ঈশ্বরকে লেখা স্মিথের খোলা চিঠি: দ্বিতীয় পর্ব

ঈশ্বর,

দেবদেবীরা দেখতে কেমন হয়? তাদেরও কি আমাদের মতোই দুটো চোখ, দুটো হাত, দুটো পা থাকে? ড্যানি উইলিসের তো তা-ই আছে!

অতি সাম্প্রতিক বলে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের সবচেয়ে কালো অধ্যায় জানতে চাইলে আমার ওই বল টেম্পারিং কেলেঙ্কারির ঘটনাই সবার আগে মনের আয়নায় ভেসে উঠবে। এর সমকক্ষ যদি না-ও হয়, ধারেকাছে আসার মতো একটি ঘটনাই খুঁজে পাবেন অজিরা। ট্রেভর চ্যাপেলের বিখ্যাত (কিংবা কুখ্যাত) আন্ডারআর্ম বোলিং!

ট্রেভর চ্যাপেল পরে নিজেই জানিয়েছিলেন, ওই ঘটনা কী করে তার জীবনই পাল্টে দিয়েছিল, অবশ্যই নেতিবাচকভাবে। বাকি জীবনে কেমন করে সেই ঘটনার রেশ তাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছিল, সে তো অনেকবারই শুনেছি, কেপটাউনের ঘটনার পর নিজে তেমন যাতনা ভোগও করেছি। একদিক থেকে অবশ্য নিজেকে লাকিই মনে হচ্ছিল। ওই আন্ডারআর্ম বোলিংয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ট্রেভর চ্যাপেলের বিয়েই ভেঙে গিয়েছিল, আর আমার জীবনে ড্যানি উইলিস ছিল!

২৭ মার্চ ২০১৮ থেকে পরবর্তী এক বছর, এক রূঢ় পৃথিবীকেও ততটা নিষ্ঠুর মনে হয়নি, সে তো এই মানুষটার জন্যেই। আগলে রাখা যত্নে আর পরম ভালোবাসায় এই মানুষটা আমাকে প্রতি মুহূর্তে ভাবতে বাধ্য করেছে, বিধাতা আমার জন্যে ড্যানি উইলিস নামের এক দেবী পাঠিয়েছে!

ড্যানি উইলিস কিংবা দেবী; Image credit: Getty Images 

ড্যানির অনুপ্রেরণায় ক্রিকেটে ফেরার স্বপ্নটা একেবারে মরে যায়নি কখনোই। আর নিষেধাজ্ঞা শেষে অস্ট্রেলিয়ার একাদশে ঢুকতে যে খুব একটা বেগ পেতে হবে না, সে তো নিষেধাজ্ঞার দিনগুলোতেই বুঝে গিয়েছিলাম। অতি-আত্মবিশ্বাস বলছো? অথচ পরিসংখ্যান তো এমনটাই বলছিল, দলে আমার জায়গা অবধারিত!

নিষেধাজ্ঞায় পড়বার আগের বছরে ওই সবুজরঙা হেলমেট মাথায় দিয়ে ১১ টেস্টে রান করেছিলাম ১৩০৫, সে টেস্টগুলোতে অস্ট্রেলিয়ার করা রানের ২১.৬০ শতাংশ। ২০১৬ থেকে হিসেব করলেও যা সামান্যই কমে দাঁড়ায় ২১.২৫ শতাংশে। আমি না থাকাকালীন দিনগুলোতে অন্য কোনো ব্যাটসম্যান দলের জন্যে এত বেশি পরিমাণ ভূমিকা রাখবে, তা অজি নির্বাচকেরাও বোধ করি আশা করেনি। আশা করবেই বা কার কাছে? বিরাট কোহলি, কেন উইলিয়ামসন আর জো রুটই আমার ওই অবদানকে ছাড়াতে পারেনি। আমার পরিবর্তে সুযোগ পাওয়া কেউই তাই বোঝাতে পারেনি, আমরা স্মিথিকে (স্টিভেন স্মিথ) একদমই মিস করছি না!’

