় যে উপায়টি নির্ভুল সেই পথে এগোনো উচিত। ভবিষ্যদ্বাণী যদি শুধু প্রথম বাক্স অথবা দুইটি বাক্সই হয়, সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ‘এক হাজার’ ডলার পাওয়া যাবে দুইটি বাক্স নির্বাচন করলে। অন্যদিকে, ভবিষ্যদ্বাণী যদি শুধু দ্বিতীয় বাক্স হয়, তখনো সর্বোচ্চ ‘এক মিলিয়ন + এক হাজার’ ডলার পাওয়া যাবে দুইটি বাক্স বাছাই করলে। তাই প্লেয়ারের উচিত সবসময়েই দুইটি বাক্স নির্বাচন করা। দুইটি ভিন্ন কৌশল এভাবে প্যারাডক্স তৈরি করছে।
এই প্যারাডক্সটি বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। উইলিয়াম লেন ক্রেইগের ব্যাখ্যা হচ্ছে, নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী অথবা টাইম মেশিনের অস্তিত্ব যে পৃথিবীতে রয়েছে সেখানে ভবিষ্যৎ অতীতের উপর প্রভাব রাখবে। কারণ, ভবিষ্যতের জ্ঞান মানুষের কাজকর্মের উপর বিভিন্ন প্রভাব ফেলবে। অন্য একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে, টাইম মেশিন বা নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণীর অস্তিত্ব থাকলে, স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু থাকবে না। প্লেয়ার তখন সেটাই বাছাই করবে যেটা তার ভাগ্যে বা ভবিষ্যতে আগে থেকেই ঠিক করা আছে। এভাবে প্যারাডক্সটি নানারকম দার্শনিক ধারণা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করে।
পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী আছে কিনা এই ব্যাপারে ‘ফার্মি প্যারাডক্স’ নামে একটি প্যারাডক্স রয়েছে। সম্ভাবনার হিসাব অনুযায়ী এই ব্যাপারে গণিত অনেক আশা দেখালেও আমরা এখনো কোনো প্রমাণের ছিটেফোঁটাও পাইনি। এই হিসাব ও প্রমাণের অসঙ্গতিটি ফার্মি প্যারাডক্সে উঠে এসেছে। টাইম ট্র্যাভেল সম্ভব কিনা এই ব্যাপারেও ফার্মি প্যারাডক্স আলোচনায় আসে। টাইম ট্র্যাভেল যদি সম্ভব হয়ে থাকে তাহলে সুদূর ভবিষ্যৎ থেকে কোনো মানুষ কেন অতীতে আসছে না? নাকি তারা এসেও সুকৌশলে আমাদের থেকে আড়াল হয়ে আছে? তাদের সম্পর্কে যদি আমরা জানি তা হবে ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে তথ্য ভ্রমণ যা কোনো ধরনের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে। সে কারণেই কি এত সতর্কতা? এসব ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আপাতত ভবিষ্যতের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।