Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

২৮ জুনের রাত: ‘ফুটবল, ব্লাডি হেল’!

আপনি ফুটবল ভালো না-ই বাসতে পারেন, তাতে দোষের কিছু নেই। হয়তো আপনার ক্রিকেট কিংবা টেনিস দেখতেই ভালো লাগে, মেসি-রোনালদোর বদলে আপনার তর্ক ফেদেরার-নাদাল কিংবা কোহলি-উইলিয়ামসনে ঘুরপাক খায়।

কিন্তু ২৮ জুনের রাতে ফুটবল আপনাকে অবাক বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ করে দেয়। সে রাতে আপনি আনমনেই স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের অমর উক্তি না আউড়ে পারেন না,

‘ফুটবল, ব্লাডি হেল!’

১৪ গোল, দুই এক্সট্রা টাইম, এক পেনাল্টি শ্যুটআউট। যে রাত দেখেছে অবিশ্বাস্য কামব্যাক, অদ্ভুতুড়ে গোল এবং নাটক, যে নাটক কোনো নাট্যকার লিখলে আপনি এক লহমায় বলে দিতেন, ‘এসব গাজাখুরে নাটক লেখা বন্ধ করুন মশাই!’

২৮ জুন ফুটবলের রাত। ২৮ জুন পরাবাস্তব ফুটবলের অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চের হওয়ার রাত।

অথচ দিনের শুরুতে এরকম রুদ্ধশ্বাস রাতের অপেক্ষা কেউ করেনি। আগের ম্যাচেই পাঁচ গোল দেয়া স্পেনের সামনে নিজেদের ছায়া হয়ে থাকা ক্রোয়েশিয়া, অন্য ম্যাচে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের সামনে সুইজারল্যান্ড। চার দলের ভেতর স্পষ্ট বিভাজন, এপারে ফেভারিট স্পেন ও ফ্রান্স, অন্য প্রান্তে ক্রোয়াটদের সঙ্গী সুইসরা।

কিন্তু রাতের প্রহর শেষ হতে হতে সেই বিভাজনের রেখা অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে গেল কোন অন্যলোকে, আপনি খুঁজেও পেলেন না। খুঁজে পাবার কথাও নয়; ফুটবল যে রাত নিজের করে নেয়, সে রাতে আপনি এসব তুচ্ছ বিষয় পাবেন না, সেটিই স্বাভাবিক।

দিনের প্রথম গোলটা কী অদ্ভুতুড়ে! ১৮ বছর বয়সী পেদ্রির পাসটা ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না স্পেন গোলকিপার উনাই সিমন, আত্মঘাতী গোল! তাতে স্পেনের গোলে একটা শট না নিয়েও লিডে ক্রোয়েশিয়া।

উনাই সিমনের নিজেরও হয়তো বিশ্বাস হয়নি, তিনি কী করেছেন। Image: Wolfgang Rattay – Pool/Getty Images

অবশ্য জবাব দিতে স্পেন সময় নিল ১৮ মিনিট। দারুণ আক্রমণে পাবলো সারাবিয়ার গোল, তাতে লুইস এনরিকেসহ তাবৎ স্প্যানিশের বুকে পানি ফিরল, তা বলা যেতেই পারে।

বিরতির পর সিজার আজপিলিকেতা একাই বল টেনে নিয়ে আসলেন নিজেদের অর্ধ থেকে, ফেরান তোরেস বল পেয়ে করলেন নিখুঁত এক ক্রস, তাতে আজপিলিকেতার গোলে অবশেষে ম্যাচে এগোয় স্পেন।

৭৭ মিনিটে আয়মেরিক লাপোর্তের দুর্দান্ত পাস থেকে যখন ফেরান তোরেস ব্যবধানটা দ্বিগুণ করেন, আপনি হয়তো টিভি বন্ধ করে চলে গেছেন স্পেনের জয়ই ভবিতব্য ভেবে।

আপনি তখনও জানেন না, ফুটবল আপনার জন্য কী নিয়ে বসে আছে।

তৃতীয় গোল খাওয়ার আট মিনিটের মাথায় ডান দিক দিয়ে স্পেন ডি-বক্সে ঢুকে পড়েন লুকা মদরিচ, তার পাস, এরপর জটলার ভেতর মিস্লাভ অরসিচের গোল, আপনি এখনও টিভি হয়তো আবার ছাড়েননি। এরপর যোগ করা সময়ের দ্বিতীয় মিনিট, গোল করা অরসিচ নিখুঁত ক্রস করেন, বদলি হিসেবে নামা পাউ তোরেস চেয়ে চেয়ে দেখেন; মারিও পাসালিচ ক্রোয়েশিয়াকে সমতায় ফেরাতে এক মুহূর্তও দেরি করেন না।