পিটার হ্যান্ডসকম্ব, মিচেল মার্শের কাঁধ ঘুরে অস্ট্রেলিয়া চার নম্বরে ভরসা খুঁজেছিল শন মার্শে। টানা ১১ ইনিংস চার নম্বরে ব্যাট করবার সুযোগ পেয়েও যখন শন মার্শের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ সংগ্রহ ৬০ রান ছাড়ায়নি, তখনই বুঝেছিলাম, এই তো, আর দিনকয়েক, ২৯ মার্চের অপেক্ষা!

নাকি পয়লা আগস্টের অপেক্ষাতে ছিলাম বলাই শ্রেয় হবে? টেস্ট ক্রিকেট খেলাই তো জীবনের ধ্রুবতারা করেছিলাম সবসময়ে। নিজেকে তো এর জন্যে তৈরিও রাখছিলাম নিজের মতো করেই। বোলিং নেটে খেটেছি পাগলের মতো, নেট বোলাররা ক্লান্ত-বিরক্ত হয়ে ছুটি চাইলে মাঠে নামিয়েছি উইলিসকে। বলেছি, ‘শুধু বলগুলো বোলিং মেশিনে ভরে যাও!’ আমার এই পাগলামির যাতনা তো ভোগ করেছে গ্রায়েম হিকও। আমাকে থ্রোয়ার দিয়ে অনবরত বল ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেচারা বোধহয় ঘুমের মাঝেও হাত ছোড়েন এখন।

গ্রায়েম হিক, ধন্যবাদ; Image credit: Getty Images  

ঈশ্বর,

আমি কেবল অস্ট্রেলিয়ার ওই ব্যাগি গ্রিন পরে খেলতে চেয়েছিলাম। এই সেই ব্যাগি গ্রিন, স্টিভ ওয়াহ যার জন্যে নরকেও ঘুরে আসতে আপত্তি করতেন বলে মনে হয় না। ওয়ার্নি (শেন ওয়ার্ন) তো দিনকয়েক আগে জানিয়েই দিল, ওয়াহর আমলে প্রত্যেকদিন ফিল্ডিং করতে নামলে প্রথম এক ঘণ্টা ওই ব্যাগি গ্রিন পরতেই হতো! ঘরোয়া ক্রিকেটে রানবন্যা ছুটিয়েও মাইক হাসির মতো ক্রিকেটার যার দেখা পাননি বছরের পর বছর। অথচ, ক্যারিয়ারের তুঙ্গে থাকা সময়টাতেই কি না আমি হারিয়ে ফেললাম ব্যাগি গ্রিন মাথায় দেবার যোগ্যতা! নিষেধাজ্ঞা ২৯ মার্চ ফুরোলেও, আইপিএল-বিশ্বকাপ খেলে ফেললেও আমি যে তীর্থের কাকের মতো ওই পয়লা আগস্টের আশাতেই বসে ছিলাম, সে তো তুমি জানতেই!

অবশেষে আমার সেই বহুকাঙ্ক্ষিত পয়লা আগস্ট তুমি পাঠালে। আমার জীবনে তুমি এজবাস্টন পাঠালে, এজবাস্টনের নায়ক হতে!

আমার সঙ্গে সঙ্গে সেদিন তো ছিল সাদা পোশাকে ডেভিড ওয়ার্নারেরও প্রত্যাবর্তনও। বোধহয় একটু বেশিই আপ্লুত হয়ে পড়েছিল এবারের ফেরায়। ব্রড-জুজু ওকে যেন পেয়ে বসলো সেদিনই। নইলে আম্পায়ার আঙুল তুলে দিল বলে সোজা ওকে প্যাভিলিয়নের পথ ধরতে হবে কেন? খানিক বাদেই সাজঘরের পানে হাঁটা ধরল বল-টেম্পারিংয়ের আরেক পাপী ক্যামেরন ব্যানক্রফট, ওই ব্রডের বলেই ক্যাচ তুলে। ব্যাট-প্যাড তো পরাই ছিলাম, এক দৌঁড়ে ছুটলাম বার্মিংহামের সবুজ গালিচার পানে, ৪৯৬ দিন পর।

গ্যালারিতে তখন তুমুল কোলাহল, অমন চিৎকার-চেঁচামেচিতে সবগুলো কথা স্পষ্ট শুনতে পারিনি। তবে বার্মি-আর্মির ছুঁড়ে দেয়া শ্লেষাত্মক ওই শব্দগুলোর সারমর্ম তো বুঝতেই পারছিলাম। ‘চিট’, ‘প্রতারক’, ‘শঠ’ শব্দগুলো তো এতদিনে কম শুনিনি!

অন্য সময় হলে হয়তো এসব শব্দ আমাকে তাড়া করে বেড়াত বহুক্ষণ। কিন্তু সেদিন তো এসব শব্দের সীমানা পেরিয়ে গিয়েছিলাম আমি। তা সেদিন পার্থিব সব অনুভূতির সীমানাই অতিক্রম করেছিলাম। ১৭ রানেই অস্ট্রেলিয়া হারিয়েছিল উদ্বোধনী দুই ব্যাটসম্যানকে।

খানিক বাদে সাজঘরে ফিরেছিলেন উসমান খাজা, তারও একটু পরে ট্রাভিস হেড, এরও একটু পরে ম্যাথু ওয়েড আর টিম পেইন। আমাকে এক পাশে রেখে জেমস প্যাটিনসনও যখন ড্রেসিংরুমে ফিরল, স্কোরবোর্ড দেখাচ্ছিল, অস্ট্রেলিয়া ১২২-৮।

ইনিংসের শুরু থেকেই সোৎসাহে পেছনে লেগে থাকা বিপক্ষ দলীয় সমর্থক, মেঘলা আকাশের নিচে ব্রড-ওকস জুটি, সাথে ওই ব্যাটিং বিপর্যয়, এমন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে আমাকে ধ্যানমগ্ন ঋষি হতেই হতো! ধন্যবাদ ঈশ্বর, আমাকে তুমি ঋষি বানিয়েছিলে।

বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার ২০১৯ অ্যাশেজ; Image credit: Getty Images  

ঈশ্বর,

শুরুর দিকে ব্রডের কিছু বলে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু ওই অব্দিই। ২০১৭ অ্যাশেজ শেষ করেছিলাম ৬৩৯ রান করে, এ অ্যাশেজ শুরু করলাম সেঞ্চুরিতে। শুরুতে ব্লকের পরে ব্লক আর ডিফেন্সে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, দেড় বছরের বিরতিতে ব্যাটখানায় মরচে ধরেনি।

পিটার সিডল এসেক্সের হয়ে দারুণ এক মৌসুমই কাটিয়েছিল এবার, বোলার হয়েও ব্যাট হাতে ত্রিশোর্ধ্ব গড় তো অনবদ্যই। অনেক বিশেষজ্ঞ ইংলিশ ব্যাটসম্যানেরও তো তা নেই। ওর ওপর তাই ভরসা আমার ছিলই, অন্তত কিছুক্ষণ আমাকে সঙ্গ দিতে পারবেই সিডল। সিডল সেদিন আমায় সঙ্গ দিয়েছিল, ৮৮ রান জুড়ে। গ্যারিও (নাথান লায়ন) সেদিন ব্যাটসম্যান হয়ে গিয়েছিল কিছুটা, যার বদৌলতে অস্ট্রেলিয়ার স্কোরটা পৌঁছেছিল ২৮৪-তে।

নিজের ব্যাটিং নিয়ে আর কি বলব! আমি তো কেবল ব্যাট করতে পেরেই খুশি ছিলাম। তবে পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটেই এমন একাকী লড়াইয়ের ইতিহাস খুব একটা নেই। দলীয় ২৮৪ রানের ১৪৪-ই এসেছিল আমার ব্যাটে, শতকরা প্রায় ৫১ ভাগ। কাছাকাছি এমন উদাহরণ খুঁজতে গিয়ে চলে যেতে হচ্ছে ২২ বছর পেছনে। স্টিভ ওয়াহও এমনই অ্যাশেজ ম্যাচে করেছিলেন ১০৮, অস্ট্রেলিয়া সেদিন করেছিল ২৩৫। অবশ্য তুমি তো জানোই, মনে মনে এমন প্রত্যাবর্তনেরই প্রত্যাশা আমি করছিলাম। ধন্যবাদ বিধাতা, আমাকে নিয়ে এমন স্বপ্নের চিত্রনাট্য লেখার জন্যে।  

যেই অ্যাশেজে আমি একাই নায়ক; Image credit: Getty Images  

ঈশ্বর,

প্রথম ইনিংসের ওই অমূল্য ১৪৪ রানের পরেও ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে জনকয়েকের দুয়ো ঠিকই শুনতে হয়েছিল। কিন্তু বিধাতা তুমি যে ঠিক করেই রেখেছিলে, এই ম্যাচে আমার জন্যে কেবল ভালোবাসা আর অভিবাদনটুকুই বরাদ্দ রাখবে।

এবারের অ্যাশেজটা ডেভিড ওয়ার্নারের ভালো যায়নি মোটেই। এক স্টুয়ার্ট ব্রডের বলেই তো আউট হয়েছে সাতবার! অবশ্য এক রোরি বার্নস ছাড়া কোন ওপেনারেরই বা এই অ্যাশেজ ভালো কেটেছে! প্রত্যেকবার ইনিংস শুরুর আগে ওপেনিং জুটির ব্যাটসম্যানেরা প্যাড-গ্লাভস তো পরতোই, সাথে প্যাড-গার্ড পরে তৈরি থাকতে হয়েছিল আমাকেও। প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসেও তো ক্রিজে গিয়েছিলাম দশম ওভারের মাঝেই, অস্ট্রেলিয়ার ২৭ রানে। সেখান থেকে অস্ট্রেলিয়া পৌঁছেছিল ৪৮৭ রানে। হেড করেছিল অর্ধশতক, আর ওয়েড বহুদিন বাদে অস্ট্রেলিয়া দলে ফেরাটাকে স্মরণীয় করে রেখেছিল সেঞ্চুরি করে। কিন্তু, বিধাতা, তুমি যে নির্ধারণ করেই রেখেছিলে, ওয়ারেন বার্ডসলি, আর্থার মরিস, স্টিভ ওয়াহ, ম্যাথু হেইডেনের পাশে এই আমাকেও বসাবে। ১৪২ বছরের অ্যাশেজের ইতিহাসে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে এক টেস্টের দুই ইনিংসেই শতকের দেখা পেয়েছেন এই পাঁচজনই।

মার্ক টেলরের কল্যাণে এজবাস্টনের দর্শকদের সম্পর্কে ধারণা কিছুটা ছিলই। যতই চিৎকার-চেঁচামেঁচি করে কান ঝালাপালা করে দিক না কেন, দিনশেষে এরা সুন্দর ক্রিকেট দেখতেই আসে। পৃথিবী যে আরও একবার বদলে যাচ্ছে, এবং এবারে আমার অনুকূলেই, তা বুঝেছিলাম ওই ১৪২ রানের ইনিংস খেলে ড্রেসিংরুমে ফেরার পথেই। ‘স্ট্যান্ডিং ওভেশন’ শব্দটার সঙ্গে পরিচয় ছিল আগেই, সেদিন যেন পরিচয় পেলাম আবারও, নতুন করে, নতুন জীবনে।  

তা এমন করতালির বৃষ্টিতে তো ভিজেছি অনেকবারই, নাম লিখিয়েছি অনেক রেকর্ডে, সবই বিগত মাসদুয়েকে। এমন এক লম্বা বিরতির সুবিধাও তো আবিষ্কার করে ফেললাম এই সুযোগে। বিরতি যেন সবকিছুতেই ‘প্রথম-প্রথম’ অনুভূতি নিয়ে আসে। ক্রিকেট পরিসংখ্যানে খুব একটা আগ্রহ না থাকলেও এই আমি যে পরিসংখ্যান আর ইতিহাস নিয়ে বেশ খানিকটা পড়ে ফেলেছি, সে তো এই বিরতির কল্যাণে পাওয়া কৌতুহলেই। আর পড়তে গিয়েই জানলাম, প্রথম টেস্টের জোড়া শতকে অ্যাশেজে আমার শতকসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল দশে, সিরিজশেষে যা হয়েছে এগার। যথাক্রমে ১২টি আর ১৯টি শতক নিয়ে ক্রিকেটের দুই আদি গ্রেট স্যার জ্যাক হবস আর স্যার ডন ব্র‍্যাডম্যানই আছেন আমার ওপরে।

মোট শতকসংখ্যায় তো কেবল ডনই আছেন আমার ওপরে। প্রথম ২৬ টেস্ট শতক পেতে আমার লেগেছে ১২৪ ইনিংস, ডন ব্র‍্যাডম্যান নামের ওই অতিমানবের ইনিংস সংখ্যা অনুক্ত রাখাই শ্রেয়। (বিস্ময়ের পরিমাপক কোনো কিছু আজ অব্দি আবিষ্কৃত হয়নি। হয়নি বলেই ইনিংসসংখ্যা এই চিঠিতে উল্লেখ করবার প্রয়োজন পড়ছে। আমার লেগেছে ৬৭ টেস্ট, ভদ্রলোকের প্রয়োজন পড়েছিল ৭২ ইনিংস!)

আত্মতৃপ্তি প্রকাশের জন্যে এছাড়া তো আর কোনো উপায় নেই করুণাময়, তাই বহুদিন বাদে টেস্টের আঙিনায় ফিরে অমন অতিমানবীয় ইনিংস খেলেছিলাম বলেই এত বাক্যব্যয় করলাম সেই টেস্টের বর্ণনে। নইলে লেখা তো উচিৎ সিরিজের বাকি সবগুলো ইনিংস নিয়েই। এই সিরিজে যে আমায় কেবল দু’হাত ভরেই দিয়েছ।

লুটিয়ে পড়েছি, ভেঙে পড়িনি; Image credit: Getty Images  

এজবাস্টনের পর লর্ডসেও তো সেঞ্চুরির পথেই এগোচ্ছিলাম। ব্রড-ওকসদের ভোঁতা বানিয়ে হ্যাটট্রিক সেঞ্চুরি যখন মাত্র বিশ রান দূরত্বে, তখনই ছুটে এল জোফরা আর্চারের ওই বাউন্সার। একদিক থেকে ঢুকে গেলাম ইতিহাসে, অন্যদিকে আফসোসের বৃত্তে। ইতিহাস বলছি, ক্রিকেট প্রথমবার ‘কনকাশন বদলি’ দেখেছে আমার কারণেই। আফসোস হচ্ছে, আজ থেকে বহু বছর পরেও যে হেডিংলি টেস্ট শিহরণ জাগিয়ে যাবে ক্রিকেট রোমান্টিকদের মনে, ওই টেস্ট খেলতে পারিনি জোফরার বলে পাওয়া আঘাতের কারণে। মিডিয়ার সামনে ওর প্রতি মুগ্ধতা জানিয়েছিই, তবুও এই চিঠিতে আলাদা করে ওর কথাটা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আহা, কী বোলার! সত্যিকারের ফাস্ট বোলার!

দ্বিতীয় টেস্ট বৃষ্টিতে ভেসে গিয়ে আর তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডের জয়ের কারণে চতুর্থ টেস্টে যখন ‘জিততেই হবে’ সমীকরণ, তখন তো আমাকে ফিরতেই হতো। দেড় বছরের বিরতি কাটিয়ে ফিরেছিলাম সেঞ্চুরি করে, দেড় সপ্তাহের বিরতির পরে ডাবল সেঞ্চুরি তো করাই লাগত!

২১১ রানের ওই ইনিংস দেখে অনেকেই মুগ্ধতা ঝরিয়েছিলেন, টিম পেইন তো আমাকে তার দেখা সেরা ক্রিকেটারের স্বীকৃতিই দিয়ে দিয়েছিলেন। তা এমন স্বীকৃতি পেলে কার না ভালো লাগে! সাথে যদি যোগ হয় ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৮৫ রানের জয়, যে জয়ে নিশ্চিত হয়েছিল ওই ছয় ইঞ্চি ছাইদানির তাসমান সাগরপাড়েই থাকা, তবে তো সোনায় সোহাগা! 

২০১৯ অ্যাশেজ, মনে থাকবে; Image credit: Getty Images  

চাঁদেরও নাকি কলঙ্ক থাকে। আমার মধুচন্দ্রিমার মতো এ সফরে যেমন গ্রহণ লেগেছিল শেষ টেস্টের শেষ ইনিংসে। সিরিজে এর আগে সর্বনিম্ন যে রানে আউট হয়েছিলাম, সে সংখ্যাটি ছিল ৮০, ওভালের দ্বিতীয় ইনিংসে। আর শেষ দিনে এসে আউট হয়েছিলাম ২৩ রানে, সেই জোফরা আর্চারের বলে। এই ২৩ রানে আউট হওয়া নিয়েও তো মানুষ কাব্য করতে ছাড়েনি। আউট তো আমি কখনোই হতে চাই না, তবে এবারে আউট হয়ে বোধহয় নিজের মাহাত্ম্যই বেড়েছে। কাউকে কাউকে তো বলতেও শুনলাম, ‘অবশেষে প্রমাণ হলো, স্টিভ স্মিথ মানুষ, মেশিন নয়!’  

সিরিজশেষে ওই ২৩ রান কে-ই বা মনে রাখতে গিয়েছে! কেপটাউন কেলেঙ্কারির দিন শেষ করেছিলাম ৬,১৯৯ রানে, টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাসে ৬৩তম রান সংগ্রাহক হিসেবে। ৬৩ থেকে ৫০তম অবস্থানে পৌঁছাতে লাগল ৫৩৯ দিন আর সাত ইনিংস। এই সাত ইনিংসে রান এসেছে ৭৭৪, রীতিমতো ঈর্ষণীয় ১১০.৫৭ গড়ে।

এবারের অ্যাশেজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করেছে যে, সেই বেন স্টোকসের গড় ৫৫.১২, আমার গড়কে অর্ধেক করা হলেও এর চেয়ে খানিকটা বেশিই দেখাচ্ছে। দৃষ্টিটা যদি আরেকটু বিস্তৃত করি, সেখানেও তো সবার ওপরে নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছি। ২০১৬ হতে বিরাট কোহলি রান করেছে ৬৫ ছাড়ানো গড়ে, আমার গড় এ সিরিজের পর ৭০ ছাড়িয়েছে।

শেষটা মধুর না হলেও সিরিজটা মধুর; Image credit: Getty Images  

দৃষ্টি তো আরও প্রসারিত করতে ইচ্ছে করছে, ওই ৯৯.৯৪-কে পাখির চোখ করতে ইচ্ছে করছে।

পাখির মতোই ঝড়ের কবলে তো ফেলেছিলে। এবারে পাখির মতো ডানা মেলে উড়বার ক্ষমতাটুকুও চাই। বিধাতা, সহায় হও।

ইতি,

স্টিভেন স্মিথ।

পূর্বপ্রকাশিত পর্ব: ঈশ্বরকে লেখা স্মিথের খোলা চিঠি: প্রথম পর্ব

This article is in Bangla language. This article is on Steve Smith's remarkable comeback in test cricket. This piece is the follow-up from the previous episode. Necessary heperlinks are attached inside.

Image credit © Getty Images   

Related Articles

Exit mobile version