মার্ভেল কমিক্সের জনপ্রিয় সায়েন্স ফিকশন সিনেমা সিরিজ ‘এক্স ম্যান’ এর বদৌলতে ‘মিউট্যান্ট’,’মিউটেশন’ শব্দগুলোর সাথে আমরা সকলেই কমবেশি পরিচিত। ‘এক্স ম্যান’ মুভিতে আমরা যে সুপারহিরোদের দেখি, তাদের সুপারপাওয়ারের উৎস ‘এক্স’ জিনে মিউটেশন। সাধারণ মানুষদের চেয়ে আলাদা, অদ্ভুতদর্শন এই ‘মিউট্যান্ট’ চরিত্রগুলোর কারো আছে অপরিমেয় শক্তি,কারো আছে দুরন্ত গতি, কারো চোখ থেকে বের হয়ে আসে অদ্ভুত আলোকরশ্মি, কেউ বা দেয়াল ফুঁড়ে বের হয়ে যেতে পারে নিমেষে, কেউ আগুন নিয়ে খেলতে পারে, আবার কেউবা দারুণ টেলিপ্যাথিক ক্ষমতার অধিকারী। সিনেমায় এই সুপারহিরোদের অস্বাভাবিক ক্ষমতার চোখধাঁধানো প্রদর্শনী আর দুর্দান্ত অ্যাকশন দেখে আমার মতো আপনাদেরও নিশ্চয়ই মনে হয়েছে, “ইশ্, তাদের মতো যদি হতে পারতাম!”
আপনি যদি তাদের মতো হতে চান, তাহলে আপনার কোষের ডিএনএতে থাকা জিনে মিউটেশন ঘটাতে হবে। অবশ্য মিউটেশনের ফলাফল সবসময় ভাল হয় না। সিনেমাতে তো বেশিরভাগ সময় ভাল দিকটাই দেখানো হয়, কিন্তু বাস্তবে মিউটেশন নানা রকম ক্যারিক্যাচার দেখাতে অভ্যস্ত। মিউটেশনের ব্যাপ্তি কল্পনাকে ছাড়িয়ে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। আর নানা রকমফেরের কারণে মিউটেশন আরও বেশি ব্যাপকতা পেয়েছে। মিউটেশনের ফলাফল নিয়ে পরে কথা হবে। আগে চলুন জেনে আসি মিউটেশন সম্পর্কে কিছু মৌলিক বিষয় এবং এর প্রকারভেদ সম্পর্কে।
মিউটেশন কী?
আমাদের শরীর অসংখ্য কোষ নিয়ে গঠিত। কোষের অভ্যন্তরে থাকে ক্রোমোসোম। ক্রোমোসোমে থাকে ডিএনএ, যা বংশগতির সমস্ত তথ্য বহন করে। আর জিন হচ্ছে আস্ত ডিএনএর একটি ক্ষুদ্র অংশ। জিনকে ডিএনএর কার্যকরী একক বলা হয়। জিনে মিউটেশন বুঝতে হলে এর গঠন আগে বুঝতে হবে। জিন যেহেতু ডিএনএ’র অংশ, তাই এর গঠনও ডিএনএর মতোই। ডিএনএ গঠিত হয় অনেকগুলো নিউক্লিওটাইডের সমন্বয়ে। নিউক্লিওটাইড তৈরি হয় নিওক্লিওসাইড এবং অজৈব ফসফেট দ্বারা ।
নিওক্লিওসাইড আবার গড়ে ওঠে নাইট্রোজেন বেস আর পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট শ্যুগার নিয়ে। নাইট্রোজেন বেস আছে চার রকমের, আর এরাই মূলত ডিএনএ গঠনের মৌলিক উপাদান হিসেবে কাজ করে। তো, ডিএনএ গঠনকারী নাইট্রোজেন বেস চারটি হচ্ছে অ্যাডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও থায়ামিন; যাদেরকে যথাক্রমে A, G, C, T দ্বারা প্রকাশ করা হয়।
A সাধারণত T এর সাথে এবং C, G এর সাথে হাইড্রোজেন বন্ড দিয়ে সংযুক্ত থাকে। এদের নির্দিষ্ট সিকোয়েন্সের ফলেই তৈরি হয় জীবন গঠনের অতি প্রয়োজনীয় উপাদান অ্যামিনো এসিড ও প্রোটিন। আসলে যেহেতু জিন বা ডিএনএ নিউক্লিওটাইড দিয়ে তৈরি আর নিওক্লিওটাইড নাইট্রোজেন বেসের যোগসাজশে তৈরি, তাই যদি ডিএনএর বেস সিকোয়েন্সে যদি পরিবর্তন আনা যায়, তাহলে ডিএনএর গঠনও পরিবর্তিত হবে; এবং হয়ও তাই। আর এই ঘটনাকেই মিউটেশন বলা হয়।
তাহলে কী দাঁড়াল? ডিএনএ বা জিন গঠনকারী নিওক্লিওটাইডের নাইট্রোজেন বেসে যদি কোনো কারণে স্থায়ী পরিবর্তন আসে তাহলে সেই ঘটনাকে জেনেটিক্সের ভাষায় ‘মিউটেশন’ বলা হয়। এই পর্যায়ে জেনেটিক কোড নিয়েও কিছু কথা বলে রাখি। তিনটি বেস নিয়ে একটি জেনেটিক কোড গঠিত হয়। মোট ৬৪টি জেনেটিক কোড আছে। এর মধ্যে ৬১টি কোড কোনো না কোনো প্রোটিন তৈরি করে আর অবশিষ্ট তিনটি কোড প্রোটিন তৈরি বন্ধ করার সংকেত দেয়। এদেরকে বলে স্টপ কোডন।
মিউটেশনের প্রকারভেদ
জিন মিউটেশন প্রধানত দুই ধরনের হয়ে থাকে- পয়েন্ট মিউটেশন আর ফ্রেইমশিফট মিউটেশন।
পয়েন্ট মিউটেশন
পয়েন্ট মিউটেশনে ডিএনএর বেস সিকোয়েন্সে পরিবর্তন আসে। এটি তিন ধরনের।
সাইলেন্ট মিউটেশন
এই ধরনের মিউটেশনে প্রোটিন তৈরিকারী জেনেটিক কোডের তিনটি বেসের একটি যদি পরিবর্তিত হয়েও যায়, তাহলেও কিছু ঘটে না। তাই সাইলেন্ট মিউটেশন হলো ফলাফল নিরপেক্ষ মিউটেশন।
মিসসেন্স মিউটেশন
এই মিউটেশনে জেনেটিক কোডের বেসে পরিবর্তন হয় এবং এর ফলে কোডটির যে প্রোটিন তৈরি করার কথা ছিল, তা না তৈরি করে সম্পূর্ণ আলাদা একটি প্রোটিন তৈরি করে।
ননসেন্স মিউটেশন
নামটা খুব মজার, তাই না? এই মিউটেশনে সংঘটিত কাণ্ডকারখানার সাথে নামের বেশ ভালোই মিল আছে। এক্ষেত্রে প্রোটিন উৎপাদনকারী কোনো জেনেটিক কোডের বেসে পরিবর্তনটা হয় বেকুবের মতোই। বেসে পরিবর্তন হয়ে ভিন্ন কোনো প্রোটিনের জন্ম দিলে তা-ও কথা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে বেসের পরিবর্তন তৈরি করে স্টপ কোডন।
ফ্রেইমশিফট মিউটেশন
ফ্রেইমশিফট মিউটেশনে আস্ত একটা নিউক্লিওটাইড যোগ হয় বা বিলুপ্ত হয়। এটি দুই ধরনের।
ইনসার্শন
এই মিউটেশনে জিনে একটা বা দুইটা নিওক্লিওটাইড উড়ে এসে জুড়ে বসে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রোটিন ঠিকমতো তৈরি হতে পারে না।
ডিলিশন
এই মিউটেশনে জিন থেকে দু-একটা নিওক্লিওটাইড গায়েব হয়ে যায়। কখনো কখনো খোদ জিনটাই গায়েব হয়ে যেতে পারে।
মিউটেশন কেন হয়?
কোষ বিভাজনের সময় ডিএনএ অনুলিপি তৈরি হওয়ার সময় ডিএনএর বেস সিকোয়েন্সের বিন্যাসে গড়মিল হলে মিউটেশন ঘটে থাকে। মানবদেহ এক্সরের মতো শক্তিশালী বিকিরণের সংস্পর্শে আসলেও মিউটেশন হয়। এছাড়া পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাবে মিউটেশন ঘটতে পারে।
মিউটেশনের ফলাফল
মিউটেশনের ফলাফল অভিশাপ বা আশীর্বাদ উভয়ই হতে পারে। বাস্তবে অবশ্য ক্ষতিকর মিউটেশনটাই বেশি দেখা যায়। নির্দিষ্ট কিছু জিনে মিউটেশনের ফলে নানারকম রোগব্যাধির সৃষ্টি হতে পারে, যেমন- সিস্টিক ফাইব্রোসিস, সিকল সেল এনিমিয়া।
এমনকি বর্তমানের বহুল আলোচিত ভয়ঙ্কর ব্যাধি ক্যান্সারও মিউটেশনেরই আরেক রূপ। যদি প্রকট জিনে মিউটেশন হয়, তাহলে প্রভাব হয় বিধ্বংসী আর সাপ্রেসর জিনে মিউটেশন ঘটলে লক্ষ্যণীয় কোনো প্রভাব পড়ে না। মিউটেশন যদি দেহকোষে হয়, তাহলে ফলাফলটা আপনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। আর যদি জনন কোষে হয়, তাহলে সেই মিউটেশনের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হবে পরবর্তী প্রজন্মকেও। এবার সেই বহুল আকাঙ্ক্ষিত প্রশ্ন- “মিউটেশন কি সত্যি সত্যি কোনো এক্সম্যান সুপারহিরোর জন্ম দিতে পারে?”
এখন পর্যন্ত চালানো গবেষণাগুলো থেকে যে উত্তর পাওয়া যায়, তা হতাশাজনকভাবে নেতিবাচক। অর্থাৎ বাস্তবে এক্স ম্যান বা স্পাইডারম্যান সম্ভব না। তবে কি ‘সুপারপাওয়ার’ শুধুই কল্পনা? না, কল্পনা নয়। মিউটেশনের ফলে বিশেষ কিছু সুপারপাওয়ার অর্জন করা সম্ভব। পৃথিবীতে এমনকিছু মানুষের অস্তিত্ব সত্যিই আছে যাদের শরীরে মিউটেশনের ফলে রোগবালাই সৃষ্টি হয়নি, বরং মিউটেশন তাদের জন্য হয়ে উঠেছে আশীর্বাদস্বরুপ। এরাই হচ্ছে সত্যিকারের ‘মিউট্যান্ট’ সুপারহিরো। এরকম কয়েকজনের কথা একটু শোনা যাক।
১. ফিনিশ স্কিয়ার ইরো ম্যান্টাইরান্টার ইরেথ্রোপোয়েটিন রিসেপ্টর জিনে মিউটেশনের ফলে তার ফুসফুসের বাতাস ধারণ ক্ষমতা সাধারণ মানুষের তুলনায় অস্বাভাবিক বেশি। তিনি ৫০ শতাংশ বেশি অক্সিজেন রক্তপ্রবাহে ধরে রাখতে পারেন।
২. সব মানুষের শরীরেই ACTN3 নামের জিন রয়েছে।
কিন্তু কোনো কোনো মানুষের শরীরে এই ACTN-3 জিনে মিউটেশনের ফলে তাদের শরীরের মাংসপেশীতে খুব দ্রুত টান পড়তে পারে, যার ফলে তারা দুরন্ত গতির অধিকারী হয়ে থাকেন।
৩. শত শত বছর ধরে ‘স্যান আন্তানিও দ্য লস কোব্রেস’ গ্রামের অধিবাসীরা স্বাভাবিকের তুলনায় আশি গুণ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করে আসছেন। কিন্তু মিউটেশনের ফলে তাদের মধ্যে অদ্ভুত এক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি হওয়ায় আর্সেনিকের বিষাক্ততায় তাদের কিছুই করতে পারেনি।
৪. ‘এডারম্যাটোগ্লাইফিয়া’ এমন একটি অবস্থা যার ফলে মানুষ কোনোরকম ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে। বিশেষ জেনেটিক কোডে মিউটেশন এই অবস্থার জন্য দায়ী।
৫. ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা এক মা-মেয়ের মধ্যে DEC2 জিনের অস্বাভাবিক কপি খুঁজে পেয়েছেন। এই মহিলা দু’জন স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে অনেক কম ঘুমিয়েও ঝরঝরে আর উদ্দীপ্ত বোধ করেন।
৬. মা জিয়ানগ্যাং নামের একজন রীতিমতো বিদ্যুৎ প্রতিরোধী। মানুষের শরীর একটি উত্তম বিদ্যুৎ পরিবাহী। কিন্তু তিনি কোনোরকম বিদ্যুতিক শক না পেয়েই জীবন্ত বৈদ্যুতিক তার স্পর্শ করতে পারেন।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, মিউটেশনের ফলে চূড়ান্ত ভালো থেকে চূড়ান্ত খারাপ-যেকোনো কিছুই সম্ভব। মিউটেশন রহস্যময়। প্রকৃতি আরও রহস্যময়। মিউটেশনের কারণে যদি সত্যি সত্যি কোনোদিন ‘এক্সম্যান’ সিনেমার চরিত্রগুলো বাস্তবে পরিণত হয়ও, তাহলে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!