৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১; যুক্তরাষ্ট্রকে হতভম্ব করে তাদের প্রশান্ত মহাসাগরীয় সামরিক ঘাঁটি পার্ল হারবারে বিমান হামলা চালায় জাপান।
জাপানের মূলভূমি থেকে চার হাজার মাইল দূরের এই ঘাঁটিতে হামলার জন্য ব্যবহার করা হয় ছয়টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার শ্রেণীর যুদ্ধজাহাজ। এই হামলার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর দখলদার মার্কিন বাহিনী সুকৌশলে জাপান দখল করে নেয়। নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে জাপান সম্রাটের সিংহাসন অক্ষুণ্ন রেখে গণতান্ত্রিক সরকারের হাতে জাপানের শাসনভার ছেড়ে দেয়া হয়। মার্কিন তত্ত্বাবধানে গঠিত সেই জাপানি সরকার ১৯৪৭ সালে নতুন সংবিধান রচনা করে। এই সংবিধানের একটি বিখ্যাত ধারা হলো ‘আর্টিকেল ৯’। এই ধারানুযায়ী জাপান ভবিষ্যতে বিদেশে গিয়ে কখনো যুদ্ধ করতে সক্ষম এমন সেনাবাহিনী বা দূরপাল্লার অস্ত্র (এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, লংরেঞ্জ বোম্বার, নিউক্লিয়ার ব্যালাস্টিক মিসাইল) নিজেদের ভাণ্ডারে রাখতে পারবে না।
সামরিক বাহিনী বিলুপ্ত হওয়ায় মার্কিন সামরিক বাহিনী জাপানের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেয়। তৎকালীন জাপানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত হালকা অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ বাহিনী ব্যতীত নিজস্ব কোনো বাহিনী ছিল না। কিন্তু ১৯৫০ সালের কোরিয়া যুদ্ধের সময় জাপান থেকে মার্কিন অকুপেশন ফোর্স কোরিয়ায় যুদ্ধ করতে গেলে দেশটি সম্পূর্ণরূপে প্রতিরক্ষাহীন হয়ে পড়ে। জাপান এ নিয়ে আপত্তি শুরু করলে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫১ সালে তাদের সাথে স্থায়ী প্রতিরক্ষা চুক্তি করে। এই চুক্তির আওতায় অনন্তকালের জন্য মার্কিন বাহিনী জাপানে ঘাঁটি গেড়ে বসার সুযোগ পায়। একই সঙ্গে জাপানের উপর হামলা হলে সেটি ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসবে- এই মর্মে চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। এই চুক্তি মোতাবেক ১৯৫২ সালে ১.১১ লাখ সদস্যের ‘ন্যাশনাল পুলিশ রিজার্ভ’ নামে মাঝারি ধরনের অস্ত্রে সজ্জিত একটি আধুনিক বাহিনী গঠন করা হয়। পরবর্তীতে উক্ত পুলিশ বাহিনীর নৌ ও বিমান শাখার সৃষ্টি এবং মূল বাহিনীর আকার বর্ধিতকরণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালে আগের সেই চুক্তির ১৬৫ নং ধারা অনুযায়ী জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সামরিক বাহিনী গঠিত হয়। সংবিধান ও মার্কিন চুক্তি মোতাবেক এই বাহিনীকে শুধুমাত্র দেশরক্ষার কাজে ব্যবহার করা হবে বলে অঙ্গীকার করা হয়। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কমান্ডে থাকা জাপানের সামরিক বাহিনীকে Japan Self-Defense Forces (自衛隊-Jieitai) বা সংক্ষেপে JSDF বলা হয়।
জাপান সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের তিনটি শাখা হলো Japan Ground Self-Defense Force (সেনাবাহিনী), Japan Maritime Self-Defense Force (নৌবাহিনী), Japan Air Self-Defense Force (বিমানবাহিনী)। অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে যে বাহিনীগুলোর একমাত্র কাজ জাপানের সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা। কিন্তু কোনোভাবেই জাপানি সেনারা বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করতে যেতে পারবেন না- এই মর্মে বিধিনিষেধ দেশটির সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৯’ এ রয়েছে।