ফেসবুকে উন্মাদনা দেখে আপনি এবার হয়তো টিভি ছাড়েন, ততক্ষণে অতিরিক্ত সময়ের খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে।

বক্সের ভেতরে বলটা যখন আন্দ্রে ক্রামারিচ মারলেন, তিনি, ক্রোয়েশিয়া এবং আপনি হয়তো ক্রোয়াট রূপকথার নতুন অধ্যায় নিয়েই ভাবছেন। কিন্তু ঠিক তখনই, উনাই সিমন তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করেন দুর্দান্ত এক সেইভে।

ঘড়িটা ঠিক যখন তিন অঙ্কের ঘরে পৌছায়, সে সময়ে পাপমোচন করেন আলভারো মোরাতা। টুর্নামেন্টজুড়ে মিসের মহড়া করেছেন, পোল্যান্ডের বিপক্ষে ১-১ গোলের ড্র-এর পর ঘুমাতে পারেননি; অন্তর্জালের পৃথিবীতে দেখেছেন তার সন্তানের মৃত্যুকামনা।

এর চেয়ে ভালোভাবে মোরাতা জবাব দিতে পারতেন না। Image: Friedemann Vogel – Pool/Getty Images

সেসব মাথায় নিয়ে ম্যাচের ফল শেষবারের মতো স্পেনের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া গোলটি করেন মোরাতা। সেটিও কী দুর্দান্ত এক ফিনিশে! তার ভলিটা জালে জড়ায়, স্পেন এগিয়ে যায়, মিনিট তিনেক পরে মিকেল ওয়্যারজাবালের গোলে এবারে অন্তত নিশ্চিত হয়ে যায়, কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনই যাচ্ছে।

আপনি এবার দম নিয়ে বসেন। ‘পরের ম্যাচে ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের দূরত্বটা তো আরও বেশি, অন্তত এমন উথালপাতাল আবেগের জোয়ার দেখতে হবে না’ – এটি ভেবেই হয়তো পরের খেলাটা দেখতে বসেন।

এবং আপনি ভুল প্রমাণিত হন। দিদিয়ের দেশম কোনো এক কল্পলোকের স্বপ্নে ক্লেমন্ট লংলেকে নামান, যাকে অতি সহজে পরাস্ত করে হারিস সেফারোভিচ সুইসদের লিড এনে দেন। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে বেনজামিন পাভার্ড পেনাল্টি উপহার দেন সুইজারল্যান্ডকে।

আপনি হয়তো ভাবছেন, এখানেই খেলা শেষ।

নাহ, রিকার্ডো রড্রিগেজের দুর্বল পেনাল্টি ফিরিয়ে দেন ফরাসি অধিনায়ক হুগো লরিস। আর ঠিক মিনিট দুয়েক পরই চতুর্থ মাত্রা থেকে জাদুর কাঠি নিয়ে আসেন করিম বেনজেমা, গোল করে সমতায় ফেরান ফ্রান্সকে।

এরপর অসাধারণ এক দলীয় গোল, শেষ ছোঁয়াটা আবারও বেনজেমার এবং বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা প্রথমবারের মতো এগিয়ে যায়। আর মিনিট পনের পর যখন পল পগবা এবারের ইউরোর অন্যতম সেরা গোল করে বসেন, তখন আপনি আবারও নিশ্চিত হয়ে যান, ফ্রান্স আর ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই।

পগবার নিখুঁত গোলের পর সুইসদের আশার প্রদীপ নিভেই গিয়েছিল প্রায়। Image: MARKO DJURICA/POOL/AFP via Getty Images 

কিন্তু ফুটবল-ঈশ্বর সেদিন নিজের ডালি খুলে বসেছিলেন। উত্তেজনার পারদ এক দাগ নামতে দেয়াটাই সে রাতে বারণ!

কেভিন এমবাবুর দুর্দান্ত ক্রসটা তাই খুঁজে পায় সেফারোভিচকে। তিনি ম্যাচে ফেরান সুইজারল্যান্ডে। তাতে ম্যাচ বেঁচে উঠলেও সুইসদের চেষ্টার ফল মেলেনি। সুইসদের আশঙ্কা আপনি দেখেন একজন সুইজারল্যান্ড ভক্তের চোখে, যার চোখের অশ্রুর দেখা মিলছে চশমার কাচ গলে।

ঠিক তখনই মধ্যমাঠে বল পেয়ে যান গ্রানিত সাকা। বল পেয়ে জাভি হার্নান্দেজের বিখ্যাত ‘লা পওজা’ বা ‘দি পজ’, কিংবা সহজ বাংলায় বললে প্রথম টাচেই পাস না দিয়ে এক টুকরো সময় নিলেন। সুইজারল্যান্ডের জন্য যখন প্রতিটা সেকেন্ডের দাম বেড়ে চলেছে ঘড়ির কাটা ঘর পেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে, সাকা তখন একান্ত নিজের করে নিলেন সেই মুহূর্তটা। এরপর বাড়ালেন নিখুঁত পাস, যে পাসটা পেলেন বদলি হিসেবে নামা মারিও গ্রাভরানোভিচ। এক ডিফেন্ডারকে পাশ কাটালেন, এরপর বক্সের বাইরে থেকে নিখুঁত শট; সেটা লরিস ফেরাতে পারেননি। এবং আপনি অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে দেখেন, সুইজারল্যান্ড আকাশে উড়তে থাকা বিশ্বজয়ীদের মাটিতে টেনে এনেছে।

নাটক অবশ্য সেখানে শেষ হয় না, খেলা অতিরিক্ত সময়ে গড়ানোর আগেই কিংসলে ক্যোমানের ভলি ফিরে আসে ক্রসবারে লেগে। মুখে হাত দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না ফরাসিদের।

মিনিট তিনেকে কীভাবে বদলে যায় সব কিছু! Image: Twitter

অতিরিক্ত সময়ে অতিমানব হয়ে ওঠেন সুইস গোলকিপার ইয়ান সমার এবং ২২ বছরে বিশ্বজয় করা কিলিয়ান এমবাপে প্রমাণ করেন, ফুটবলাররাও মানুষ। অতিরিক্ত সময়ের একদম শেষ দিকে পগবার দুর্দান্ত পাসটা বাইরে মারেন এই ফরাসি তারকা; তাতে টাইব্রেকারে গড়ায় খেলা।

তখনও ফ্রান্স শিবিরে হয়তো অশনি সংকেত বাজেনি, কিন্তু ফ্রান্সের সর্বশেষ টাইব্রেকার বলছিল, সাইরেনটা অনেক আগেই বাজা দরকার ছিল। এর আগে শেষবার ফ্রান্স পেনাল্টি শ্যুটআউটে অংশ নিয়েছিল ২০০৬ বিশ্বকাপের ফাইনালে, যেখানে ভাগ্যদেবী ইতালির পক্ষই নিয়েছিলেন।

টাইব্রেকারে একে একে সুইজারল্যান্ডের পাঁচজনই গোল করেন, ফ্রান্সের প্রথম চারজনও কোনো ভুল করেন না। শেষ পেনাল্টিটা নিতে আসেন এমবাপে; মিস করলেই বাদ, এই খড়্গ মাথার ওপর নিয়ে।

এবং এমবাপ্পে পারেন না। সমার তার পেনাল্টি ঠেকিয়ে দেন, রেফারির শেষ বাঁশি নিশ্চিত করে, সুইজারল্যান্ড জিতে গেছে। উন্মত্ত উল্লাসে ফেটে পড়েন সুইস খেলোয়াড়রা, জীবনের অন্য রঙে আপনি দেখেন ফরাসিদের হতবিহ্বল চেহারা।

ওপারেতে সর্বসুখ, আমার বিশ্বাস! Image: Daniel Mihailescu – Pool/Getty Images

সুইসদের উন্মত্ত উল্লাস আর এমবাপের পরাজিত মুখটা দেখে আপনার মনে পড়ে ডেভিড আর গোলায়াথের কথা। যেখানে গোলায়াথকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করেছে ডেভিড এবং শেষ পর্যন্ত বিশ্বজয়ীরা মাটিতে নেমে এসেছে, কিংবা ভালোমতো বললে, লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে।

আপনি তাই অবশেষে খেলা শেষ হওয়ার পর অনেকক্ষণ আটকে রাখা নিঃশ্বাস ছাড়েন। এবং বাধ্য হয়েই আউড়াতে থাকেন,

‘ফুটবল, ব্লাডি হেল।’

An article about the two matches on June 28 in the Euro 2020, probably the greatest night in the competition's history.

Featured Photo: JUSTIN SETTERFIELD/POOL/AFP via Getty Images

Related Articles