‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’- এই গানটি যখন ঘরে ঘরে বাজতে থাকে, তখন এমন দুর্ভাগা ঘরও থাকে যেখানে সুখ উঁকি দিতে ভয় পায়, ঈদ কীসের কী। যখন শহুরে পরিবারগুলোর শিশুরা উপভোগ করে ঈদের নির্মল আনন্দ, পরে বেড়ায় নতুন কাপড়, পায় নতুন উপহার, সালামি বা ঈদী- ঠিক তখনই একই শহরেরই কোনো এক কোণে হয়তো একই বয়সের কিছু শিশু ঈদের আনন্দঘন সময়েও না খেয়ে থাকছে, কাটাচ্ছে গায়ে জীর্ণ পুরনো জামা দিয়েই; ঈদে নতুন জামার অর্থই যে তারা জানে না! তাদের কি ইচ্ছে হয় না, একটা খুশির দিন কাটাতে?
এই মানুষগুলোর জন্য সমাজের সবাই সবসময় এগিয়ে না এলেও এগিয়ে আসে কেউ কেউ, এমনই একটি সংগঠন ইয়ুথ’স ভয়েস। এটি মূলত ইয়ুথ ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফাউন্ডেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি সংগঠন। গত ২৮ মে চট্টগ্রামের হল ২৪ কনভেনশন সেন্টারে ঠিক এমন একটি আয়োজনই করে ইয়ুথ’স ভয়েস। এবারই কিন্তু প্রথম নয়! বেশ কয়েক বছর ধরেই তারা আয়োজন করে চলেছে এই প্রজেক্ট চনা পিঁয়াজু (পিসিপি)।
কী কী করলে শিশুদের মন আনন্দে ভরপুর করে তোলা যায় সেগুলো মাথায় ছিল ইয়ুথ’স ভয়েসের। বরাবরের মতো ইফতার করানো তো বটেই, সাথে আরও ছিল ঈদের প্রয়োজনীয় নিত্যসামগ্রী আর ঈদের নতুন কাপড় দেওয়া।
এ শিশুগুলোর অনেকেই সারা বছর ধরে ভোগে নানা রোগ বিসুখে। অর্থাভাবের কারণে চিকিৎসার কথা তাদের অনেকের কল্পনারও অতীত। এটা মাথায় রেখেই ইয়ুথ’স ভয়েস আনন্দ বিনোদনের পাশাপাশি বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা ও শিশুদের প্রয়োজনীয় ওষুধও সরবরাহ করে সেদিন।
আয়োজনের দিনে এই অবহেলিত নিষ্পাপ সুবিধাবঞ্চিত শিশুগুলো সেচ্ছাসেবকদের সাথে গল্প করে, খেলে, একসাথে ছবি এঁকে আনন্দমুখর সময় কাটায়- এমন সুযোগ এই বাচ্চাগুলো হয়তো সবসময় পায় না। পিসিপি উদযাপনের আসল উদ্দেশ্যই হলো সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকে বছরের সেরা একটি দিন উপহার দেওয়া, যে দিনটি হয়তো অন্য আট-দশটি শিশুর জন্য খুবই স্বাভাবিক।
শুধু শিশুদের জন্যই নয়, সেচ্ছাসেবকদের জন্যও এ দিনটি খুবই আনন্দের। শিশুদের সাথে সময় কাটানো ও তাদের দেখাশোনা করার মাধ্যমে প্রত্যেক সেচ্ছাসেবকই আরও দায়িত্ববান হয়ে ওঠেন এবং সেই সঙ্গে তারা সুবিধাবঞ্চিত এসব শিশুদের কষ্ট কিছুটা হলেও অনুধাবন করতে পারেন, যা ভবিষ্যতে তাদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
সংগঠনের প্রধান আহবায়ক ও প্রেসিডেন্ট তাহমিদ কামাল চৌধুরীর নেতৃত্বে, ভাইস প্রেসিডেন্ট রাকিব হাসান, চট্টগ্রাম শাখার প্রেসিডেন্ট মো. শরীফ সরোয়ার, কোষাধ্যক্ষ নাভিদ করিম, জেনারেল সেক্রেটারি আদনান আলী, অর্গানাইজিং সেক্রেটারি সাবিহা নাসরীন, ডিরেক্টর (কমিউনিকেশন) মোফাচ্ছাল আজিজ, ডিরেক্টর (ক্রিয়েটিভ) সামি উর রহমান ও অন্যান্য সদস্যবৃন্দের সা্র্বিক পরিচালনায় এবং প্রায় ২৫০ জন স্বেচ্ছাসেবকের অংশগ্রহণে এই কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
শিশুদের সাথে এই উৎসবই না কেবল, গত ২৮ মে তারিখেই ইয়ুথ’স ভয়েস ‘বিশ্ব মাসিক দিবস’ উদযাপন করে, সেই সাথে বাংলাদেশের প্রথম অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল প্রযুক্তিসম্পন্ন পুনঃব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড ‘সেফপ্যাড’ উম্মোচন করে।
চার্লস ডিকেন্সের একটি গল্প ছিল, নাম ‘অ্যা ক্রিসমাস ক্যারল’। গল্পটি মূলত খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব নিয়েই, যেমনটা এদেশে ঈদ। গল্পের মূল চরিত্র স্ক্রুজ কখনোই সাহায্য করতেন না কাউকে, ছিলেন ভীষণ কৃপণ, আর শিশুদের প্রতি খুবই নির্দয়। গল্পের পরিক্রমায় কোনো এক ক্রিসমাস বদলে দেয় তাকে। সেবার তিনি নিজ থেকেই এগিয়ে আসেন। মানুষকে সাহায্য করা শুরু করেন, সবার মনে ছড়িয়ে দেন আনন্দ, শিশুদেরও ভোলেননি তিনি। ইয়ুথ’স ভয়েস এর কাজটিও যেন সে অনুভূতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়, আর এটিও এক ধর্মীয় উৎসবকে সামনে রেখেই।
ইয়ুথ’স ভয়েস এর সাথে হাসি ঠাট্টায় কাটানো দিনটি ঐ শিশুগুলো ভুলবে না কোনোদিনই, সেটা হলফ করে বলা যায়। আশা করা যায় প্রতি বছরই এমন ধারা অব্যাহত থাকবে, আর পরিসরে হবে আরও বড়, আনন্দ ছড়িয়ে দেবে আরও অনেক শিশুর মাঝে। বছরের তিনশো পঁয়ষট্টিটি দিনের মাঝে এই একটি দিন যেমন বঞ্চিত শিশুদের আনন্দ দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, সকলেই যদি প্রতিটি দিন এমন এগিয়ে আসতো, তবে পৃথিবীটা হয়তো বদলে যেত একদম!