স্বাধীন হবার পর থেকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলোর একটি হলো বেকার সমস্যা। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই বেকার থাকাটা দেশের উন্নয়নের পথেও একটি বড় বাধা। এই সমস্যা আরও জটিল হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে ‘শিক্ষিত বেকার’-এর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায়। ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ’ তথা সিপিডি’র তথ্য অনুযায়ী দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর শতকরা ৪৬ শতাংশই স্নাতক বা স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করা!
উচ্চশিক্ষিত হবার পরও এই বিরাট জনগোষ্ঠীর বেকার থাকাটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক কিছু নয়। কর্মসংস্থানের অভাব, নাকি শিক্ষিত এই তরুণদের দক্ষতাকে সঠিক উপায়ে কাজে লাগানো যাচ্ছে না বা প্রশিক্ষণ দেওয়া যাচ্ছে না, সেটিই এখন জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্বের ভাবনার বিষয়। এরকম একটি নেতিবাচক দৃশ্যপট যখন বাংলাদেশের চাকরির বাজারে তৈরি হয়ে আছে, তখন সেখানে ইতিবাচকতা আর অপার সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়েছে অগমেডিক্স। দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি আর উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে আরো উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা করা বৈশ্বিক কোম্পানি অগমেডিক্স এখন বাংলাদেশে এর কার্যক্রম চালাচ্ছে পুরোদমে, যা নানা কারণেই দেশের বেকারত্ব দূরীকরণে নিয়ামক হতে পারে।
অগমেডিক্স কী? সিলিকন ভ্যালি ভিত্তিক এই স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক স্টার্টআপটির প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ইয়ান শাকিল এবং তার সহযোগী পেলু ট্র্যান। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে ডাক্তারদের রোগী দেখার কাজকে আরো সহজ করেছে এই স্টার্টআপ। যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তারদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে প্রত্যেক রোগীর চিকিৎসা বিষয়ক বিবরণ এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্যাদি সংরক্ষণ করতে হয়। রোগী দেখার সময় এভাবে তথ্য সংরক্ষণ ডাক্তারদের মনোযোগে যেমন ব্যাঘাত ঘটায়, তেমনি এই তথ্য প্রতিদিন ‘ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ড’ বা ইএইচআর-এ সংরক্ষণ করতে গিয়ে নষ্ট হয় অনেক মূল্যবান সময়ও।
এ সমস্যার সমাধান করতে অগমেডিক্স ডাক্তারদের দিচ্ছে ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট, যিনি ডাক্তারের হয়ে রোগীর যাবতীয় তথ্যের রেকর্ড লিখে দেবেন। ডাক্তার রোগী দেখার সময় গুগল গ্লাস ব্যবহার করবেন এবং তার ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট সুদূর বাংলাদেশে বসেই সরাসরি ডাক্তারের চোখেই রোগীকে দেখতে পাবেন, কথোপকথন শুনতে পাবেন, ছবি তুলতে পারবেন এবং প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো লিখে রাখতে পারবেন। এ কাজটি যারা করেন তাদেরকে বলা হয় স্ক্রাইব। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও বাংলাদেশ, ভারত, শ্রীলংকা এবং ডোমিনিকান রিপাবলিক থেকে স্ক্রাইব হিসেবে অগমেডিক্সে কাজ করছেন অনেক তরুণ। কিন্তু এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশেই অগমেডিক্সের সম্ভাবনা সবচেয়ে উজ্জ্বল। কেন উজ্জ্বল, সে আলোচনায় যাওয়া যাক চলুন।
অগমেডিক্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং সিইও ইয়ান শাকিল একজন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত এবং তার লক্ষ্য হলো অগমেডিক্সের পুরো কার্যক্রমই একসময় বাংলাদেশ থেকে পরিচালনা করা। কেননা স্ক্রাইব হিসেবে কাজ করবার জন্য বাংলাদেশে অসংখ্য দক্ষ তরুণ রয়েছে যাদের প্রয়োজন কেবল পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, যেটি কিনা অগমেডিক্সই সরবরাহ করছে। ৯০’র দশকে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হওয়া মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশনের আধুনিক রূপ বলা যেতে পারে অগমেডিক্সকে, যেখানে স্ক্রাইবগণ সরাসরি ডাক্তারের সাথে রোগীকে দেখার ও কথা শোনার সুযোগ পায়। গুগল গ্লাসের ব্যবহারে স্ক্রাইবের কাজকে একপ্রকার আউটসোর্সিংই বলা চলে। আর আউটসোর্সিং খাতে বাংলাদেশের অপার সম্ভাবনার কথা কে না জানে?
এই মুহূর্তে সরকারের একটি প্রকল্পের আওতায় দেশজুড়ে ৫৫৪টি বিপিও বা ‘বিজনেস প্রসেস আউটসোর্স’ সেন্টার গড়ে তোলার কাজ চলছে, যা শেষ হলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি বৈশ্বিক আউটসোর্সিংয়ের হাব। এই বিপিও সেক্টরে দেশের মেডিকেল খাতকে যুক্ত করবে অগমেডিক্সই। বাংলাদেশের মেডিকেল সেক্টরে বিপিও ইন্ডাস্ট্রির প্রসার ঘটাতে অগমেডিক্সের সাথে কাজ করছে ‘স্কয়ার বাংলাদেশ’ এবং ‘আইডিএস ইনফোটেক ইন্ডিয়া’র সম্মিলিত উদ্যোগ এসআইটু। সরকারের সাথে অগমেডিক্সের লক্ষ্যমাত্রা অভিন্ন হওয়ায় এ খাতে উন্নয়ন হচ্ছে প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুতগতিতে।
বাংলাদেশের চাকরির বাজারে বেকার সমস্যা দূরীকরণে অগমেডিক্স কার্যকরী ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে এ কারণে যে, এখানে ক্যারিয়ার গড়তে মেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার প্রয়োজন নেই। মেডিকেল কিংবা প্যারামেডিকেল ব্যাকগ্রাউন্ডে পড়ালেখা করাটা অবশ্যই সুবিধাজনক, তবে অগমেডিক্সে স্ক্রাইব হিসেবে কাজ করতে পারেন যেকোনো বিষয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করা শিক্ষার্থীরাই। এর প্রাথমিক যোগ্যতা হলো ইংরেজিতে দক্ষ হওয়া এবং কথোপকথন শোনা ও পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি দ্রুত টাইপ করতে পারা। অর্থ্যাৎ ‘মাল্টিটাস্কিং’ দক্ষতা।
অন্যান্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা বিকাশের জন্য অগমেডিক্স ব্যবস্থা করে অত্যন্ত কার্যকরী প্রশিক্ষণের। ৬ মাসের এ প্রশিক্ষণ ব্যবস্থায় ৪ ধাপে একজন প্রার্থীকে স্ক্রাইব হিসেবে গড়ে তোলা হয়, যেখানে প্রার্থীর ইংরেজি ভাষা জ্ঞান, টাইপিং, প্রয়োজনীয় মেডিকেল বিষয়ক জ্ঞান, প্রযুক্তির ব্যবহার- সবকিছুর বিকাশ ঘটানো হয়। দেশে বিনিয়োগ ও দক্ষ জনবল সরবরাহে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি মন্ত্রণালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে অগমেডিক্স। অগমেডিক্সের প্রশিক্ষণ ছাড়াও আইসিটি বিভাগে আওতাধীন বিভিন্ন প্রকল্পে সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইনস্টিটিউট সমূহের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে দেশে দক্ষ ও আত্মবিশ্বাসী তরুণ জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে কর্মসংস্থান।
বেকারত্ব দূরীকরণের সাথে সাথে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহেও অদূর ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকা থাকবে অগমেডিক্সের। আইটি খাত থেকে বাংলাদেশ যে আয় করে তার একটি বড় অংশই আসে আউটসোর্সিং থেকে। ২০১৯ সালে আউটসোর্সিং খাতে বাংলাদেশের আয় ১ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। এই রেমিট্যান্স প্রবাহে নতুন প্রণোদনা দিচ্ছে অগমেডিক্স। চিকিৎসা খাতে বিপিও ইন্ডাস্ট্রির পরিচয় করিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের জন্য আউটসোর্সিং থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনাময় এক দুয়ার খুলে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। কেবল ২০১৮ সালেই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশে ৫ শতাধিক মানুষকে প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ দিয়েছে এবং প্রতিবছর এই সংখ্যাটা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে তারা। আগামী ৫ বছরের মধ্যে দেশে অন্তত ৭ হাজার কর্মী প্রশিক্ষণ ও নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে অগমেডিক্স। যেহেতু ভবিষ্যতে প্রতিষ্ঠানটি এর সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বাংলাদেশ থেকে পরিচালনা করতে চায়, তাই অনাগত দিনে হাজারও কর্মী নিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। আর এই ব্যাপক সংখ্যক দক্ষ জনবল নিশ্চিতভাবেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ভারী করবে।
বেকার সমস্যায় ইতিবাচক প্রভাব কিংবা বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সম্ভাবনা, এ দুটির চেয়েও অগমেডিক্সের অধিক গুরুত্বপূর্ণ অবদানটি হলো আইসিটি খাতে নীরব এক বিপ্লব। এরই মধ্যে বাংলাদেশের আইসিটি খাতে ডিজিটালাইজেশনের বিপ্লব ঘটে গেছে। অগমেডিক্স তাতে এনেছে ভিন্ন মাত্রা। অগমেডিক্সের ঢাকাস্থ অফিসটিকে ইতোমধ্যে দেশের দ্বিতীয় বেসরকারি হাইটেক পার্ক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, চলছে আইসিটি বিভাগের আওতায় জেলায় জেলায় এর কার্যক্রম প্রসারের কাজ। বৈশ্বিক টেক-জায়ান্ট আলফাবেট যে দশটি প্রতিষ্ঠানকে গুগল গ্লাস ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছে, অগমেডিক্স তাদের মধ্যে একটি। ফলে অগমেডিক্সের হাত ধরে বাংলাদেশে চলে এসেছে অত্যাধুনিক এ প্রযুক্তি।
এছাড়াও অগমেডিক্সের প্রশিক্ষণ, নিয়োগ এবং অর্থনৈতিক দিকগুলোর প্রায় পুরোটাই বাংলাদেশ থেকে পরিচালিত হচ্ছে। এর গবেষণা দলে অ্যান্ড্রয়েড, জাভা, ওয়েব ডেভলপমেন্ট, কোয়ালিটি অ্যাসিউর্যান্স- সব ধরনের আইসিটি ইঞ্জিনিয়ার রয়েছে, যাদের বড় অংশই বাংলাদেশী। এটি বাংলাদেশের আইসিটি গ্র্যাজুয়েটদের জন্য ক্যারিয়ার গড়ার এক বড় সুযোগও বটে। সব মিলিয়ে আইসিটি খাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনা ও সুযোগকে আরো বর্ধিত করছে অগমেডিক্স, এই খাতের উন্নতিকে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন উচ্চতায়।