জাপানের সামরিক সক্ষমতা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে জাপানিরা ঝাঁপিয়ে পড়ে। কঠোর পরিশ্রমী জাতিটি আজ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত কয়েকটি দেশের একটির অধিবাসী। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ছোঁয়া সামরিক বাহিনীর গায়েও লেগেছে। গ্লোবাল মিলিটারি র্যাঙ্কিং অনুযায়ী বর্তমানে ১৪০টি দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে জাপান সেলফ ডিফেন্স ফোর্স বিশ্বের ৫ম শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। ২০২১ সালের হিসেবে জাপানের অ্যাক্টিভ মিলিটারি পার্সোনেল আছে ২,৪৭,১৫৬ জন এবং জরুরি অবস্থার জন্য রিজার্ভ আছে ৫৬,০০০ সেনা। দেশটির সামরিক বাজেট বছরে ৫০.৩ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশের সামরিক বাজেটের প্রায় ১২ গুণ! জাপান তার মোট জিডিপির ১% সামরিক খাতে ব্যয় করে থাকে। যেহেতু এই আর্টিকেল জাপানের নৌবাহিনীকেন্দ্রিক, সেহেতু ‘জাপান মেরিটাইম সেলফ ডিফেন্স ফোর্স’ এর শক্তিমত্তা নিয়ে কিছু না বললেই নয়।
বর্তমানে জাপান বিশ্বের চতুর্থ শক্তিশালী নৌবাহিনীর মালিক। তারা ছোট-বড় মিলিয়ে মোট ১৫৫টি যুদ্ধজাহাজ পরিচালনা করে। এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ২৬টি ডেস্ট্রয়ার, ১০টি ফ্রিগেট, ৬টি করভেট, ২২টি অ্যাটাক সাবমেরিন, ৩০টি মাইন সুইপার শিপ এবং ৪টি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার।
সংবিধান সংশোধন
একবিংশ শতাব্দীর আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ২০০১ সালে প্রথম জাপানি স্পেশাল ফোর্সকে প্রয়োজনে দেশের বাইরে গিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম অপারেশন চালানোর সাংবিধানিক অনুমতি দেয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে সেলফ ডিফেন্স অ্যাক্টের আর্টিকেল ৩ সেকশন ২ অনুযায়ী জাপানি নৌবাহিনীকে আন্তর্জাতিক জলসীমায় জলদস্যু মোকাবেলায় প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগের কর্তৃত্ব দেয়া হয়। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, তাইওয়ানসহ চীন ও উত্তর কোরিয়া বিরোধী দেশগুলোর সাথে নিয়মিত মহড়াতে অংশগ্রহণ শুরু করে জাপান।
দেশটি ২০১০ সালে পূর্ব আফ্রিকার দেশ জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করে যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিদেশের মাটিতে নির্মিত প্রথম কোনো জাপানি সামরিক ঘাঁটি। ২০১৫ সালে দেশটির সংবিধানে বড় ধরনের পরিবর্তন আনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শিনজো অ্যাবের সরকার। জাপান মিলিটারি লিগালাইজেশন অ্যাক্টের আওতায় প্রথমবারের মতো দেশটির সেনাদের বিদেশের মাটিতে ‘বিশেষ প্রয়োজনে’ যুদ্ধ করার অনুমতি দেয়া হয়। অর্থাৎ যদি জাপানের বা তার মিত্রদের প্রতি শত্রুর হামলা বা এমন কোনো হুমকির সৃষ্টি হয় যার ফলে নিকট ভবিষ্যতে জাপানের মূলভূমির নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, তবে জাপানি সেনারা পার্লামেন্টের অনুমোদন সাপেক্ষে বিদেশের মাটিতে গিয়েও যুদ্ধ করতে পারবেন। উক্ত যুদ্ধকে জাপানের মূলভূমির প্রতিরক্ষা যুদ্ধ হিসেবে দেখা হবে। এছাড়া শান্তি ও যুদ্ধকালীন সময়ে মিত্রদের সামরিক রসদ সরবরাহের কারণে যদি জাপানি বাহিনী বৈদেশিক শক্তির হামলার শিকার হয়, তবে তার মোকাবেলায় প্রয়োজনে বিদেশে সেনা পাঠানো যাবে।
সুতরাং পাঠকমাত্রই বুঝতেই পারছেন যে কথার মারপ্যাঁচে আসলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তিপ্রিয় হয়ে যাওয়া জাপানিরা আসলে আসন্ন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীন ও উত্তর কোরিয়ার সাথে প্রশান্ত মহাসাগরীয় বেশ কিছু দ্বীপ ও জলসীমার কর্তৃত্ব নিয়ে আগে থেকেই জাপানের দ্বন্দ্ব ছিল। সম্প্রতি সেগুলোর রেশ বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ কোরিয়া এবং রাশিয়ার সাথেও বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এই তো কিছুদিন আগেই চীন-রাশিয়ার বিমানবাহিনী জাপানের এয়ার ডিফেন্স আইডেন্টিফিকেশন জোন (ADIZ) এর ভিতরে ঢুকে যৌথ বিমান মহড়া চালিয়েছে যা মূলত পরোক্ষভাবে কোনো দেশের সার্বভৌমত্ব অস্বীকার ও যুদ্ধের উস্কানি বোঝায়।
পাঠককে একটি চমকপ্রদ তথ্য জানিয়ে রাখি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে মাঞ্চুরিয়া অঞ্চল দখল করে নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জাপানের আত্মসমর্পণের পর এই যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু দুই পক্ষের মাঝে কাগজে-কলমে কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়নি। ফলে জাপানের সাথে রাশিয়ার যুদ্ধ লাগলে সেটি হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই বর্ধিত অংশ।
জাপানের সাথে সবচেয়ে বড় বিরোধ রয়েছে চীনের। এশিয়ার সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠা এই দেশের সামরিক শক্তি জাপানের জন্য বড় হুমকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সবচেয়ে বেশি অপকর্মের ভুক্তভোগী হচ্ছে চীন। পুরনো বিদ্বেষ ছাড়াও পূর্ব চীন সাগরে কয়েকটি বিতর্কিত দ্বীপ ও এর জলসীমার কর্তৃত্ব নিয়ে দুটো দেশের মধ্যে বিরোধ বেড়েই চলেছে। এছাড়া বিশ্বমোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চিরস্থায়ী বন্ধুত্বের কারণে জাপানের সাথে কয়েকটি মার্কিনবিরোধী দেশের যুদ্ধ বেধে যাওয়ার বেশ বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে। উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া বা চীনের সাথে বিরোধে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের সাহায্য করাটা হবে জাপানের বিপজ্জনক কর্তব্য।
২০১৮ সালে ২৬-৩২ বছর বয়সী অভিজ্ঞ সেনাদের নিয়ে ‘অ্যাম্ফিবিয়াস র্যাপিড ডেপ্লোয়মেন্ট ব্রিগেড’ করে জাপান। এটি আসলে সেনাবাহিনীরই একটি মেরিন শাখা যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথম আবার সৃষ্টি হলো। যে বাহিনীর সেনারা আকাশ বা জলপথে গিয়ে বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করার মতো বিশেষ ট্রেনিং পায় তাদেরকে মেরিন সেনা বলে। একমাত্র অফেন্সিভ মিলিটারি স্ট্র্যাটেজি অবলম্বন করা দেশগুলোই মেরিন ফোর্স নামে আলাদা বাহিনী পালন করে থাকে। সাংবিধানিক বিধিনিষেধ শিথিল করে জাপানও সেই পথেই হাঁটছে। তবে এই বাহিনী নিয়ে জাপানের মনোভাব এখন পর্যন্ত ডিফেন্সিভ। সেনকাকু আইল্যান্ডসহ বিরোধপূর্ণ দূরবর্তী দ্বীপগুলো যদি শত্রুর হাতে দখল হয়ে যায় তবে সেগুলো কীভাবে পুনরুদ্ধার করা যায় তারই ট্রেনিং নেয় এই ব্রিগেডের সেনারা। এছাড়া বিদেশি সেনাদের সাথে নিয়মিত মহড়া তো আছেই। ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ৫৭ হাজার সৈনিকের সমন্বয়ে হওয়া এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় মহড়াকে উস্কানিমূলক বলে আখ্যায়িত করে চীন।
প্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার
পরমাণু শক্তিকে শুধুমাত্র শান্তিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করার জাতিসংঘের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল দেশটি। ফলে জাপান বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া সামরিক কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে না। সংবিধান অনুযায়ী দেশটি দূরপাল্লার আক্রমণাত্মক অস্ত্র নিজেদের ভাণ্ডারে রাখবে না বলে অঙ্গীকার করেছিল। ফলে জাপানি এয়ারফোর্সে কোনো লংরেঞ্জ বোমারু বিমান নেই। জাপান এয়ার সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের মোট ৭৪০টি বিমানের মধ্যে ৩৩০টি কমব্যাট এয়ারক্রাফট। এসব যুদ্ধবিমানের বেশিরভাগই মূলত আকাশযুদ্ধে বেশি পারদর্শী যা দেশটির রক্ষণাত্মক কৌশলের বহিঃপ্রকাশ। শক্তিশালী এই বিমানশক্তিকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে চীন এক অভিনব কৌশল নিয়েছে। শুধুমাত্র ২০২০ সালে রেকর্ড সংখ্যক (৯৪৭) বার জাপানী আকাশসীমায় চীনা বিমানের অনুপ্রবেশ চেষ্টা ঠেকানোর জন্য স্ক্র্যাম্বল মিশন পরিচালনা করেছে জাপান এয়ার সেলফ ডিফেন্স ফোর্স। ফলে এ বছর জাপানের মূল শক্তি এফ-১৫ যুদ্ধবিমান বহরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিমানকে মেইনটেনেন্স ফ্যাসিলিটিতে মেরামত করতে পাঠানো হয়েছে। বাধ্য হয়ে জাপান এখন ADIZ এ ঢুকে পড়া সকল চীনাআ বিমানকে ইন্টারসেপ্ট করতে যুদ্ধ বিমান পাঠায় না।
বর্তমানে জাপানের হাতে দূরপাল্লার ব্যালাস্টিক মিসাইল নেই। তবে চারটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। বিমান ধারণক্ষমতার দিক দিয়ে এগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানের ২০টি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের চেয়ে কম সক্ষমতার হলেও কৌশলগত দিক দিয়ে জাহাজগুলো জাপানি নৌবাহিনীর বিশেষ শ্রেণীর অস্ত্র। বর্তমানে জাপানের হাতে ২৭,০০০ টনের Izumu ক্লাসের দুটি এবং ১৯,০০০ টনের Hyūga ক্লাস এর দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার আছে। অফিসিয়ালি হেলিকপ্টার ক্যারিয়ার বলে আখ্যায়িত করা। জাপান এই জাহাজগুলোকে মূলত এন্টি-সাবমেরিন রোলে ব্যবহার করে থাকে। এজন্য প্রতিটি জাহাজে কমপক্ষে সাতটি করে সাবমেরিন-বিধ্বংসী অস্ত্রে সজ্জিত হেলিকপ্টার ব্যবহার করা হয়। মূলত চীনের শক্তিশালী সাবমেরিন ফ্লিটকে মোকাবেলা করতে এই জাহাজগুলো বানিয়েছে জাপান।
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের শ্রেণীবিভাগ নিয়ে বিস্তারিত পড়ুন : এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার: আধুনিক নৌবাহিনীর তুরুপের তাস (পর্ব-১)
৬৪৬ ফুট লম্বা Hyūga ক্লাসের হেলিকপ্টার ক্যারিয়ারগুলো জাপানের প্রথম এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। তবে এগুলো শুধুমাত্র এন্টি সাবমেরিন ও ট্রুপস ট্রান্সপোর্ট ও অ্যাটাক হেলিকপ্টার (মোট ১৮টি) বহন করে। জাহাজগুলোতে শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। অন্যদিকে ৮১৪ ফুট লম্বা Izumu ক্লাসের জাহাজ দুটো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নির্মিত জাপানের সবচেয়ে বড় যুদ্ধজাহাজ। এতে সর্বোচ্চ ২৮টি এয়ারক্রাফট ও ৪০০ মেরিন সৈনিক বহন করা যায়। এছাড়া ট্যাংক, ট্রাকসহ প্রয়োজনীয় সামরিক যানবাহন বহন করতে পারে। এতে একসাথে পাঁচটি হেলিকপ্টার ওঠা-নামার সুবিধা রয়েছে। তবে জাপান ১.৫ বিলিয়ন ডলার দামের Izumu ক্লাসের জাহাজ দুটোকে বাড়তি ৩০ মিলিয়ন খরচ করে আপগ্রেড করে লাইট এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে রূপান্তর করেছে। এজন্য তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৪২টি F-35B Lighting II যুদ্ধবিমান কেনার অর্ডার করেছে। ৫ম প্রজম্মের এসব অত্যাধুনিক স্টেলথ যুদ্ধবিমানগুলো রাডার ফাঁকি দিতে সক্ষম। এ বছরের অক্টোবর মাসে ইউএস মেরিনের এফ-৩৫বি যুদ্ধবিমান Izumu-তে পরীক্ষামূলক ওঠা-নামা করে জাহাজটির সক্ষমতা যাচাই করে নতুন করে আলোচনায় আসে। এই বিমানের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো- এটি স্বল্প জায়গা থেকে টেকঅফ করতে পারে এবং হেলিকপ্টারের ন্যায় সোজাসুজি ল্যান্ড করতে পারে! (ভিডিও দেখুন)
অর্থাৎ F-35B যুদ্ধবিমানগুলো ডেলিভারি পেলে জাপানি নৌবাহিনী তখন মূল ভূখণ্ড থেকে অনেক দূরে গিয়ে অফেন্সিভ অপারেশন পরিচালনা করার সক্ষমতা লাভ করবে। মোটকথা, জাপান সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের বিদেশের মাটিতে যুদ্ধ করার বৈধতা থাকলেও প্রথাগত যুদ্ধবিমান বহনকারী এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রাখার ব্যাপারে কোনো সাংবিধানিক বৈধতা নেই। ফলে দেশটির ভেতরে-বাইরে সামরিক বিশ্লেষকদের মাঝে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। তাদের অনেকেই বলছেন যে জাপানের এই সিদ্ধান্তের ফলে সংবিধানের ‘আর্টিকেল ৯’ তার গুরুত্ব পুরোপুরিভাবে হারিয়েছে।
এছাড়া সম্প্রতি জাপানের তৈরি করা অস্ত্রগুলোর ক্ষমতা দেখেও যুদ্ধপ্রস্তুতির আভাস পাওয়া যায়। উপকূলে বসানোর জন্য তিনশো কি.মি. রেঞ্জের ভূমিভিত্তিক এন্টিশিপ মিসাইল ব্যাটারি, এক হাজার কি.মি. রেঞ্জের সুপারসনিক গ্লাইড বোম্ব, ব্যালাস্টিক মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসম্পন্ন জাপানি ‘এজিস’ ডেস্ট্রয়ারগুলো মার্কিন যুদ্ধজাহাজগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে অপারেশন চালাতে সক্ষম।
সব মিলিয়ে জাপানের তিন বাহিনীর সক্ষমতা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যাপক আকারে সক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে যা একটি দেশের জন্য সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু জাপানি সরকার যেভাবে দেশটির সামরিক বাহিনীকে ডিফেন্সিভ ডকট্রিন থেকে রাতারাতি অফেন্সিভে নিয়ে যাচ্ছে তা প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অশনিসংকেত। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা- যেকোনো সংঘাতে ঘনিষ্ট মিত্রদের সাথে মিত্রতার সমীকরণ বজায় রাখতে গিয়ে আজকের শান্তিপ্রিয় জাপানই হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বারুদে আগুন জ্বালাবে। তেমনটি না ঘটুক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার নিয়ে আরও জানতে পড়ুন এই লেখাগুলো
১) এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার (পর্ব-২): মার্কিন নৌবাহিনীর প্রধান দাবার ঘুঁটি
২) ব্যাটল অফ মিডওয়ে : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া এক স্মরণীয় নৌযুদ্ধ
৩) ব্যাটল অফ কোরাল সি : মরণপণ সংঘাতে লিপ্ত হলো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার