বলতে গেলে অনেকটা উত্তেজনার মধ্য দিয়েই শেষ হয়েছে ২০১৮ ফিফা বিশ্বকাপের গ্রুপপর্বের ম্যাচগুলো। তবে মাত্র একদিন বিরতি দিয়ে আবার ৩০ জুন শনিবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে দ্বিতীয় রাউন্ড অর্থাৎ ‘সুপার সিক্সটিনের ম্যাচগুলো। আর প্রথম পর্বের উত্তেজনা আরেকটু বাড়িয়ে দিতেই কি না নক আউট রাউন্ড শুরু হচ্ছে, দুই সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার মধ্যকার ম্যাচ দিয়ে। তাই খেলা উপভোগ করার আগে চলুন বিস্তারিত জেনে আসি, তারকা খেলোয়াড় দিয়ে পরিপূর্ণ এই দুই দল সম্পর্কে।
একদলের আক্রমণভাগে আছেন ঘরোয়া লিগ জেতা লিওনেল মেসি, গঞ্জালো ইগুয়াইন, সার্জিও আগুয়েরো ও আঙ্গেল ডি মারিয়ার মতো বাঘা বাঘা ফরোয়ার্ড; অন্য দলে আছেন গত মৌসুমে ইউরোপা জয়ী আঁতোয়ান গ্রিজম্যান, পল পগবা ও লিগা ১ শিরোপা জয়ী কিলিয়ান এমবাপে। আর হ্যাঁ, ৪৫,৩৭৯ ধারণক্ষমতা সম্পন্ন স্টেডিয়াম কাজান এরিনাতে অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া ম্যচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় রাত ৮ টায়।
সেই ২০০৯ সালে শেষবারের মতো মোকাবেলা করা ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনা সর্বমোট এগারোবার একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল। যার মধ্য থেকে আর্জেন্টিনা জয় পেয়েছে মোট ছয়বার, ফ্রান্স দুবার এবং বাকি তিন ম্যাচ গোলশূন্য ড্র হয়। তাছাড়া বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্সের মধ্যে ম্যাচ হয়েছে মোট দুবার, ১৯৩০ ও ১৯৭৮ বিশ্বকাপে। দুটি ম্যাচেই আর্জেন্টিনা জয় পেয়েছে।
ইতিহাস আর্জেন্টিনাকে এগিয়ে রাখলেও, পাঁড় আর্জেন্টিনা সমর্থকরাও মেনে নিতে বাধ্য যে, এই ম্যাচে ফ্রান্স ফেভারিট। আর নিবেনই না কেন? আর্জেন্টিনা এক দিকে ধুঁকে ধুঁকে গ্রুপপর্ব পার করেছে, অন্যদিকে ফ্রান্স সহজেই গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় রাউন্ডে এসেছে।
তবে ফ্রান্স দলেরও সমস্যার শেষ নেই। গ্রুপপর্বে তিন ম্যাচে সাত পয়েন্ট পেলেও খোদ ফ্রান্স সমর্থকরাই তাদের খেলায় খুশি নন। তিন ম্যাচে ফ্রান্স গোল করেছে মাত্র তিনটি, এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুই গোলের একটি এসেছে বিতর্কিত এক পেনাল্টি থেকে আর অন্যটি আত্মঘাতী গোল।
তবে ফ্রান্স দলের মূল সমস্যা ম্যানেজার দিদিয়ের দেশমকে ঘিরেই বলা যায়। ছয় বছর ধরে ম্যানেজার থাকা সত্ত্বেও তিনি এখনো দলকে কীভাবে খেলাবেন তা নিয়ে নিশ্চিত নন। অনেকের মতেই নির্দিষ্ট কোনো খেলার স্টাইলের অভাবে এই তারকাপূর্ণ ফ্রান্স দল একটি ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে’ ভুগছে। গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচেই তিনি দলকে খেলিয়েছেন ভিন্ন দুই ফর্মেশনে।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দল গঠন করা হয়েছিল ৪-৩-৩ ফর্মেশনে, যেখানে আক্রমণভাগে ছিলেন তিন ফরওয়ার্ড ছিলেন, দেম্বেলে-গ্রিজম্যান-এমবাপে। মাঝমাঠে খেলেছেন পল পগবা, এন’গোলো কান্তে ও কোরেন্তিন তোলিসো। পরের দুই ম্যাচে ফ্রান্স খেলেছে ৪-৪-২ ফর্মেশনে, যেখানে আক্রমণে ছিলেন অলিভিয়ে জিরু ও আঁতোয়ান গ্রিজম্যান। তাই কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দেশম কোন একাদশ নিয়ে মাঠে নামবেন।
এই বিশ্বকাপের অন্যতম বড় তারকাদের একজন বলা যায় আঁতোয়ান গ্রিজম্যানকে। কিন্তু গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষের পেনাল্টিতে গোল বাদে তার পারফর্মেন্স খুবই হতাশাজনক। এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপে তার সঠিক পাসের হার মাত্র ৬৯.৬%, অন্যদিকে তিন ম্যাচে তিনি মাত্র দুটি‘কি পাস’ দিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়া ও ডেনমার্ক এই দুই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধেই বার্সেলোনার ওসমান দেম্বেলে ছিলেন অকার্যকর। কিলিয়ান এমবাপে অন্যদিকে ছিলেন উজ্জ্বল, পেরুর বিপক্ষে দল জিতেছে তার একমাত্র গোলে। ফুটবলের সবচেয়ে বড় মঞ্চে এসে সদ্য কৈশোর পার হওয়া পিএসজির এই ফরওয়ার্ড দেখিয়ে দিচ্ছেন কেন তাকে নিয়ে এত মাতামাতি।
দেম্বেলে ও গ্রিজম্যানের ফর্মহীনতায় আশার আলো হয়ে দাঁড়িয়েছেন অলিম্পিক লিওঁর নাবিল ফেকির। ডেনমার্কের সাথে বদলি হিসেবে নেমে এই ফরওয়ার্ডের পারফর্মেন্স সবাইকেই মুগ্ধ করেছে। তাই অনেকেই ধারণা করছেন আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দেশম তাকে নামাবেন। এই ম্যাচে মোনাকোর জিব্রিল সিদিবের পারফর্মেন্সও ছিল প্রশংসনীয়, তাই বেঞ্জামিন পাভার্ডের বদলে তিনি আর্জেন্টিনার বিপক্ষে রাইট ব্যাক হিসেবে খেলতে পারেন।
রক্ষণভাগে গোলকিপার টটেনহ্যাম হটস্পারের গোলকিপার হুগো লরিস আর বার্সেলোনার স্যামুয়েল উমতিতি দুজনকেই নড়বড়ে লাগলেও দলে তাদের জায়গা হারানোর সম্ভাবনা খুব কম। সাথে আরেক সেন্টারব্যাক হিসেবে উমতিতির সাথে থাকবেন রিয়াল মাদ্রিদের রাফায়েল ভারান। লেফট ব্যাক হিসেবে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের লুকাস হার্নান্দেজই প্রধান একাদশে থাকবেন আগের তিন ম্যাচের মতো। কান্তে ও পগবা থাকবেন মাঝমাঠে। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার এন’গোলো কান্তের উপরই থাকবে লিওনেল মেসিকে থামানোর গুরুদায়িত্ব। আর্জেন্টিনার দুর্বল মাঝমাঠের ওপর ছড়ি ঘুরানোর জন্য ম্যানেজার দেশম তোলিসো বা মাতুইদিকে নামাতে পারেন, সেক্ষেত্রে পল পগবা আরো স্বাধীনতা পাবেন সামনে এগিয়ে যাওয়ার।
এবার আসা যাক আর্জেন্টিনায়। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে স্বস্তির জয় নিয়ে ফিরলেও ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে শোচনীয় ৩-০ গোলের পরাজয়ের লজ্জা আর্জেন্টিনা দলকে তাড়া করে ফিরবে। ম্যানেজার হোর্হে সাম্পাওলির উপর এখন পুরো দলেরই আস্থা আছে কি না সন্দেহ। একসময় ট্যাকটিক্যাল জিনিয়াস হিসেবে পরিচিতি পেলেও সাম্পাওলির খ্যাতির অনেকটাই অবনতি হয়েছে আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নেবার পর।
গ্রুপ পর্বের তিন ম্যাচে তিনি তিন ফর্মেশনে খেলিয়েছেন দলকে। আইসল্যান্ডের বিপক্ষে ৪-২-৩-১, ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-৪-৩ ও নাইজেরিয়ার বিপক্ষে ৪-৪-২। প্রথমে শোনা যাচ্ছিল, আর্জেন্টিনা গত ম্যাচে ব্যবহৃত ৪-৪-২ ফর্মেশনেই একই একাদশ নিয়েই ফ্রান্সের বিপক্ষে মাঠে নামবে। তবে টিওয়াইসি স্পোর্টসের মতে, আর্জেন্টিনার হয়ে টানা ১১ ম্যাচ গোলশূন্য থাকা গঞ্জালো হিগুয়াইনের বদলে সাম্পাওলি ডান উইঙয়ে নামাবেন ক্রিস্টিয়ান পাভনকে। উল্লেখ্য, টিওয়াইসি স্পোর্টস আগের তিন ম্যাচেই আর্জেন্টিনার একাদশ ঠিকমতো ধারণা করতে পেরেছিল।
এক্ষেত্রে আর্জেন্টিনার ফর্মেশন হবে ৪-৩-৩। মেসি খেলবেন তার পরিচিত‘ফলস নাইন’ পজিশনে। নতুন এই ফর্মেশন ব্যবহারের সুবিধা-অসুবিধা দুটোই আছে। সুবিধা হলো, মেসি তার প্রিয় পজিশনে খেলতে পারবেন, ফলে দলের উপর তার প্রভাব আরো বেশি হবে। তবে অসুবিধা হচ্ছে ফলস নাইনে খেলার কারণে, তিনি দুই সেন্টারব্যাক ও কান্তের দ্বারা কড়া মার্কিংয়ে থাকবেন। আরেক অসুবিধা হচ্ছে দুই উইঙয়ে খেলা পিএসজির আনহেল ডি মারিয়া ও বোকা জুনিয়র্সের ক্রিস্টিয়ান পাভন কারোরই গোল করার ব্যাপারে তেমন নৈপুণ্য নেই। সেক্ষেত্রে গোলের জন্য মেসির উপর অনেক বেশি চাপ পড়বে।
অন্য একটি সুবিধা হচ্ছে, মাঝমাঠে ৩ জন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার থাকার কারণে ফ্রান্সের শক্তিশালী মিডফিল্ডের বিপক্ষে লড়াই করতে সুবিধা হবে। তবে ডাবল পিভট হিসেবে থাকা হাভিয়ের মাশ্চেরানো ও এনজো পেরেজ আছেন ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে। দুজনেই প্রচুর ধীরগতির, তাই ফ্রান্সের দ্রুতগতির আক্রমণের বিপক্ষে তারা কেমন খেলতে পারেন তা দেখার বিষয়। দুজনের কেউই আবার পাসিংয়ে তেমন দক্ষ নন। সেভিয়ার এভার বানেগার উপর তাই থাকবে বিশাল দায়িত্ব সামনের তিন ফরওয়ার্ডের কাছে বল পাঠানোর জন্য।
গত ম্যাচে অভিষিক্ত রিভারপ্লেট ক্লাবের ফ্রাঙ্কো আরমানি এই ম্যাচে থাকবেন প্রধান গোলকিপার হিসেবে। গাব্রিয়েল মার্কাদো ও নিকোলাস তাগলিয়াফিকো দুই ফুলব্যাক। ধীরগতির মার্কাদো ফ্রান্সের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের টার্গেট হতে পারেন। দুই সেন্ট্রাল ব্যাক হিসেবে থাকবেন দুই ম্যানচেস্টার ক্লাবের ফুটবলার নিকোলাস অটামেন্ডি ও নাইজেরিয়ার বিপক্ষে জয়ের নায়ক মার্কাস রোহো। ফেডেরিকো ফাজিও আবারও উপেক্ষিত হবার সম্ভাবনাই বেশি।
সম্ভাব্য একাদশ
ফ্রান্স (৪-৩-৩): লরিস, সিদিবে-ভ্যারেন-উমতিতি-লুকাস, কান্তে-পগবা-মাতুইদি/ফেকির, এমবাপে-গ্রিজম্যান-ডেম্বেলে/জিরু।
আর্জেন্টিনা (৪৩৩): আরমানি, মার্কাদো-অটামেন্ডি-রোহো-তাগলিয়াফিকো, মাশ্চেরানো-বানেগা-পেরেজ, ডি মারিয়া-মেসি-পাভন।
যত হিসেব নিকেশই হোক না কেন, পুরো ম্যাচের ফলাফল নির্ভর করবে একজন মানুষের উপর। তিনি হলেন লিওনেল মেসি। তিনি জ্বলে উঠতে পারলে এই প্রতিভাপূর্ণ ফ্রান্স দলও বাধা হবার কথা না। অন্যদিকে ফ্রান্সের সম্পূর্ণ কৌশল হবে কিভাবে মেসিকে আটকানো যায় তা নিয়ে। আর আঁতোয়ান গ্রিজম্যান চাইবেন এই ম্যাচ দিয়েই ফর্মে ফিরে আসতে।
Featured Image: Scroll.in