অদ্ভুত কোনো ব্যাপার কিংবা নাটকীয় কোনো গল্প কিংবা অলৌকিক কোনো ঘটনার প্রতি মানুষের আজন্ম আগ্রহ। এসব ঘটনা যখন বইয়ের পাতায় কিংবা মানুষের মুখে ‘গল্প’ হিসেবে থাকে, তখন এসবে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা বাধে তখনই যখন এসব ঘটনাকে কেউ ‘সত্য’ বলে দাবী করে। কোনো ঘটনা অলৌকিক কিনা, তা যাচাই করে দেখার চমৎকার একটি পদ্ধতি দিয়েছিলেন স্কটিশ দার্শনিক ডেভিড হিউম। Roar বাংলায় প্রকাশিত ‘অবাস্তবতা ও অলৌকিকতার ব্যবচ্ছেদ‘ নামক লেখায় সেই পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছিল।
সংক্ষেপে এর মর্মার্থ অনেকটা এমন- কেউ যদি এসে কোনো অবাস্তব ঘটনার কথা বলে তাহলে সেটার সত্য মিথ্যা অনেকাংশেই নির্ভর করে বর্ণনাকারী ব্যক্তির উপর। ব্যক্তির পক্ষে মিথ্যা বলা বা ভ্রমে ভুল দেখা যদি ঘটনাটির চেয়ে বেশি পরিমাণ অবাস্তব হয়, তাহলে ঘটনাটি অলৌকিক সত্য হবার সম্ভাবনা আছে। অদ্ভুত ঘটনা ঘটা যতটা অসম্ভব তার চেয়েও বেশি অসম্ভব যদি হয় ব্যক্তির মিথ্যাবাদিতা কিংবা ব্যক্তির ভ্রান্তি (Illusion), তাহলে দাবীকৃত ঘটনাটি সত্য হবার সম্ভাবনা আছে। এই শর্তেই সিংহভাগ অলৌকিকতা বাতিল হয়ে যায়। সামান্য কিছু উৎরে যায়। তবে তারপরেও সেটি পুরোপুরি সত্য হয়ে যায় না। অলৌকিকতার যাচাইয়ের জন্য আরো ছাঁকনি আছে। এর মাঝে সবচেয়ে শক্তিশালী ছাঁকনি হচ্ছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের আলোকে যাচাই করলে হাজার বছরের অলৌকিকতারও মীমাংসা হয়ে যায়।
এবার আমাদের দেশের একদম প্রান্তিক পর্যায়ে চলে যাই। অনেকেই যাদুকর, তান্ত্রিক, সাধু, খনকার প্রভৃতির সাথে পরিচিত এবং অনেকেই বিশ্বাস করেন তারা অলৌকিক কিছু করে ফেলতে পারেন সবার সামনে। অলৌকিক বলতে সে সকল জিনিসকে বুঝানো হচ্ছে যেগুলো বিজ্ঞানের সাধারণ নিয়ম নীতিকে লঙ্ঘন করে। যেমন- কেউ যদি হাওয়ায় ভেসে থাকার দাবী করে এবং তার ভক্তরা এটা অকাট্যভাবে বিশ্বাস করে তাহলে এটি অলৌকিক ঘটনা হতে পারে। কারণ এটি বিজ্ঞানের মহাকর্ষ সূত্রকে লঙ্ঘন করে। পরে যদি দেখা যায় যে সাধুর ভক্ত ভুল দেখেছে বা ধোঁকার শিকার হয়েছে, তাহলে সেটি অলৌকিকতা থেকে বাদ পড়ে যাবে। যারা এসব সম্পর্কে খোঁজ খবর রাখে, তারা সকলেই জানে এ ধরনের কথিত সাধুরা কৌশলে কোনো একটি অবলম্বন ব্যবহার করে থাকে যা ভক্ত বা দর্শকের চোখে ধরা পড়ে না।
এখন ধরি কেউ একজন এসে বললো ‘নীলমনিরহাট’ নামক অঞ্চলে একজন খনকার আছে, তিনি যদি কোনো বিড়িতে ফুঁ দিয়ে দেন এবং পরে সেই বিড়ি কেউ খেলে যেকোনো রোগ সেরে যাবে। এমনকি এসব রোগের মাঝে ফুসফুসের সমস্যাও আছে! কারো ফুঁ দেয়া বিড়িকে মানুষ ওষুধ হিসেবে পান করে এবং খায় এটা বিশ্বাস হচ্ছে না? এটি সত্য, বাংলাদেশেরই খুব বিখ্যাত একটি জেলায় এটি প্রচলিত। বিশেষ এই বিড়ি পড়া নিয়ে ইটিভি’র একটি প্রতিবেদনও হয়েছে।
আবার ধরি কেউ একজন এসে একটি অদ্ভুত কাহিনী বললো। ‘নীলমনিরহাট’ অঞ্চলে কয়েক শত বছর আগে ঘটেছে এটি। সেখানে একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ছিলেন। একবার তিনি এক খৎনার অনুষ্ঠানে গেলেন। সেখানে এক মুহূর্তে সুমিষ্ট পানীয় বা সুরা (Wine)-র ব্যবস্থা ছিল। একপর্যায়ে সম্পূর্ণ যোগান না মিটিয়েই সুরা শেষ হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে তিনি বললেন তার কাছে যেন কিছু পানি নিয়ে আসে। আনা হলে সেই পানিকে তিনি তার অলৌকিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সুরায় রূপান্তর করে দেন। এই সুরা ছিল অতীব সুমিষ্ট ও উপাদেয়। এই ঘটনাটিকে যদি আমরা ডেভিড হিউমের অলৌকিকতা শনাক্তের ছাঁচে ফেলি, তাহলে এর জন্য তিনটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা পাবো।
১. ঘটনাটি আসলেই ঘটেছিল। পানি রূপান্তরিত হয়ে সত্যি সত্যিই সুরায় পরিণত হয়েছিল।
২. এটি খুবই চালাকিপূর্ণ একটি ভেলকি মাত্র।
৩. উপরের দুই ঘটনার কোনোটিই ঘটেনি। ঘটনাটি একটি গল্প মাত্র। এটি কোনো এক কাল্পনিক ঘটনা যা কেউ না কেউ তৈরি করেছে। কিংবা এমনও হতে পারে যে, পানি ও সুরা নিয়ে এমন কিছু ঘটেছিল যা দেখে মানুষ ভুলভাবে ধরে নিয়েছিল পানিগুলো রূপান্তরিত হয়ে সুরায় পরিণত হয়েছে।
১ম সম্ভাবনাটি যদি সত্য হয় তাহলে প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম-নীতি ভেঙে যাবে এবং অন্যান্য অসম্ভব ঘটনাগুলো বাস্তবে অহরহ ঘটতে কোনো সমস্যা থাকবে না। সিন্ডারেলার রূপকথায় মিষ্টি কুমড়া থেকে ঘোড়ার গাড়ি এবং ব্যাঙ থেকে রাজকুমার তৈরি হয়। একে অলৌকিক গল্প হিসেবে সকলে বিশ্বাস করে এবং এমনটা বাস্তবে কখনো সম্ভব নয় বলে জানে। এটা নির্মম সত্য যে, কোনো কাঠির ছোঁয়ায় মিষ্টি কুমড়া কখনো গাড়ি হতে পারে না। পানির অণু যদি কোনো ব্যক্তির প্রভাবে সুরার অণু (এলকোহল, ট্যানিন, চিনি ইত্যাদির মিশ্রণ)-এ পরিণত হয়, তাহলে মিষ্টি কুমড়ার ঘটনার সাথে এই ঘটনার আর কোনো পার্থক্য থাকে না।
আমাদের দেশের অনেকেই মিষ্টি কুমড়ার ঘটনাটিকে রূপকথা বলে ধরে নেয়। কিন্তু পাশাপাশি তারাই পানি আর সুরার মতো ঘটনাকে সত্য বলেও ধরে নেয়। একই জিনিসকে গল্প বলে ধরে নিচ্ছে আবার সেরকম জিনিসকেই বাস্তব ও সত্যি বলে ধরে নিচ্ছে। কেন বাপু? চিন্তা-ভাবনায় এত বৈষম্য কেন? এরকম ঘটনা যদি প্রকৃতির নিয়মে সত্যি সত্যি ঘটে থাকতো, তাহলে প্রকৃতিতে কত পরিমাণ বিশৃঙ্খলা বিরাজমান থাকতো তা ভাবা যায়?
চালাকিপূর্ণ কোনো কৌশলের ফলেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে। যদি সত্যি সত্যিই কোনো কৌশল বা ট্রিকের ফলে এটি ঘটে থাকে তাহলে স্বীকার করতেই হবে এই কৌশল, টেলিভিশন বা মঞ্চের জাদুকরের কৌশলের চেয়েও অনেক উন্নত। কৌশল ব্যবহার করে এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব। তবে এটি বেশ দুঃসাধ্য এবং ৩য় সম্ভাব্য ব্যাখ্যার তুলনায় অনেক বেশি অবাস্তব।
এদিকে ৩য় সম্ভাব্য ব্যাখ্যা বলছে এটি একটি গল্প মাত্র, যা সময়ের পরিক্রমায় মানুষ বাস্তব হিসেবে ধরে নিয়েছে। গল্পকে বাস্তব বলে ধরে নেবার উদাহরণ অহরহ আছে। কল্পিত গল্প থেকে এরকম ঘটনার উদ্ভব হতেই পারে, স্বাভাবিক। ৩য় সম্ভাবনাটি যেহেতু তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য এবং বেশি বাস্তব, সেহেতু ২য় সম্ভাবনা নিয়ে কেন টানাটানি করছি?
কেউ না কেউ গল্প আকারে এই ঘটনাটি তৈরি করেছে। মানুষ সবসময়ই গল্প তৈরি করে। গল্প তৈরি করা মানুষের আজন্ম স্বভাব। গল্পের সম্ভাবনাকে সঠিক বলে ধরে নিলে আমাদেরকে অতি-বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রায় অসম্ভব কোনো কৌশল নিয়ে ভাবতে হবে না। এমনকি প্রকৃতির বৈজ্ঞানিক নিয়মকে ভেঙে ফেলে এমন কোনোকিছু নিয়েও সমস্যায় পড়তে হবে না।
যিশু খ্রিস্টকে নিয়েও এরকম অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মূল খ্রিস্টধর্ম কিংবা বাইবেল সমর্থন করে না এমন ঘটনাও খ্রিস্টানদের মাঝে সত্য বলে প্রচলিত আছে। তাকে নিয়ে এত গল্প রচিত হয়েছে কারণ খ্রিস্টধর্মে তিনি তাদের কাছে অদ্বিতীয় ও বিশেষ একজন পুরুষ। যেমন Cherry Tree Carol নামে একটি সঙ্গীত আছে। বিদেশের স্কুলে বাচ্চারা সমস্বরে এই গানটি গায়। বাংলাদেশে যেমন সকল ছাত্রছাত্রী একত্রে মিলে জাতীয় সঙ্গীত গায় অনেকটা তেমন। যিশু যখন মাতা মেরির গর্ভে ছিল সেই সময়ের কথা বলা হয়েছে সঙ্গীতে।
মেরী জোসেফের সাথে একটি চেরি গাছের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। গাছে পাকা চেরি দেখে তিনি কিছু চেরি ফল খেতে চাইলেন। কিন্তু ফলগুলো ছিল অনেক উঁচুতে। তিনি সেগুলোর নাগান পাচ্ছিলেন না। জোসেফও স্বাভাবিক মুডে ছিলেন না যে ফল পেড়ে দেবেন। তখনই গর্ভ থেকে যিশু বলে উঠলেন, গাছের ডালটি যেন একটি নিচে নামিয়ে দেয়া দেয়, দিলে মেরী ফলের নাগাল পাবে, তাকে গাছে চড়তে হবে না। মূল গানটি এরকম
Then up spoke baby Jesus
From in Mary’s womb:
‘Bend down, thou tallest branch,
That my mother might have some.
Bend down, thou tallest branch,
That my mother might have some.’
Then bent down the tallest branch,
Till it touched Mary’s hand.
Cried she, ‘Oh, look thou, Joseph,
I have cherries by command.’
Cried she, ‘Oh, look thou, Joseph,
I have cherries by command.’
খ্রিস্টীয় কোনো ধর্মীয় গ্রন্থ বা কোনো প্রাচীন বইতে এই ঘটনা উল্লেখ পাওয়া যাবে না। কারণ এটি বানানো গল্প। কোনো শিক্ষিত মানুষই ঘটনাটিকে সত্য বলে ধরে নেবে না। কারণ এই গল্পটির জন্ম হয়েছে বেশিদিন হয়নি। ফলে অনেকে বিশ্বাস করলেও কেউ কেউ করে না। অনেক অনেক দিন পর এমনও হতে পারে অল্প অল্প করে বিশাল সংখ্যক মানুষ এটিকে সত্য বলে মনে করছে। এভাবে একটি বানোয়াট ঘটনা সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। কাল্পনিক কোনো চরিত্রকে কেন্দ্র করে এরকম গল্প তৈরি করলে সেটা গল্পই থাকে, কিন্তু বাস্তব কোনো মানুষের সাথে পেঁচিয়ে কোনো গল্প তৈরি করলে সেটা একসময় ভুলভাবে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবার ভয় থাকে।
কিন্তু যৌক্তক মন মানসিকতা থেকে নতুন হোক আর পুরাতন হোক- এ ধরনের ঘটনাকে সত্য বলে মেনে নেবার কিছু নেই। একটি গল্প আগে তৈরি হয়েছে আর একটি গল্প পরে। আগে হোক পরে হোক গল্প সবসময় গল্পই। গল্প কখনো সত্যে রূপান্তরিত হয় না। চেরি গাছের গল্পের মতো পানি থেকে ওয়াইন তৈরি হবার ঘটনাটিও গল্প।
অন্যান্য অতিপ্রাকৃত ঘটনার ক্ষেত্রেও আমরা এরকম বলতে পারি। ধরি, এমন কিছু একটা ঘটলো যা আমরা বুঝি না। এমন কোনো যুক্তিও পাচ্ছি না যা দেখিয়ে বলবো ঘটনাটি মিথ্যা বা কল্পিত গল্প। এরকম হলে কি ঘটনাটিকে আমরা অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক বলে ধরে নেব? না! অবশ্যই না। এরকম ধরে নিলে সঠিক ব্যাখ্যা ও সত্য উদ্ঘাটনের আগ্রহে এখানেই পেরেক মেরে দেয়া হবে।
কেউ যদি মনে করে, ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না এমন কোনো ঘটনা আসলে অলৌকিক ঘটনা, তাহলে তার মাধ্যমে দুটি ব্যর্থতা প্রকাশ পায়। প্রথমত এটিকে বোঝার মতো জ্ঞান তার নেই এবং বোঝার আগ্রহও নেই। দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে মেনে নেয়া হচ্ছে যে এটির ব্যাখ্যা কখনোই কেউ দিতে পারবে না। দুই দিক থেকে সংকুচিত হয়ে মানুষ অলৌকিক ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়। আজকে হয়তো একটি জিনিসের সঠিক ব্যাখ্যা প্রদান করা যাচ্ছে না, তার মানে এই না যে এটি অলৌকিক। এমন একটি সময় হয়তো আসবে যখন ঐ ঘটনাকে স্বাভাবিকতা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে। কোনো একটি ঘটনার ব্যাখ্যা না জানলে আমাদেরকে উপযুক্ত ব্যাখ্যার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এর গ্রহণযোগ্য বাস্তবসম্মত ব্যাখ্যার জন্য অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে।